Wednesday, August 29, 2018

বোরং

বেশ কিছু বছর আগের বেড়াতে যাওয়া একটা জায়গার গল্প বলি তবে। পাহাড় তো আমায় ভীষণভাবে টানে, মাঝে মাঝেই তাই আমরা তখন পাহারে চলে যেতাম ঘুরতে। হাতে সময় বেশি থাকলে উত্তরাখণ্ড বা হিমাচল, আর সময় নিয়ে টানাটানি থাকলে হাতের কাছে সিকিম বা উত্তরবঙ্গ।

তখন আমি বি এস সি পড়ছি। পুজোর মাসখানেক আগে একদিন হঠাৎ আমি ভোরের দিকে স্বপ্নে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখলাম। তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল, তাই বাবাকে স্বপ্নের কথা বলতেই বললেন, "চল তাহলে। ঘুরেই আসি।" কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায় এই করতে করতেই কাটল গোটা দুই তিনদিন। আমরা একটু অফবিট জায়গা যেতেই ভালোবাসি। ভাবনাচিন্তার ফাঁকে মনে পড়ল, আরে, গত বছর রিঞ্চেনপং আর উত্তরেতে যাদের হোটেলে ছিলাম, ওঁদের তো অন্য একটা হোটেলও আছে। বোরং নাম জায়গাটার। গত বছরের অভিজ্ঞতা যখন ভালোই, তখন নিশ্চয়ই যাওয়াই যায়।

ব্যস, আর কীসের দেরি। সরকারি কলেজ, মহালয়া থেকে ছুটি পড়ে এক্কেবারে জগদ্ধাত্রী পুজোর পর খুলত। ঠিক হল ভাইফোঁটার পর তাহলে দিন পাঁচেকের জন্য ঘুরে আসা যাবে। আর তখন রীতিমত অফ-সীজন। তাই ট্রেনের টিকিট এমন শেষ মুহূর্তে খুঁজলেও পাওয়া যাবেই। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। পরেরদিন সক্কাল সক্কাল বাবা দার্জিলিং মেলের (নাকি উত্তরবঙ্গ, খেয়াল নেই) তিনটে টিকিট কেটে আনলেন। আমি আর মা গড়িয়াতে হোটেলের মালিকের বাড়ি গিয়ে টাকাপয়সা অ্যাডভানস দিয়ে বুকিং করে নিলাম। প্রস্তুতি চলতে লাগল আমাদের টুকটাক। পুজোর হই হুল্লোড় আর ভাইফোঁটার আচার অনুষ্ঠান, গেট টুগেদার সব কাটিয়ে উঠে তো পড়লাম ট্রেনে। যেহেতু বেশ কিছু বছর আগের ঘটনা, ডিটেলে মনে নেই জার্নির কথা। এইটুকু বলতে পারি, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ট্রেন ঢোকার আগে, প্রতিবারের মতোই আকাশ পরিষ্কার পাওয়ায় কাঞ্চনবাবুকে এক ঝলক দেখতে পেয়েছিলাম, জীবন ধন্য ধন্য একটা ব্যাপার। গাড়ি বুক করে আমরা প্রথমে গিয়েছিলাম রাবাংলা। রাবাংলা অনেকেরই ভীষণভাবে পরিচিত একটি টুরিস্ট স্পট। সেই গল্পে জাচ্ছিনা তাই। মোট কথা ওখানে ওই পায়ে হেঁটে ঘুরে বেরিয়ে, মোনাস্টেরিতে গিয়ে, পাহাড়ে চড়ে ভালোই আনন্দ করেছিলাম। ওইখানে দুই দিন কাটিয়ে পৌঁছলাম বোরং।

বোরং পৌঁছেছিলাম দুপুরের দিকে। বাইরে তখন হাল্কা মেঘলা, মাঝে মাঝে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তাঘাট খুব ভালো না। তা ছাড়া আমাদের হোটেলটি যেখানে, সেখানে খুব একটা আশেপাশে আর কিছু নেই। তাই আমার মা যথারীতি টেনশন শুরু করে দিলেন। না জানি কোথায় এসে পড়লাম, কী করে থাকব, ইত্যাদি। তাও রাস্তায় যে গুটিকয়েক লোকজন দেখা যাচ্ছিল, তাদের জিজ্ঞেস করে আমরা তো অবশেষে এলাম আমাদের হোটেলে। রাস্তাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল। হোটেলের বয় এসে আমাদের মালপত্র নিয়ে এগিয়ে চলল রিসেপশনের দিকে।
কী জায়গা, চারিদিক নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে কিছু অজানা পাখির ডাক নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে চলেছে।  একটা অদ্ভুত বুনো গন্ধ যেন হাল্কা ভেসে আসছে নাকে। এরকম জনমানবহীন স্থানে কী করে থাকব, মোটেই থাকতে রাজি নই, এইসব বলে তো আমি আমার স্বভাববিরুদ্ধ ঘ্যানঘ্যান শুরু করলাম। তখন বয়স অন্তত দশ বছর কম, সারাক্ষণ তাই জমজমাট ভিড় পছন্দ। কিন্তু যেহেতু টাকা দেওয়া হয়ে গিয়েছে, আর কিছু করার নেই। অগত্যা...

আমাদের থাকার জায়গা ছিল একটি কাঠের কটেজে। ইলেক্ট্রিসিটিরই তেমন অবস্থা ভালো না, কাজেই বাথরুমে যে গিজার থাকবে, এ আশা করা মোটেই ঠিক না। হোটেলের লোকজনকে বলতে ওরা একটু কাঠের আঁচে জল গরম করে এনে দিলো। আমরা হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হব। সেই জলে অদ্ভুত গন্ধ হলেও, বেশ আরাম লাগল। ক্লান্তি কাটলেই হল। খাবার জায়গাটি আরেকটি কটেজে। আমাদেরটা থেকে হেঁটে কয়েক মিনিটেরই পথ। রাত্রে হেঁটে যাওয়াটা কিন্তু ভয়ের হতে পারে, অন্ধকারে, "জঙ্গলের" মধ্যে দিয়ে। সেইসব ভাবতে ভাবতে পৌঁছলাম ডাইনিং হল। হোটেল পুরো ফাঁকা, তাই যেতেই বসার জায়গাও পেলাম। গরম গরম ভাত ডাল চিকেন কারি তৈরি। খেয়েদেয়ে একটু যেন স্বস্তি। এইবারে চারিদিকে দেখা যায়।

দেখলাম আমাদের কটেজটির মতোই আরো গোটা চারেক এমন কাঠের কটেজ। প্রত্যেকটির সামনে লাগোয়া এক টুকরো বারান্দা। বারান্দায় বেতের চেয়ার পাতা। আর কটেজের পিছনে লম্বালম্বি সরু এক ফালি বারান্দা। বারান্দায় বেঞ্চ পাতা। বুঝলাম মেঘ না থাকলে হিমালয় দেখা যাবে, তাই এই ভিউ নেওয়ার সুব্যবস্থা। কটেজগুলি প্রত্যেকটিই কোন না কোন গাছের নামে। যেমন, আমাদেরটা ছিল পাইন। পাশে ওক, ফার্ন ইত্যাদি। সামনে অনেকটাই বড় বাগান। সেখানে ফুটে রয়েছে বিভিন্ন রঙের গোলাপ,হলুদ ও কমলা গাঁদা, এছাড়াও আরো বিভিন্ন রঙ বেরঙের নাম না জানা বুনো ফুল। এইবারে বুঝলাম ওই অদ্ভুত বুনো গন্ধের রহস্য। একটা দোলনাও দেখলাম। ভিতরের শিশুটি জেগে উঠল, একটু হলেও। আমারও, মায়েরও।

মেঘ জমে আছে তখনও, হাল্কা শিরশিরানি ঠাণ্ডা। গায়ে চাদর বেশটি করে জড়িয়ে বারান্দায় বসলাম। তখনই ঘরের ভিতর যেতে ইচ্ছে করছিলোনা। এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চারপাশটা, বিশুদ্ধ বাতাস। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলাম খানিকক্ষণ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি এসে গেল। আমরাও ঘরের মধ্যে এলাম। জঙ্গলের মধ্যে ঘর, প্রচুর পোকা থাকার কথা। ঝটপট ইনসেক্ট রিপেলেন্ট লাগিয়ে ফেললাম গায়ে হাতে পায়ে। দেওয়ালে ইতিমধ্যেই কয়েকটা বড় মথ দেখতে পাচ্ছি। গরম গরম চা আর পকোড়া সহযোগে নিজেদের মধ্যে গল্প করেই বেশ সময় কেটে যাচ্ছিল। হোটেলের বয় এসে ঘরেই ডিনার দিয়ে গেল। ভাগ্যিস। নইলে এই বৃষ্টিতে অন্ধকারে বেরোতে হলে মুস্কিল হতো ঠিকই। মায়ের নির্দেশমতো ঝুটঝামেলায় যেতে হবেনা বলে মরশুম অনুযায়ী ডিনারে খিচুরি আর পাঁপড়ভাজা। মনে আছে, সেই আমলেই এক প্লেটের দাম প্রায় ষাট টাকা ছিল। চমকে গিয়েছিলাম। এতই দুর্গম? কে জানে। ওদের কথামতো প্লেট বারান্দায় নামিয়ে রাখতে দরজা খুলতে দেখি একটি বিশাল কালো কুকুর শুয়ে। অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ দেখে চমকে গিয়েছিলাম অবশ্যই। তবে সে সাময়িক। তারপর তো তাকে প্রচুর আদর যত্ন করা হল।

রাত্রে খুব ভালো ঘুম হল। সকালে উঠে  দেখি ঝকঝকে আকাশ। মেঘ কেটে গিয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এইখান থেকে দেখা যায়না, কিন্তু আশে পাশের বাকি অনেকটা রেঞ্জ দিব্যি দেখা যায়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে দেখতে খুব ভালো লাগছিল। ভোরের প্রথম আলো কালো সাদা পর্বতশ্রেণীর ওপর পড়ে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য ক্যানভাস। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বসে বসে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে কত সময় কেটে যায়। ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা হোটেলের বাইরে বড় রাস্তায় খানিক হাঁটাহাঁটি করলাম। তেমনভাবে তো কোন কাজ নেই। আশেপাশেও সেরকমভাবে ঘুরে বেড়ানোর আলাদা কিছু নেই। যা আছে, তা ওই রাবাংলা, নামচি, যেগুলি আমরা ঘুরেছি বা পরে যাব। তাই শুধুমাত্র আরাম করা আর সাথে দেদার আলসেমি, এছাড়া কিচ্ছুটি করার নেই। খানিক ঘোরাঘুরির পর ফিরলাম হোটেলে। গুচ্ছ গুচ্ছ বুনোফুলের বাগানে পায়ে হেঁটে তো ঘুরলামই, সাথে দোলনায়ও বসলাম। প্রথম কিছু মুহূর্ত একটু ইতস্তত করলেও মাকে আরামে দোলনায় চেপে মজা পেতে দেখে আমিও দোল খেতে শুরু করলাম। বাবা বারান্দায় বসে সমানে ছবি তুলতে লাগলেন। আমি আর মা দোল খেতে খেতে কত গল্প করলাম, গান গাইলাম... তখনও স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্য হয়নি, আর তাই  প্রতি মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপডেট দেওয়ার ব্যস্ততা নেই। নেই কোন অকারণ ব্যাঘাত। বোধহয় প্রাণভরে ছুটির মতো ছুটি কাটানো একেই বলে।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এবার পালা গল্পের বই পড়ার। বাগানের কোলে চেয়ার পেতে পছন্দের বই। পাশে মোবাইলে বাজছে মৃদুস্বরে প্রিয় গান। বইয়ের পাতা থেকে মাঝে মাঝে মুখ তুলে ওপরে তাকালেই ম্যাজিক। হিমালয়ের অপরূপ বিস্তার। মাঝে মাঝে কালো কুকুরটা পাশে এসে বসছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আবার কখনও ক্যামেরা নিয়ে পটাপট কিছু ছবি তোলা। মা বাবা কখনও শুনতে পাচ্ছি ফোনে কথা বলছে। কী করে যে দিন কেটে গেল, বুঝলামই না। যে জায়গায় প্রথমদিন এসে ভাবলাম কী করে কাটবে সময়, সেইখানেই যে এত উপভোগ করবো, অভাবনীয়।

এই দুদিনে যতটা পেলাম, এত শান্তি বোধহয় কখনও আগে কোথাও পাইনি। লোকজনের থেকে দূরে এসে প্রকৃতির কোলে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দেওয়ায় যে কত মাধুর্য থাকতে পারে, বোরং না এলে জানতেই পারতাম না। তৃতীয়দিন আমরা বোরং ছেড়ে রওনা দিলাম নামচির উদ্দেশ্যে। দক্ষিণ সিকিমের অন্যতম বড় জায়গা। পথে একটা দুর্ধর্ষ ভিউপয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে সাক্ষাত হল। উঠতেই ইচ্ছে করছিলোনা, খালি ওখানেই বসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই থাকি আর পরপর গান গেয়ে যাই, এমন মনে হচ্ছিল। ঝকঝকে নীল আকাশ, সবুজ গাছের সারি, ফাঁক দিয়ে বিশাল হিমালয় পর্বতশ্রেণী, মাঝে দীপ্যমান প্রাণের কাঞ্চনজঙ্ঘা। আহা।

" জীবন জুড়ে লাগুক পরশ      
  ভুবন ব্যেপে লাগুক হরষ
 তোমার রূপে মরুক ডুবে আমার দুটি আঁখিতারা..." (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


পুনশ্চঃ বর্তমানে আমার এক বন্ধুর অ্যালবামের ছবি দেখে বুঝেছি বোরং এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে, আরো উন্নত হয়েছে সমস্তকিছু ওখানে। টুরিস্ট যাচ্ছেন বিপুল সংখ্যায়।


Tuesday, August 28, 2018

বিজ্ঞাপন

কবে থেকে টিভি দেখা শুরু করেছেন বলুন তো? আমি তো সেই কোন ছোটবেলা থেকে সুযোগ পেলেই হাঁ করে টিভির প্রোগ্রাম গিলতাম। তবে ওই ছোট্ট বয়সে টিভি মানে ছিল শুধুই ওই বিভিন্ন অ্যাড জিঙ্গলস। কী মিষ্টি তাদের সুর, ভিডিওগুলোও কী কিউট। ধারার বিজ্ঞাপনটা মনে পড়ে? সেই যে বাচ্চাটা বাড়ি থেকে পালিয়ে স্টেশনে বসেছিল, আর তারপর তার রামুকাকা যেই তাকে বাড়িতে মায়ের হাতে বানানো "জলেবি"র কথা বললেন, ব্যস, সেই চোখে মুখে কী হাসি, কী উৎসাহ! যতই সাফোলা তেলের বিজ্ঞাপনের বাচ্চাগুলো লুচির সাথে তাল মিলিয়ে কার্টউইল করুক না কেন, ভোজনরসিক আমিটি কিন্তু সেই বয়স থেকেই ঠিকঠাক জিনিস পছন্দ করতাম। এখনও ইনোসেন্সের সুর বললে ওই "ধারা ধারা, বিশুদ্ধ ধারা" সুরটাই বারবার মনে হয়।

আরেকটু বড় হলাম যখন, স্কুলে যাওয়া শুরু। মা আর মোনাই বারবার করে বলতো, খুউউব সাবধান। উকুন বাঁধিয়ে এসোনা যেন। সেই সাথে প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিয়োরের মতোই প্রতি রবিবার তখন চলত নিয়ম করে মেডিকার দিয়ে মাথা ধোয়া। ওরে বাবা, তখন স্নানের জন্য কত আয়োজন। ফিল্মস্টারেরা বেশিরভাগই লাক্স সাবান এন্ডরস করে, কাজেই হয় লাক্স মাখো, আর নইলে সোনালি বেন্দ্রের মতো "সৌন্দর্য সাবুন নির্মা"। শীত পড়লে অবশ্য সাপ্তাহিক বর্তমানের লাস্ট পেজ জুড়ে আর ডিডি সেভেনে "এলো শীতের রুক্ষ দিন, প্রিয় ত্বকের যত্ন নিতে চেসমি গ্লিসারিন"। শীতকাল এলো আর "সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন" বলবো না, হয় নাকি? মাঙ্কি ক্যাপের পরেই সবচেয়ে জনপ্রিয় বাঙালির আইডেন্টিটি যে।

তখন ক্রিকেট খেলা দেখা শুরু করেছি।খেলা মোটামুটি বুঝলেও বেশি আগ্রহ থাকত ওই সাদা বা স্কাই ব্লু রঙের জার্সি পরা ভারতীয় ক্রিকেটারদের দিকে মুগ্ধদৃশটিতে তাকিয়ে থাকায়। অজয় জাদেজা, রাহুল দ্রাবিড় এরা সব হার্টথ্রব। পেপসির বিজ্ঞাপনগুলোর জন্য মুখিয়ে থাকতাম। কিংফিশারের "উ লা লা লা উলে লো" অ্যাডে জাদেজাকে কী কিউট লাগত! দ্রাবিড় বিজ্ঞাপন দিতো বলে মনে আছে ৯৩এর বিশ্বকাপের বছর ঢেলে ব্রিটানিয়া চীজ কিনতাম, যদি মিট অ্যান্ড গ্রীটের সুযোগ পাই। কপাল খারাপ। পেতাম শুধুই, "বেটার লাক নেক্সট টাইম।"
এরকম সময়ে ক্যাডবেরির একটা বিজ্ঞাপন খুব পছন্দের ছিল। সাদা জার্সি পরা ক্রিকেটার, ৯৯ এ বল তুলে মারলেন। আউট হতে হতে ছয়। গ্যালারিতে বসা মেয়েটাকে ভীষণ হিংসে করতাম। কী সুন্দর ডেয়ারি মিল্কটা শেয়ার করতে পারতো ওই হ্যান্ডসাম ক্রিকেটারটির সাথে?
বয়স বাড়ল। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম, রেমন্ডের সেই কমপ্লিট ম্যান থাকে শুধুই পর্দার ওপারে। বা "নয়ে ভারত কি, বুলন্দ তসভীর, হমারা বাজাজ"ও টিভির পর্দাতেই শুধু কূল। রিল ও রিয়েলের মধ্যে পার্থক্যগুলি বড্ড প্রকট। 

Monday, August 27, 2018

সংলাপ ৬

গুড মর্নিং
তুই কবে দেশ ছাড়লি?
দেশ ছাড়লাম মানে?
না মানে আমার ঘড়িতে দেখছি সকাল সাড়ে সাতটা। রবিবার। যে ছেলে উইকডেজেও আটটার আগে ওঠেনা, আজ রবিবার... তাই ভাবলাম তুই বোধহয় অন্য টাইমজোনে চলে গিয়েছিস।
না মানে আমি হোল নাইট জেগেছিলাম। এই এইবারে ঘুমোতে যাব। এখন কিন্তু কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাবো। যাতে তুই ফোন করে ডিস্টার্ব না করিস, তাই আগেভাগে কল করে নিলাম।
একশোবার বলি, এরকম ইন্ডিসিপ্লিন্ড লাইফ লিড করিসনা। কে শোনে কার কথা।
ব্যস। জ্ঞানদানন্দিনী মোড অন।
ভ্যাবলাকান্ত নিজের খেয়াল তো নিজে নিতে পারিসনা। সারাক্ষণ তাই টিকটিক করে যেতে হয়। কাকিমাকেও, আমাকেও।
মা তোর চেয়ে কম করে আজকাল।
শী হ্যাজ ক্লিয়ারলি গিভেন আপ অন ইয়ু।
আজ্ঞে না। দ্যাট লেডি ইস ভেরি স্মার্ট। দেখেছে তুই এসব করতে ভালবাসিস, তাই পুরো দায় তোর ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে এখন বিন্দাস চিল করছে।
ওয়াটেভার।
তা আজ বেরোচ্ছিস কখন?
কোথায়?
এই যে বললি তুলির সাথে লাঞ্চে যাবি?
না না। ওই প্ল্যান ক্যান্সেল্ড। ওর নাকি কীসব লাস্ট মোমেন্টে অসুবিধে হয়েছে। বাড়িতে গেস্ট আসছে না কীসব।
যাহ। সানডে ওয়েস্ট?
ওয়েস্ট কেন হতে যাবে? অনেক বই রয়েছে, পেন্ডিং। ওগুলো নিয়েই থাকব।
গুড।
রান্নাও করতে পারি।
কী রাঁধবি?
বল কী খাবি?
আমি কী খাবো, তাতে আর কী যায় আসে? ভিডিও কলে শুক্তোও যা, মাটনও তা, যখন সামনে রাজমা চাউল থাকে।
ঢং করিসনা তো।
ঢং কী দেখলি রে এতে তুই?
আমায় কি গাধা ভাবিস নাকি?
হঠাৎ এই ক্ল্যারিফিকেশন?
পরিষ্কার পিছনে বাংলায় কথা শুনতে পাচ্ছি। গাড়ির হর্নের আওয়াজও। তাও যদি না বুঝি তুই কলকাতায় এসেছিস, তাহলে কী বলব নিজেকে?
যাচ্চলে। তাহলে আমার পুজোর ছুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার সারপ্রাইজটা মাটি?
অ্যাজ অলওয়েজ! এনিওয়ে, কতদূর পৌঁছলি বল? লুচি আর আলুর চচ্চড়ি খাবি তো?
কোই শক ভেব্লি?
বাঁদর কোথাকার। দাঁড়া, একটা লুচি কম দেবোই দেবো।
সে ঠিক আছে। অন্য কিছুতে পুষিয়ে নেবো।

প্রাত্যহিকী

গত সাতদিন এক নাগাড়ে বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে ঝকঝকে নীল শরতের আকাশ।  পারুল খুব খুশি, জামাকাপড়গুলো ছাদে মেলতে পারবে। সোমনাথ সরকার অবশ্য এইসব দেখেন না, কী বৃষ্টি, কী রোদ, তেমনভাবে কিছুই যায় আসেনা। রিটায়ার করেছেন দশ বছর হতে চলল। গত দশ বছর ধরে প্রতিদিন সকাল ছটায় বিছানা ছেড়ে  বেডরুম লাগোয়া এই ছোট্ট ব্যাল্কনিতে ইজিচেয়ার পেতে বসেন, সাথে থাকে কোন না কোন বই, নিজের বিরাট সংগ্রহ থেকে। পাশে টেবিলে রয়েছে একটি আদ্যিকালের পুরনো কালো রেডিওসেট। ১০৭ ও ১০০.২ মেগাহার্টজ, এর মধ্যেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলে সংবাদ আর গান। পারুল সময়ে সময়ে এসে চায়ের জোগান দিয়ে যায়। এগারোটার দিকে সোমনাথ স্নানের জন্য ওঠেন। তারপর চটজলদি দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ব্যাল্কনিতে ফেরত।। বই পড়তে পড়তে মাঝেসাঝে ঝিমিয়েও নেন। সন্ধ্যের মুখে সামনের পার্কে বাচ্চাগুলো হই হুল্লোড় হুটোপাটি করে, ভারি আমোদ পান ওদের দেখতে, নাতির কথা মনে হয় তখন। স্ত্রী সরলাদেবী গত হয়েছেন দুই বছর হল। পারুল ঘরের কাজ আর টিভি সিরিয়াল নিয়ে থাকে। সোমনাথ একলা মানুষ। সারাদিন তাই এইভাবেই নিজের মতোই সময় কাটিয়ে দেন।

ছেলে সম্বুদ্ধ চাকরিসূত্রে দশ বছর ধরে লন্ডনে থাকে, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে। পারুলের থেকে নিয়মিত সোমনাথের খোঁজ খবর নেয়। ইদানীং সোমনাথের বয়সের কারণে মাঝে মাঝেই খুচখাচ অসুস্থতা তাদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। তাই তড়িঘড়ি সম্বুদ্ধ এসে এবার ওর সাথে সোমনাথকে বিলেত নিয়ে গেল। অন্তত কিছু মাস যাতে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। একমাত্র ছেলে, দায়িত্ব বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। পারুল খুব কাঁদছিল সোমনাথ চলে যাচ্ছেন বলে। ওর সাথে নিয়মিত ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোমনাথ সাথে কিছু খুব শখের বইপত্তর নিয়ে রওনা দিলেন অধীর আগ্রহে। নাতিবাবুর সাথে দেখা হবে অবশেষে। এইবার থেকে ওর সাথেই খেলে গল্প শুনিয়ে দিব্যি সময় কেটে যাবে।

তিন মাস হল সোমনাথ লন্ডনে এসেছেন। ছেলে বৌমা খুব যত্ন করে। আলাদা ঘর, তার লাগোয়া ছোট্ট ব্যাল্কনি। ব্যাল্কনিতে পাতা আরামকেদারা। পাশে কফি টেবিল। টেবিলের ওপর রাখা হালফিলের রেডিও সেট, বিলেতের স্টেশন থেকে সেখানে বাংলায় গান চলে সারাদিন। সোমনাথ এখনও সেই সকাল ছটায় ওঠেন। সারাদিন বই পড়ে কাটান। তবে এ বই কাগজের না, এ ট্যাবে। বৌমা অফিস যাওয়ার আগে খাবার গুছিয়ে রেখে যায়, সারাদিন ছেলে বৌমা অফিস আর নাতি প্লে স্কুল আর ক্রেশেই কাটিয়ে দেয়। বিকেল হলে সামনের পার্কের বাচ্চাগুলো খেলে। মাঝে মাঝে বেলার দিকে পারুলকে ভিডিও কল করে খোঁজখবর নেন। দিব্যি সোমনাথের সময় এখানেও কেটে যায়।


শুধু মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যি, কীই বা কলকাতা, কীই বা লন্ডন। একাকীত্বর বুঝি দেশ কাল সীমানা হয়না।

Friday, August 24, 2018

সংলাপ ৫

হ্যালো?
বল।
এক্ষুনি সুইগির লোকটা ডেলিভারি দিয়ে গেল।
জানি। এস এম এস পেয়েছি।
থ্যাঙ্ক ইউ।
হুম।
তুই এখনও আপসেট, না?
ছাড় না ওইসব।
সরি রে, আই নো, আই প্রব্যাব্লি শুডন্ট হ্যাভ রিয়াক্টেড দ্যাট ওয়ে।
আমি খুব দুঃখ পেয়েছিলাম রুমুন তোর ব্যবহারে।
আমি জানি, আমি খুব বাজে ব্যবহার করেছি তোর সাথে সেদিন। আসলে এই লঙ ডিস্টেন্সটা আমায় কীরকম ইন্সিক্যোর বানিয়ে দিচ্ছে।
কীসের ইন্সিক্যোরিটি রুমুন? লঙ ডিস্টেন্স তো কী হয়েছে? তুইও এক আছিস, আমিও মানুষটা এক রইলাম। তাহলে কীসের সমস্যা?
আমি জানিনা। সারাক্ষণ মনে হয় দূরে আছি বলি তুই হয়তো সরে যাচ্ছিস আমার থেকে।
তুই আমায় ভরসা করিসনা, না?
ধ্যাৎ , অগ্নি। ওরকম বলিসনা।
তাহলে ভরসা করিসনা কেন?
জানি না। সবাই যে বলে লঙ ডিস্টেন্স ডাজন'ট ওয়ার্ক...
কুছ তো লগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কেহনা...
ট্রু...
শোন, দিস ইজ আ চ্যালেঞ্জ টু আস। দেখাই যাক না, কেমনভাবে আমরা এটা কাটাতে পারি। কবে ফিরব বা তুই এখানে আসবি, জানিনা ঠিকই।
ঠিক বলেছিস। কোন কাজের কাজ তো হলোই না এই দুদিনে। উল্টে দুজনেই বিচ্ছিরি মুডে কাটালাম। মিছিমিছি মুহূর্তগুলো নষ্ট করলাম।
এই তো। এইবারে মাথায় ঢুকল?
ইয়েস!
আমি জানি তো, আমার ভেব্লি বুড়িটা এমনিতে স্মারট অ্যান্ড ইনটেলিজেন্ট, শুধু মাঝে মাঝে মাথায় পোকা নড়ে।
হুম...
নে, এবার খেয়ে নে। সুপটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর ভালোই লাগবেনা। তখন কমপ্লেন করলেও আরেকবার অর্ডার করতে পারব না। মাসের শেষ। পকেট ফাঁকা।
খাচ্ছি। তুই বাই দি ওয়ে, খেয়াল রাখ। তোর পিজ্জাটা রওনা দিয়েছে। ট্র্যাক করছিলাম। এই এলো বলে। তোরটা আসুক, একসাথে ভিডিও কল করতে করতে খাবো।
আমাদের সানডে লাঞ্চ ডেট?
নয়তো কী?   

Wednesday, August 22, 2018

সংলাপ ৪

জানিস আজ একটা কেস হয়েছে।
কী কী?
আমাদের অফিসে নতুন ট্রেনিগুলো এসেছে বলেছিলাম না?
নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে কাউকে তোর পছন্দ হয়েছে?
আরে না। উফ, শোন না।
বল।
শিরিন বলে একটা মেয়ে, সে দেখি আজ আমায় হেব্বি ঝারি মারছিল মিটিঙে।
নাআআআইস!
হ্যাঁ, বল? এই বুড়ো বয়সেও কচি মেয়েরা ঝারি মারছে, দারুণ সেলফ গ্র্যাটিফিকেশন হচ্ছে কিন্তু।
গ্র্যাটিফিকেশনের নিকুচি করেছে। আরো ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্টেটাস সিঙ্গল করে রেখে দে। শুধু শিরিন কেন, টিনা অঞ্জলি পারুল জুহি সব্বাই লাইন মারবে।
আহা মারুক না। আমি পাত্তা দিচ্ছি নাকি?
পাত্তা দিচ্ছিস কি আমি কী করে জানব?
দিলে তোকে থোড়াই বলতাম এই ঘটনাটা, গাধা!
বলা যায়না।
ধুস।
ধুস ধাস করিসনা। তুই এফবিতে কেন রিলেশনশিপ স্টেটাসে কমিটেড দিস না বল তো? আর ইউ এশেমড টু একনলেজ মি ইন পাবলিক?
কী সব আবোল তাবোল বলছিস রুমুন?
আর না তো কী?
তুই তো জানিস এফবিতে আমার গুষ্টিসুদ্ধু আত্মীয়।
তো?
তারা দেখলে প্রচুর জল্পনা কল্পনা করবে।
করুক। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট, তুইই তো বলিস।
আই নো। কিন্তু...
কী কিন্তু?
আমার ফ্যামিলি খুব অর্থোডক্স। আমার মা বাবাকে কথা শোনাবে।
পাত্তা দিস কেন তোরা?
তুই বুঝবি না।
ওই তো বলবি... যখনই আর যুক্তি থাকবেনা, তখনই পেটেন্টেড ডায়লগ দিবি।
রুমুন ওয়াই আর উই ফাইটিং ওভার দিস? তোকে ফোন করলাম একটা ফুরফুরে মুড নিয়ে, দেখ কেমন কেঁচে গেল।
সত্যি বললে ওরকমই লাগে অগ্নি।
ধ্যাত্তেরি। ডিসগাস্টিং।  

রেসিপি পোস্ট

আজ অফিসে সারাদিন ভীষণ খাটুনি গিয়েছে গুঞ্জার। পরপর শুধুই বিভিন্ন টিমের সাথে মিটিং। কখন থেকে খিদে পেয়েছে, এদিকে জুটেছে শুধুই কাপের পর কাপ কফি। বাড়ি ফিরে কে জানে কী জুটবে। তাও ভালো আজ ক্যাবটা সময়মতোই পেয়ে গিয়েছিল। তবুও, বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে দশটা বেজেই গেল সেই। বেল বাজানোর মুহূর্তের মধ্যেই দেখল হাসি মুখে বজ্র দাঁড়িয়ে।
"কী রে, এত ভালো মুড দেখছি যে? কী ব্যাপার? ইন্ডিয়া জিতে গেল নাকি?"
"ইয়েস!"
"বাহ। কখন ফিরলি?"
"এই তো আটটার দিকে।"
"হুম। এই, ইন্ডিয়ার জেতার সেলিব্রেশনে চল অর্ডার করি খাবার। খুব খিদে পেয়েছে। ফ্রিজে কিচ্ছু রাঁধা নেই। এখন রান্না করার এন্থু পাচ্ছিনা। প্লিজ?"
"চিল ম্যাডাম। আমি অলরেডি ব্যবস্থা করে রেখেছি।"
"ও মা, তাই? কী করলি?"
"দেখলাম ফ্রিজে মাটন কিমা আছে। বানিয়ে ফেললাম মাংসের কোপ্তা কারি। আর সাথে ঝটপট জিরা রাইস। "
"বাবা, এত সোজা নাকি? দু ঘণ্টার মধ্যে রেডি?"
"হ্যাঁ। জিরা রাইসটা তো রাইস কুকারে বানালাম। কিছুই না। কুকার অন করে ওতে ঘি দিলাম। তাতে পিঁয়াজ কুঁচি দিয়ে খয়েরি করে ভেজে নিলাম। ইতিমধ্যে কুকারে ভালো মতো জিরে, আস্ত গরম মসলা আর গোলমরিচ দিয়ে খানিক সাঁতলালাম। এবার ওতে পনেরো মিনিট ভিজিয়ে রাখা বাসমতী চাল দিয়ে অল্প নেড়ে নুন চিনি স্বাদ অনুযায়ী দিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে দিলাম। ব্যস। এবার নর্মাল ভাতের মতো হতে দিলাম।"
"ইম্প্রেসিভ!"
"আর যখন এটা হচ্ছিল, ওই সময়ে কোফতা বানিয়ে ফেললাম। ওই তো কিমা, পিঁয়াজ কুঁচি, রসুন আদা বাটা, গরম মসলা গুঁড়ো, অল্প টমেটো কুঁচি, লঙ্কা কুঁচি আর একটু বেসন দিয়ে ভালো করে মেখে নিলাম। ও হ্যাঁ, তেলও। তেল না দিলে তো কোফতাও হচ্ছেনা আজকাল!"
"যা বলেছিস।"
"বেশ গ্রিজি ব্যাপারটা হতে ছোট ছোট বল আকার দিলাম মিশ্রণটাকে। তারপর ওই গ্রেভি বেসটা বানালাম। তেলে গরম মসলা ফোড়ন আর তাতে লঙ্কা আর দইয়ের মিশ্রণ। তেল ছেড়ে আসছিল যখন, বাকি আদা রসুন আর গরম মসলা গুঁড়ো দিলাম। সাঁতলালাম। এরপর আসতে আসতে কোপ্তাগুলো ওতে ঢেলে ফুটিয়ে নিলাম।"
"ওরে শুনেই জিভে জল এসে গেল আমার। তুই খাবার পরিবেশন কর, আমি ঝটপট একটু রায়তা বানিয়ে ফেলি। দই আছে তো বাকি?"
"তুই হাত ধুয়ে এসে টেবিলে বস শুধু। রায়তাও আমি করে রেখেছি।"
"আই লাভ ইউ বর!"

ডিনারটা কিন্তু খুব জমেছিল। ভাগ্যিস বজ্রর রান্নাবান্নায় শখ রয়েছে, গুঞ্জা দিব্যি মাঝে মাঝেই এমন সুন্দর সুন্দর ট্রিট পেয়ে যায় তাই। 

কলকাতার জন্য

কখনও অনেকদিন পর ট্রেনে চেপে বাড়ি ফিরেছেন? বা প্লেনে? মনে হয়না, কখন ট্রেনটা হাওড়ায় ঢুকবে। বা ওই তো, নীচে দমদম দেখা যাচ্ছে। সেই ব্রিজ, গাড়ি, বাস। কখন মাটি ছোঁবে প্লেনের চাকাগুলো? আমি যখনই ট্রেনে চেপে ম্যাড্রাস থেকে কলকাতা ফিরেছি, গোটা রাস্তা শুধুই হয় তামিল নয় তেলুগুতে বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন দেখে দেখে চোখ পচিয়েছি। বিরক্ত লাগত। কিছুই পড়তে পারছিনা, তাও দেখছি। কেন জানেন? কারণ তারপর পরেরদিন সকাল নটার দিকে যেই ট্রেনটা খড়গপুরের দিকে আসবে, ব্যস, দেওয়াল জুড়ে শুধুই তখন বাংলা হরফ। সিমেন্ট থেকে শুরু করে কোচিং সেন্টার, শাড়ি থেকে শুরু করে টিউবওয়েল। তখন তার চেয়ে মনোরম দৃশ্য বুঝি আর কিছুই হয়না। আর তারপর যখন সিগনাল খেতে খেতে ট্রেনটা হাওড়ার প্ল্যাটফর্মে ঢোকে, ম্যাজিকের মতোই সব ক্লান্তি কথায় যেন ফুঁ দিয়ে উড়ে যায়। একেই বুঝি ঘরে ফেরা বলে, তাই না?

গানঃ Journey Song (Piku)


আসলে আমরা যেখানেই থাকিনা কেন, কর্মসূত্রে কি লেখাপড়ার জন্য, দিনের শেষে যেন মনের কোন এক কোণে সব সময় কলকাতা একটা আলাদা টান নিয়ে থাকে। মনে পড়ে,ম্যাড্রাস থেকে পুণে যাচ্ছিলাম, বম্বে দিয়ে ফ্লাইটে। আমায় এক সহযাত্রী জিজ্ঞেস করেন, "তুমি কোথায় থাকো?" একটুও না ভেবে উত্তর দিয়েছিলাম, "কলকাতা"। সাব কনশাসে রয়ে আছে যে। কী করি? পাঁচ বছর হল শহরটা ছেড়েছি। জানিনা ফিরব কি না আর।  কিন্তু সত্যি কি ছাড়তে পেরেছি? পারা কি যায়? এই শহরের আকাশে বাতাসে যে এত টুকরো টুকরো স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে, সেইগুলি কি প্যাকারস অ্যান্ড মুভারসরা আমার সাথে পাঠাতে পেরেছে? এখনও কেন উত্তরের কোন গলি দিয়ে গেলে শিহরিত হই? দক্ষিণের জাঁকজমকে নতুন করে প্রাণশক্তি পাই?

গানঃ এই কলকাতা ১৬ আমার

কলকাতা তো নিছকই একটা শহর না। বরং কলকাতা আসলে একটা ইমোশন। এ শহরের পথে ঘাটে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে আবেগ, রয়েছে ভালোবাসা। দু পা অন্তর আছে নিখাদ বন্ধুত্ব। পথের ক্লান্তি দূর করতে রয়েছে হঠাৎ পাওয়া বন্ধু। বিপদে আপদে পাশে থাকার জন্য আছে বিরাট পরিবার। হয়তো ভবানীপুর শোভাবাজারের রোয়াক বা গলি তস্য গলির চায়ের দোকানের আড্ডা রিপ্লেসড হয়েছে বাইপাসের ধারের হাইরাইজে আর মোড়ে মোড়ে সিসিডি আর বারিস্তায়, তবুও কোন এক আশ্বিনের শারদপ্রাতে কিন্তু গোটা শহরটাই একসাথে  সেজে ওঠে এক বিরাট মিলনোৎসবে।

গানঃ কলকাতা সং (প্রাক্তন)

সংলাপ ৩

শোন সেল চলছে। আমি তোর জন্য শপিংটা করে নিচ্ছি।
হুম।
উফ, আবার শুরু হল এর হুম হুম করা। বিরক্ত লেগে যায়।
আরে ঠিক আছে। শপিং করে নে।
হ্যাঁ করব। কী কিনব তোর জন্য?
যা ইচ্ছে। প্রত্যেকবারই তো কিনিস।
সে কিনি। কিন্তু তোর যদি কোন প্রেফারেন্স থাকে...
না না। তুই যা ভালো বুঝবি, তাই কিনবি।
এই তো, বেশ ইজি ওয়ে আউট। অসহ্য লেগে যায়।
আহা, আমার জন্য ভালো কী, তোর চেয়ে ভালো কেউ বোঝে বল? তাই জন্যই তো তোকে বলি।
যত ন্যাকামি।
সে তুই যা ইচ্ছে নাম দে। ঘুষ বল, ন্যাকামি বল। কিন্তু ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
হয়েছে। আর সেন্টি দিতে হবেনা।
সেন্টি নাহয় দেবো না। কিন্তু সেনকে তো নিবি?
aargh! cheesy...
সে যা ইচ্ছে বল...
যাক গে। টিশার্টই নিচ্ছি তাহলে।
বেশ।
কী রঙ? কালো তো?
অ্যাজ ইউসুয়াল।
সেই। তোর ওই কালো কালো আর কালো। আর যেন পৃথিবীতে রঙ হয় না?
আর তোর ওই হলুদ হলুদ হলুদ। সেইবেলা?
আহা, সেই না হলে আমরা কী করে কালি-পিলি ট্যাক্সি কম্বো হতাম বল?
ইশ রুমুন, এই অষ্টমীতে সাত বছরে প্রথম আমরা অষ্টমীতে একসাথে থাকব না।
প্রথম আমাদের একসাথে অষ্টমী স্পেশাল ছবি উঠবেনা।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে রে।
আমারও... খুউউব... 

Tuesday, August 21, 2018

উম্মির জন্য

ঠাকুমা বললে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, আমার উম্মিকে দেখলে কিন্তু কক্ষনোই সেটা মনে হতোনা। অযথা প্রশ্রয় বা দুষ্টুমি করলে মায়ের কাছে বকা খেলে বা মার খেলে কখনই উম্মি আমায় বাঁচাতে আসত না। হয়তো নিজে স্কুলের টিচার ছিল বলে শাসন ও তার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভীষণভাবে ওয়াকিবহাল ছিল।
উম্মি বলতেই যে ছবিটা মনে পড়ে তা হল পাঁচ ফুট দুইয়ের এক নরমসরম মানুষ। একটা সাদা ঢলঢলে ব্লাউজ গায়ে, সাথে সাদা শাড়ি, সবুজ বেগুনি নেভি ব্লু বা কালো সরু পার। হাতে একটা রুপোর বালা। বড়ি খোঁপা। আর কোথাও বেরোলে আলমারি থেকে বের করে পুজোয় বা পয়লা বৈশাখে আমার  বাবা বা জ্যাঠার থেকে পাওয়া ঘিয়ে রঙের মুর্শিদাবাদ সিল্কের ওপর সবুজ পার আঁচল শাড়ি। হাতে সোনার বালা। ব্যস। আর কোন সাজ নেই।
আমি যখন সবে দুই, সেই বছরই উম্মি রিটায়ার করে চাকরি থেকে। দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা ছিল। সেইসবের স্মৃতি নেই কোন, শুধু ছবিতে দেখেছি। আমার মনে পড়ে, লোয়ার কেজিতে পড়ার সময় স্কুল বাস আমায় ক্রেশে না নামিয়ে এগিয়ে চলে যাচ্ছিল। আর দুর থেকে সেটা দেখতে পেয়ে উম্মি এক সাইকেল আরোহীকে বাসের পিছনে তাড়া লাগিয়ে বাস থামায়। তারপর ক্রেশে নিয়ে গিয়ে বড় আনটিকে এমন বকা বকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য, ওই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী বড় আনটি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।
ছোটবেলায় আমাদের টিভিতে কেবল কানেকশন ছিলনা। উম্মিরটায় ছিল। আমি স্কুল থেকে ফিরতাম পৌনে চারটের মধ্যে। ছুটতে ছুটতে ওপরে যেতাম। পাইলোকার নামে চোখের ড্রপ দিতাম উম্মিকে। আর সেই সুবাদে বসে বসে  চলত একতা কপূরের বস্তাপচা সিরিয়ালে হাতেখড়ি। এমনও হয়েছে কোন প্রিয় দেশের খেলা হচ্ছে, সিরিয়াল দেখতে দিতাম না। কম দৌরাত্ম্য করিনি উম্মির সাথে।
সন্ধ্যে সাটায় দূরদর্শনের বাংলা সংবাদ নিয়ম করে শুনত। খবর শেষ হলে টুকটুক করে নিচে নামত, ডিনার সারতে। পায়ের আওয়াজ পেলেই আমি সিঁড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিতাম আর এক ছুট্টে গিয়ে হাতটা ধরতাম। তারপর হাত ধরে খাবার টেবিল অবধি পৌঁছে দিতাম। দুটো রুটি তরকারি আর আম বা দুধ। এই ছিল রাতের খাবার। সারা বছর এক মেনু। শুধু  অম্বুবাচির সময় লুচি আম ম্যাঙ্গো মিল্কশেক পেঠা ডালমুট আর একাদশীতে সাবুর খিচুরি।
সকালবেলা ফুলের সাজি হাতে বাগানের গাছ থেকে জবাফুল তোলা, গাছের ফুল নিয়ে সপ্তমী থেকে নবমী স্নান করে নতুন কাপড় পরে আমার হাত ধরে বাড়ির পিছনের প্যান্ডেলে অঞ্জলি দেওয়া, নীল বা শিবরাত্রিতে মা জেঠির সাথে শিবের মাথায় জল ঢালা, জামাইষষ্ঠীর দিন ভিজে হাতপাখা দিয়ে আমাদের হাওয়া করা।
গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি বা শীতের ছুটিতে বা সাপ্তাহিক বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটি থাকলে আমি দিদি আর উম্মি থাকতাম সারাদিন বাড়ি। বারোটা বাজতেই উম্মি নিচে নেমে আলু ভাজত, বা কোনদিন ভেন্ডি। দুটোই চিনি মাখিয়ে, ক্যারামেলাইজড টেস্ট আসত। আজও আমি এই দুটো ভাজা অন্য কোনভাবে খেতে পারিনা। মনে পড়ে শীতকালে টমেটো মটরশুঁটি চিনি মাখিয়ে ভাত দিয়ে মেখে খেত। আমি একদম ভালবাসতাম না। কিন্তু কোনদিনও তার জন্য বকেনি আমায়।
জাগরণী পাঠাগার থেকে একসাথে মা বাবা উম্মি আর আমার জন্য বই আসত নিয়ম করে। ছুটির দুপুরগুলো দুজনে দিব্যি বই পড়ে কাটাতাম। কোনদিনও যদিও গল্প শোনায়নি আমায়  অন্যদের ঠাকুমা দিদিমাদের মতো। হয়তো পঁয়ত্রিশে স্বামীহারা হওয়ায় দুই ছেলে মানুষ করার অসম্ভব দায়িত্বে বেশিরভাগ আবেগ চলে গিয়েছিল। ওই যুগে বি এড পড়ে স্কুলে চাকরি করে দুই ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করা, চারটিখানি কথা না। এবং চিরকাল নিজের পায়ে দাঁড়ানো। এমনকি, বাড়ি পর্যন্ত নিজের জমানো টাকায় কেনা। কোনদিনও ছেলেদের কাছে কিছু চায়নি। অসুস্থতার সময়েও না।
টুকরো টুকরো অনেক কথাই মনে পড়ে যায় আজকাল। তবে সবচেয়ে বেশি আক্ষেপ হয়, মাধ্যমিকের রেজাল্টের কথায়। বাবার চাকরিসূত্রে অফিশিয়ালি রেজাল্ট বেরনোর আগের রাত্রে (প্রায় এগারোটা সাড়ে এগারোটা) আমার মার্কস জানতে পারি। সকলকে জানিয়েছিলাম, উম্মি ছাড়া। উম্মি তখন খুব অসুস্থ। কড়া কড়া ওষুধের ফলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, জাগাইনি। পরেরদিন সকালে যখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, আমি দেখা করে বললাম, আমায় বলেছিল, "তুই কাল আমায় রাত্তিরে জানাসনি কেন? আমি খুব দুঃখ পেয়েছি তুতুল।"
তুমি চলে গিয়েছ আজ চৌদ্দ বছর হয়ে গিয়েছে। সেই রাত্তিরটা যেমন এখনও মনে পড়ে, বাড়ির কাজের মাসি আমায় ওই মাঝরাত্রে "বনু, ওঠো, ওপরে এসো" বলে, তখনই বুঝেছিলাম। তুমি নেই আর। তবু বেশি আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তোমার বলা ওই কথাগুলো। তোমার অভিমান। "আমি খুব দুঃখ পেয়েছি তুতুল।" সরি উম্মি।

স্মৃতিচারণাঃ গড়িয়াহাটার মোড়

"কীরে, পুজোয় কটা নতুন জামা হলো? জুতো কিনেছিস?"
"মা, পূজার মতো একটা ফ্রিলের ড্রেস আমারও চাই।"
"শুনছো, বাবুই আর বুবানের শার্ট কিনতে যেতে হবে। ওরা কিন্তু ভালো জিন্স কিনবে বলেছে।"

পুজোর মাসখানেক বা আজকাল হয়তো আরো আগে থেকে, মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে ঘরে এ যেন বহু পরিচিত ও বহুশ্রুত সংলাপ। মনে পড়ে যায় না সেই পুজোর এক দুই মাস আগে থেকে মায়ের সব ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায় "এবারে পুজোর রঙ কী" বা "পুজোয় কোন শাড়ি হিট", এই ধরণের   হেডলাইনের ভিড়? চকচকে পাতায় কত রঙিন পোশাক আর সাজগোজ করা মডেলদের ছবি। সেইসব দেখতে দেখতে চোখে এক রাশ রুপোলি স্বপ্ন। আসলে বাঙালির কাছে দুর্গা পুজো তো শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বরং বলা চলে, বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব। আর এই উৎসবের সূচনা শুরু হয়ে যায় অনেক মূল তিথির বেশ অনেকদিন আগে থেকেই। মাঠে বাঁশ পোঁতার দিন থেকেই মনে মনে চলতে থাকে নানান পরিকল্পনা। কোথায় ঘোরা হবে,  কোন থিমের প্যান্ডেল যাওয়া হবে, ইত্যাদি। তবে এই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়ে যে চিন্তাটা মনের মধ্যে সারাক্ষণ উঁকি ঝুকি মারে, তা হল, পুজোর ফ্যাশন আর বাজার।  যদিও এখন সারা বছরই দোকানপাট করা হয়, বা অনেক সময়েই অনলাইনে কেনাকাটিতে আমরা অভ্যস্ত, তবুও এই কটাদিনের জন্য বুঝি পায়ে হেঁটে ঘুরে বেরিয়ে কেনাকাটি করায় আলাদা আকর্ষণ। আমি কলকাতার মেয়ে, তাই আমার কাছে পুজো মারকেটিং মানেই গড়িয়াহাট, হাতিবাগান, নিউ মার্কেট আর দক্ষিণাপন। চলুন, আজ বরং একটু গড়িয়াহাট অঞ্চলে বাজারহাট করি গিয়ে। কী বলেন? 



বেলঘড়িয়াগামী ২৩৪ বাস থেকে নেমে পড়ুন তো গড়িয়াহাট মোড়ে। না না, এইখানে না। ব্রিজে ওঠার নামতে হবেনা। এই বাসটা তো ব্রিজের তলা দিয়ে যায়। একদম আনন্দমেলার মোড়ে নামবেন। বেশিরভাগ সময়েই সিগনাল লালই থাকবে। অসুবিধে হবেনা। সাবধানে নামুন। বা দিক দেখে নামবেন। পাশ থেকে অটো বা বাইক এসে যেতে পারে। হ্যাঁ, এইবারে বা দিকে চেপে চলুন। মোড় থেকে ফুটপাথে উঠে পড়ুন। হুম, জানি, জায়গা কম। কিন্তু ওরই মধ্যে ম্যানেজ করতে হবে যে। পুজোর বাজার করবেন, তাও গড়িয়াহাটে। একটু ভিড় তো হবেই। এইখানে এখন মোবাইলের কেস, সস্তা ইয়ারফোন এসব পাবেন, এখুনি এদিকে তাকিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে চলুন আরেকটু এগনো যাক। শুনুন, একটা টিপ দিই। কোন দোকানের সামনেই কিন্তু প্রথমেই দাঁড়িয়ে পড়ে কিনে ফেলবেন না। আগে এক রাউন্ড মারুন, দাম বুঝুন, তারপর দরদাম করবেন। ঠিক? চলুন যাই।



"দিদি এদিকে এদিকে। একশো করে। খালি একশো খালি একশো।" ঘাড়টা ঠিক ঘুরিয়েছেন। বেশ বিভিন্ন প্রিন্টের সুন্দর সুন্দর হাফ প্যান্ট। ছেলেদেরও, মেয়েদেরও। হ্যাঁ, দেখতে পারেন। মন্দ হয়না। আরো চলুন। পরপর এবার "খালি দেড়শো" "দুশো করে দুশো করে" শুনবেন। দু তিনটেতে দাঁড়িয়ে যান। নিশ্চয়ই গোটা তিনেক কুর্তি পছন্দ হবেই হবে। স্মল থেকে ডবল এক্সেল, সব সাইজে নানান রঙে ভিন্ন প্রিন্টে সুন্দর সুন্দর কুর্তির যা কালেকশন, হলফ করে বলতে পারি, এই জিনিস অনলাইন শপিং না করলে পাবেনই না। তবে অনলাইনে দাম বেশি। ঘুরে ঘুরে স্পর্শ করে কেনার অনুভূতি পাবেন না।



চলুন, এগুলো তো হল ওই কমের ওপর। এগুলো তা বলে সপ্তমীর সকাল থেকে পড়া যায়না। এগুলো ওই পঞ্চমী ষষ্ঠী অবধি অফিসে কলেজে বা টিউশানে পরলে চলে যায়। পুজোর আসল দিনগুলোর জন্য কী নেবেন? শাড়ি নাকি সালোয়ার? শার্ট না পাঞ্জাবি? বা দিক দিয়ে সারি সারি দোকান। পাঁচতলা মল থেকে শুরু করে ছোট্ট দোকান। হরেক রকম স্টক। একদম হালফিলের। সিরিয়াল সিনেমার নায়ক নায়িকাদের ফ্যাশনের। আনন্দপ্লাসে ঠিক যেই রঙ আর যেই কাট লিখেছিল, সব পাবেন। হবে নাকি কয়েকটা?



এই রে। ঘড়িটা দেখেছেন? ঘুরতে ঘুরতে আড়াই ঘণ্টা হয়ে গিয়েছে কিন্তু। তাই ভাবি, পেটের মধ্যে একটু খিদে খিদে ভাব আসছে না? কী খাবেন? ফুলুরি নাকি ফুচকা? চলুন রাস্তা পেরোই। ওই ফুটে পেয়ে যাবো দুটোই। তারপর জামার সাথে ম্যাচ করে জুতো আর ব্যাগ কিনতে হবে তো। ট্রেডারসের সামনে ভালো ভালো স্টক রয়েছে।

"দাদা ওই পিঙ্কটা দেখান না। কত এটা?”



"না না, পাঁচশো কী? তিনশোর এক টাকাও বেশি দেবোনা।"



"তিনশো দশ।"



"আচ্ছা ঠিক আছে। এই নিন তিনশো পঁচিশ।"



ব্যস, পছন্দের ব্যাগ পকেটে। এবার জুতো। ভালো করে দেখে নেবেন। ফিটিং আর আরাম, দুইই। পরে অনেক হাঁটাহাঁটি করতে হবে তো সপ্তমী থেকেই। হোল নাইট আছে তো এবারে প্ল্যানে?



এই রে, চলুন চলুন, আকাশের অবস্থা ভালো না। যে কোন সময়ে নামবে বৃষ্টি। ঝটপট বাকি কেনাকাটি করে নেবেন আসুন। টুক করে রাস্তা পার হয়ে নিন। আনন্দমেলার সামনে দিয়ে বিজন সেতুর দিকে মুখ করে চলুন। পরপর ক্লিপ কানের দুলের দোকান। বিভিন্ন দামে পাবেন। চটপট কিনে নিন। নিয়েছেন তো? আর কস্মেটিক্স লাগবে? মার্কেটের ভিতরেও দোকান আছে। আচ্ছা, তখন তো ফুলুরি খেলেন, এবার একটু ফুচকাটা খেয়ে ফেলি? পেট্রোল পাম্পের সামনে যেটা আছে, ওটা থেকে খাই, আসুন। দারুণ বানায়। ঝাল লেগে গেলে কাছেই মিষ্টির দোকান আছে। খাওয়াটা বেশ ভালোই হল, বলুন?

চলুন এবার ফেরা যাক বাস স্টপে। পাঁচটা বাজতে যায়। বাসে কিন্তু এবারে ভিড় হবে। স্কুল ফেরত বাচ্চারা, তাদের অফিস ফেরতা মায়েরা, বাবারা। এতগুলো প্যাকেট নিয়ে আবার বাসে জায়গা না পেলে বেশ অসুবিধে হবে।

জানি পুজোর বাজার কমপ্লিট হলোনা, আবার ফিরতেই হবে কোন একদিন গড়িয়াহাটার মোড়ে, নইলে হাতিবাগানে। বা নিউ মার্কেটে। পুজোর শপিংটা যে ঠিক মলগুলিতে হয় না। তাই না?


Sunday, August 19, 2018

সংলাপ ২

হ্যালো।
হেলেছি।
উফ। আবার সেই স্টুপিড জোক।
যাক। অন্তত আজ তো ওটাকে জোক বলে স্বীকার করলি ফাইনালি!!
বরাবরই বলি। পিজে। পুয়োর জোক।
আচ্ছা ডিজে আর পিজের মধ্যে কোনটা বেটার?
মানে?
মানে ধর গিভেন এ চয়েস বিটুইন ক্র্যাকিং এ পিজে এন্ড এ ডিজে, কোনটা প্রেফার করবি?
কী বোকা বোকা প্রশ্ন করছিস।
প্রশ্ন ইজ নেভার স্টুপিড মাই লাভ। প্রশ্নকর্তা মে বি।
আবার ভুলভাল বকছিস। কী হয়েছে তোর আজ?
কিচ্ছু না। বিন্দাস আছি। তবে একটু হাই হয়ে থাকতে পারি।
আবার গিলেছিস নাকি?
না না না না। ছি ছি। আজ না শনিবার?
তাহলে?
ওই একটু আগে বিরিয়ানি খেলাম আমিনিয়া থেকে আনিয়ে। এবার হোম থিয়েটারে সানডে সাসপেন্স চালিয়ে গ্লাস হাতে বারান্দায় বসব। আহা, বাইরে কী প্লেজ্যান্ট ওয়েদার জানিস। হালকা হাওয়া দিচ্ছে। পারফেক্ট স্যাটরডে নাইট।
শনিবারে বিরিয়ানি? বাহ বাহ।
টেকনিক্যালি দেখ, শনিবার আনলেও এখন বারোটা বেজে গিয়েছে। ইট ইজ সানডে। তাই মাটনে নো রেস্ট্রিকশন।
বুঝলাম।
কী বুঝলি বল।
এই যে তোর মাথারও বারোটা বেজে গিয়েছে।
ছাগল এত সুন্দর একটা সল্যুশন বানালাম, আর তুই আমার খোঁটা দিচ্ছিস। ইডিয়ট কোথাকার।
জানিসই তো আমি গর্দভ।
বাট আই লাভ দিস ভ্যাবলাকান্ত সো মাচ।
মি টু।
মি টু আবার কী? আমিও ভ্যাবলাকান্ত?
ধ্যাত। তুই ভ্যাবলাকান্ত হতে যাবি কোন দুঃখে।
তাহলে? ভুলে যাস কী করে আর এমন লুজ টক করিস?
হুম সেই। ভেবলি বুড়ি নামটা বরং কত্ত সুন্দর!!
এই এই এই। তোর হচ্ছে দাঁড়া। এমন ক্যাল ক্যালাবো না...








Saturday, August 18, 2018

আম্রিকা দর্শন পর্ব ১৩

পৌঁছে গিয়েছি একদম শেষ পর্যায়ে। রবিবার। ১৫ই জুলাই।কাকার বাড়ি যাওয়ার প্ল্যানটা দুর্ভাগ্যবশত মেটিরিয়ালাইজ করলো না। অগত্যা আজ সুজাতা আর আমি আরো একটু ঘুরে নেবো। এই ঠিক হল। বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখে (পিসি কিংবা সুজাতা দুজনের কেউই মিস করতে চায়নি একদম। আমি একটু নিউট্রাল মানুষ। হ্যাঁ, দেখলে দেখবো, না হলে না। কোন ব্যাপার না।) লাঞ্চ সেরে দেড়টা নাগাদ বেরোলাম। নির্দিষ্ট স্টপে পৌঁছতে গেলে হয়তো বাসটা মিস করব। রবিবার। এমনিতেই বাস কম চলে। বুচু পিসির ল্যাপটপে শিডিউল খুলে রাখা। ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে, সেই মতো আমাদের ডেসটিনেশন পালটাচ্ছে। ফাইনালি ঠিক হল আমরা এক স্টপেজ এগিয়ে যাবো। কপাল ভালো, বাস পেয়ে গেলাম। একদম পোর্ট অথরিটি টারমিনাসে গিয়ে নামলাম। বুচু পিসি সমস্ত শিখিয়ে পড়িয়েই দিয়েছিল। আমরা ওখান থেকে মেট্রো ধরলাম। ই লাইনের, WTC যায়, সেইটা। এই প্রসঙ্গে বলি, গোটা ট্রিপে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাই করলাম, সাথে অ্যামেরিকার ট্রেন (অ্যামট্র্যাক) চড়লাম, গ্রেহাউন্ডে লঙ ডিস্টেন্স গেলাম, রুটের বাসে চাপলাম এবং এই এখন আবার মেট্রোর অভিজ্ঞতাও হল। মেট্রো আমাদের কলকাতার এসই মেট্রোর মতোই। শুধু আরো একটু কম ভিড়। এই যা।
WTC স্টপে নেমে অল্প হেঁটে আমরা পৌঁছলাম ব্যাটারি পার্ক। পথে আবার গতকালের ওই সিটি ট্যুরসের হপ অন হপ অফের এক এজেন্ট আমাদের ধরল। মুর্গিও বানালো বলা যায়। খুব বেশি না বুঝে আমরা একটা ক্রুজের টিকিট কাটলাম। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির যে ইতিহাস বা পাশেই এলিস আইল্যান্ডের ইতিহাস, অল্প জানলেও সেরকমভাবে কেন জানিনা টানেনি। আর দুটো জায়গাতেই তখন সাঙ্ঘাতিক রকমের ভিড়। কম করে দুঘণ্টা লাইনে থাকতে হবে। সেই জন্যই আমরা লিবার্টি ভিতরে বা এলিসে যাওয়ার ট্যুর না নিয়ে হাডসন রিভার ক্রুজটা নিলাম। অল্প করে ব্যাকগ্রাউন্ড দিয়ে রাখি এই দুই জায়গার। এলিস আইল্যান্ড হল সেইটি যেখানে প্রথম ইমিগ্রেন্টরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল। সেই আমলের সমস্ত ইমিগ্রেন্টদের নাম নথিভুক্ত তো আছেই, তা ছাড়া ম্যুজিয়ামে তাদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্রও রাখা।
স্ট্যাচ্যু অফ লিবার্টি অবস্থিত লিবার্টি আইল্যান্ডে। তামার তৈরি এই বিশাল স্ট্যাচু প্রায় সকলেই আমরা ছবিতে দেখেছি। অ্যামেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্স উপলক্ষ্যে এটি নির্মাণ করা হয়। লিবারটাস, রোমের স্বাধীনতার দেবী, তার আদলে তৈরি এই তামার মূর্তিটি পৃথিবীর অন্যতম আইকন। বর্তমানে এর ভিতরে ম্যুজিয়ামে তো যাওয়া যায়ই, এ ছারাও ক্রাউন পর্যন্ত ওঠা যায়। তবে সেখানে যাওয়ার জন্য প্রায় মাস দুই আগে থেকে টিকিট কাটতে হয়।
আমাদের ক্রুজে প্রথমেই ম্যানহ্যাটান স্কাইলাইনটি দেখানো হল। সত্যি বলতে কী, কম্প্যুটারের মাদারবোর্ডের একটু ম্যাগ্নিফাইড ভারসান বলেই আমার মনে হয়। পটাপট ক্যামেরা বের করে ছবি তোলা শুরু করে দিলাম। একবার কিট লেন্স তো পরমুহুরতেই জুম লেন্স। দূরে দেখতে পাচ্ছি ব্রুকলিন ব্রিজ। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। ক্রুজ চলতে লাগল আস্তে আস্তে। মাথার ওপর দিয়ে মাঝে মাঝেই হেলিকপ্টার যাচ্ছে। অ্যামেরিকায় ভীষণ বেশি দেখলাম এটা।
একদিকে ন্যু ইয়র্কের ম্যানহ্যাটান স্কাইলাইন, অন্যদিকে ন্যু জার্সির স্কাইলাইন। দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছলাম লিবার্টি আইল্যান্ড। পিলপিল করছে লোক। দূর থেকেই ওই বিশাল সবুজ মূর্তিটিকে দেখলাম। সত্যিই বড়, কিন্তু কে জানে, মনে হয়েছিল বুঝি আরো বড় হবে। প্রচণ্ড চড়া রোদ। পরিষ্কার নীল আকাশ। তার ব্যাকড্রপে আইকনিক স্ট্যাচ্যু অফ লিবার্টি। ভুল করে হলেও লেবুতলা নাকি কলেজ স্কোয়েরের কোন এক বছরের প্যান্ডেলের কথা অবশ্য মনে পড়েছিল। স্ট্যাচু অফ লইবারটির সামনে দিয়ে খানিক ঘোরাঘুরি করলো আমাদের ক্রুজটা। পাশেই দেখলাম এলিস আইল্যান্ড। রবিবার দুপুর। তায় সুন্দর ওয়েদার (যদিও গতকাল রাত থেকে দুপুর অবধি ভালোই বৃষ্টি পড়েছে), ট্যুরিস্টে ঠাসা। ক্রুজ চলতে লাগল হাডসন নদীর ওপর দিয়ে। ব্রুকলিন ব্রিজের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে আনল। ওই ব্রিজে পায়ে হাঁটতে পারলে ভালো হত। বহু হলিউড সিনেমায় দেখা। যাই হোক। একটা সময় ক্রুজ শেষ হল। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ছিল। উপভোগ করলাম। সুন্দর সুন্দর ছবি তুললাম অনেক।
এরপরের গন্তব্য সেন্ট্রাল পার্ক। ন্যু ইয়র্কের বুকে অক্সিজেনের ভাণ্ডার। শেয়ার ক্যাব নিয়ে পৌঁছলাম সেন্ট্রাল পার্ক ওয়েস্ট এন্ড। বিরাট জায়গা জুড়ে এই পার্ক। বাইরে সাইকেল রিকশা রয়েছে অনেক। মিনিটে তিন থেক চার (কখনো পাঁচও) ডলার জনপ্রতি তার ভাড়া। আমরা ততক্ষণে বাইরে বেঞ্চে বসে ফুড ট্রাক থেকে কাবার আর ব্রেড খাচ্ছি। স্বাদ তেমন আহামরি লাগেনি। বেশ লোকজন হচ্ছে কিন্তু রিকশায়। আবার কিছু সাজানো গোছানো ঘোড়ার গাড়িও দেখলাম। খাওয়ার পাট চুকিয়ে আমরা হাঁটা শুরু করলাম। ম্যাপে রিজার্ভয়ের দিয়ে ডিরেকশন দেখে হাঁটতে লাগলাম। শুধুই সবুজ আর সবুজ। লোকে হাঁটছে, দৌড়চ্ছে, জগিং করছে। সাইকেল চালাচ্ছে। সাইকেলের আলাদা পথ। বেশিরভাগ জায়গাতেই চার চাকা নট আলাউড। পথে পড়ল একটা সুন্দর লেক। বোটিং করছে লোকে। লেকের ওই পারে একটা মনোরম ব্রিজ। লোকজন সেখানে পোজ দিয়ে ছবি তুলছে। লেকে হাঁস ভাসছে, মাছ আসছে। চারিদিকের শোভা বড়ই সুন্দর। চোখের আরাম।
সেন্ট্রাল পার্ক বিশাল বড়। পায়ে হেঁটে পুরোটা একদিনে ঘোরা অসম্ভব। তার উপর গত কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে আমরা এখন প্রায় দুজনেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাও টুকটুক করে হেঁটে চললাম। পৌঁছলাম রিজার্ভয়েরে। তেমন কিছুই না। বিশাল জলাশয়। পাশ দিয়ে ম্যানহ্যাটানের উঁচু উঁচু বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পার্কের ফাঁক দিয়ে দিয়েও মাঝে মাঝে সবুজের আড়াল ভেঙ্গে গ্রে ও খয়েরি। সেন্ট্রাল পার্কের বিখ্যাত জগিং ট্র্যাকের পাশ দিয়ে আমরা (ভুলবশত উল্টোদিক দিয়ে) হাঁটা লাগালাম। এই জগিং ট্র্যাকও অনেক হলিউড সিনেমায় দেখেছি। মেইড ইন ম্যানহ্যাটান সিনেমার কথা খুব মনে পড়ছিল বারবার এখানে এসে। আমাদের পার্কের সাউথ ইস্ট সাইডে বেরোতে হবে। বুচু পিসির ওইখানে অপেক্ষা করার কথা। ম্যাপ দেখে লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে এদিক সেদিক করতে করতে অবশেষে বেরোলাম পার্ক থেকে। বুচু পিসি ও তার কলিগের সাথে দেখা হল। একসাথে ডিনার করব আমরা। বাইরে তখনও আলো ঝলমল। এদিকে ঘড়িতে আটটা। আমার জল তেষ্টা পেয়ে একাকার অবস্থা। তাই যেখানে হোক চল, আমার কোন চয়েস নেই জানিয়ে ওরা যেখানে নিয়ে যেতে চায়, রাজি হলাম। ভিয়েতনাম বলে একটি ভিয়েতনামী রেস্টুরেন্টে ডিনার সারলাম। শাক সবজি দিয়ে নূডল, ভাত, মাছের কারি। বেশ লাগল। খেতে খেতে প্রচুর গল্প হল। পেতে খাবার আর জল পড়ে আমি তখন ফুল ফর্মে আবার।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেরার পালা। রাতের ন্যু ইয়র্ক শহরের বুক চিড়ে গাড়ি চলছে। চারিদিকে আলোর রোশনাই, ঝলমলে। সুন্দর লাগছিল। ব্রিজ পেরিয়ে ঢুকলাম ন্যু জার্সি। তারপর বুচু পিসির বাড়ি। পরেরদিন দুপুরে ফ্লাইট। জিনিসপত্র প্যাঁক করে নেওয়ার পালা। এ কদিনে এত মারাত্মক শপিং করেছি, নেহাত সুজাতা ভালো প্যাঁক করতে পারে, তাই ও আমার সুটকেস গুছিয়ে দিল। আমি হলে আঁটাতে পারতাম না। এয়ারপোর্টে মাপলাম যখন, দেখলাম সাত কেজি এক্সট্রা লাগেজ আসার সময়ের তুলনায়।
সোমবার সকাল সকাল স্নান টান সেরে ফেললাম। ব্রেকফাস্ট করে আর সাথে খিদে পেয়ে গেলে কী খাবে বলে পিসি কিছু মিষ্টি আর গ্র্যানোলা বার প্যাক করে দিল। এয়ারপোর্ট পৌঁছে বুচু পিসিকে বিদায় জানিয়ে আমরা ঢুকলাম সিকিউরিটি চেক ইত্যাদির জন্য। এইবারে সঙ্গে সুজাতা আছে। তাই আমি অনেক রিল্যাক্সড। ভালোয় ভালোয় মিটল সব। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, শপিং এর এত নেশা, আসার পথে গাড়ি থামিয়ে একটা ইলেক্ট্রনিক্স শপ (বেস্ট বাই, ভালো অফার চলছিল) থেকে স্যামসাং এর একটা ট্যাব কিনলাম। সেটা হাতে নিয়েই ঘুরছিলাম। ডিউটি ফ্রি শপ থেকেও লাস্ট মোমেন্টের টুকটাক স্যুভেনির কিনলাম। বাবার ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট (পরে পাই টু পাই হিসেব করে ধার শোধ করে দিয়েছি কিন্তু) হচ্ছে। মা ফোন করে বলে, "তুই এখনও কী কিনছিস? এবার তো থাম"।
প্লেনে উঠলাম ঠিক সময়ে। মোটামুটি ফাঁকা প্লেন। সুজাতার আর আমার আলাদা জায়গায় সিট হলেও পরে ওর পাশের সিটগুলো খালি হওয়ায় আমি চলে এলাম ওর কাছে। দুজনে মিলে তিনটে সিট নিয়ে বসলাম। এরপরে শুধুই এয়ার ইন্ডিয়ার রাজকীয় খাওয়া, পানীয় আর সাথে সিনেমা। আর আমাদের গল্প। এই করতে করতে দিব্যি পনেরো ঘণ্টার ফ্লাইট কাটিয়ে ফেললাম। এইবারে ঘুম কম হয়েছিল। কিন্তু ও ঠিক আছে। ও ফিরছে বাড়ি, আমি হোস্টেল। ফেরত গিয়ে যত ইচ্ছে ঘুমনো যাবে। বম্বে এয়ারপোর্টে ওর ইমিগ্রেশন হল, আমার হবে চেন্নাইতে। তাই আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। শেষ বারের মতো গুডবাই হাগ মিস করলাম। অবশ্য একদিক দিয়ে ভালো হয়েছে। বন্ধুকে ছেড়ে আসতে গেলে দুজনেই কান্নাকাটি করতাম। এর চেয়ে এই ভালো। আমার ফ্লাইট ছিল চার ঘণ্টা পরে, ওর ছয়। ওরটা মারাত্মক লেট করলো। বেচারির রাত দশটায় কলকাতায় ল্যান্ড করার কথা। পৌঁছল আড়াইটেয়। আমি সাড়ে আটটার মধ্যে নামলাম চেন্নাইতে। সমস্ত ফর্মালিটি করে লাগেজ নিয়ে সোয়া নটায় হোস্টেলে নিজের ঘরে। প্রচুর লাগেজ আনপ্যাক করতে হবে। অনেক কাজ বাকি। শুধু যে পার্থিব জিনিস নিয়েই ফিরলাম তা তো নয়। অনেক অনেক হ্যাপি মেমোরিজ, দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা, সবকিছু নিয়ে ঝুলি কানায় কানায় ভরে ফিরলাম।

Thursday, August 16, 2018

সংলাপ ১

হ্যালো।
বল।
কথা বলা যাবে?
হুম।
বাড়ি ঢুকেছিস?
হুম।
ব্যস্ত?
তেমন না।
তাহলে কী হুম হুম করছিস?
হুউউউম।
তুই জানিস আমার এই হুম হুম ভাল্লাগেনা।
হুম।
একটা থাপ্পড় খাবি।
হুম।
উফ। আমি ফোন রাখছি।


এই হ্যালো, হ্যালো...।
মাইক টেস্টিং।
১ ২ ৩ ৪
ছাগল একটা।
বল কী বলবি। এই এক ঘণ্টা আগে ফোন ছাড়লি। তারপরে আবার ফোন। নিশ্চয়ই  ছাগল বলা আর থাপ্পড় মারার থ্রেট করতে আবার ফোন করলিনা?
না।
বক্তব্য পেশ কর।
ধুর, মিস করছি তোকে খুব।
হুম।
উফ। আবার হুম?
এই সরি সরি। বল।
কী বল? মিস করছি বললাম, তার উত্তর এই?
আরে আমিও মিস করছি তোকে।
কতটা?
অনেকটা।
তাও? অ্যানালজি দে।
কতটা মিস করছি, এর আবার কী উপমা দেব?
এই ধর, আমি যেমন ট্রেসিমি শ্যাম্পু ইউজ করি।
বেশ। ধরলাম।
না ধরতে হবেনা। এটা ফ্যাক্ট।
আচ্ছা বেশ। বল।
তা আমি মাঝে একবার রজনীর কথামতো ড্যান্ড্রাফ কমাতে অন্য ব্রান্ডের শ্যাম্পু কিনেছিলাম। দুদিন ব্যবহার করে দেখলাম, একদম সুট করছেনা।
এক মিনিট, তুই আমায় কতটা মিস করছিস, তা বলতে শ্যাম্পুর ব্র্যান্ড? ধন্য তুমি, ধন্য হে!!!
উফ। এত ইন্টেরাপ্ট করিস কেন??
বল বল।
তা ওই শ্যাম্পুটা যে কদিন ব্যবহার করলাম, আমার চুল একদম লিম্প হয়ে গিয়েছিল। কী জঘন্য লাগত।
তারপর আবার ট্রেসিমি ব্যবহার করে জেল্লা ফেরত এলো?
রাইট!
তাতে কী দাঁড়ালো?
দাঁড়ালো এই যে আমার চুল যেরকম ট্রেসিমিকে মিস করে অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি ঠিক ততটাই তোকে মিস করছি।
বুঝলাম। কিন্তু আই হ্যাভ আ কোশ্চেন।
বলে ফেল।
চুলটা কে আর ট্রেসিমিটা কে এই ক্ষেত্রে?
অফ কোর্স বাল অলওয়েজ তুইই!!! এ আর বলতে?

আম্রিকা দর্শন পর্ব ১২

ন্যু জার্সিতে গ্রেহাউন্ডের বাস টার্মিনালের বাইরে পিসি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। বেশ কিছু বছর পরে দেখা হল আমার বুচু পিসির সাথে। বুচু পিসি ওখানে একটি কলেজের প্রফেসর। প্রায় তিরিশ বছর অ্যামেরিকায় রয়েছে। এখন ব্লুমফিল্ড, ন্যু জার্সিতে থাকে। একটা লালচে খয়েরি রঙের এস ইয়ু ভি গাড়ি চেপে আমরা আধ ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছে গেলাম বাড়ি। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এলাম। প্রথমবারে অনেক বেশি কৌতূহল, উৎসাহ ছিল। তখন সবকিছুই নতুন, গোগ্রাসে গিলছিলাম দৃশ্যগুলি। এইবারে এক সপ্তাহ রীতিমত চষে বেরিয়ে সব সয়ে গিয়েছিল। তখন বরং পিসির সাথে গল্প করতে ব্যস্ত। গাড়িতে হিন্দি বাংলা গান চলছে, আর সাথে আমাদের আড্ডা।
পিসির বাড়িটা দোতলা। একতলায় লিভিং রুম আর ওপেন কিচেন। দারুণ সুন্দর সাজিয়ে রাখা। বড় বড় কাঁচের জানলা। পিছনে ওই সরু একটা ক্যানাল মতো বয়ে যাচ্ছে। সবুজালি। নানান পাখি। দোতলায় দুটো বেদরুমের একটায় আমাদের লাগেজ রেখে হাত মুখ ঢুয়ে নিচে চলে এলাম। পছন্দসই ইয়া বড় অমলেট আর ক্রোসা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সাথে কফি। সাথে চলতে লাগল আমাদের পরের দুদিনের প্ল্যান প্রোগ্রাম। কোন কোন জায়গা দেখবো, কী কী শপিং করবো, সব। আর সব কিছুকে একোমোডেট করে একটা প্ল্যান বানানো, এরই মধ্যে মাথায় এলো, আরে রবিবার দুপুরে ফাইনাল রয়েছে। সেইটা কোনভাবেই মিস করা যাবেনা। যাই হোক, মোটামুটি ঠিক হল পরের দিন হপ অন হপ অফ নেবো ন্যু ইয়র্কে। যতটা সম্ভব ঘুরব। রবিবার সেন্ট্রাল পার্ক অঞ্চলে যাওয়ার কথা কাকার বাড়ি (পরে অবশ্য যাওয়া হয়নি),  সেই সময়ে ওইদিকটা ঘুরে নেবো। আর আজ বিকেলে যাবো শপিং করতে। এই প্ল্যানে পৌঁছতে প্রচুর অপটিমাইজেশন করতে হয়েছে। আর তার ফলে যেটা হল, ওই অত ব্রেকফাস্ট করেও খিদে পেয়ে গেল দেড়টার মধ্যে। ভাত আলু পটল ঝিঙে পোস্ত পমফ্রেটের ঝাল আর রুই মাছের পাতলা ঝোল দিয়ে লাঞ্চ সারলাম। আহ। কী শান্তি। ওয়াশিং মেশিনে ইতিমধ্যে ছাড়া জামাকাপড় দিয়ে রেখেছিলাম (পুরো নিজের বাড়ির মতো আচরণ করে গিয়েছি তিনদিন), লাঞ্চ সেরে সুজাতা ওগুলোকে ড্রায়ারে দিয়ে দিল। আমরা ভাতঘুম দিলাম যতক্ষণে, ততক্ষণ পিসি নিজের কাজকর্ম সেরে ফেলল।
বিকেল, বা বলা চলে সন্ধ্যেবেলা বেশ ভালো মতো রেস্ট টেস্ট নিয়ে বেরোলাম শপিং করতে। ক্লিফটন শপিং এরিয়াতে প্রচুর দোকান। বারলিংটন, টার্গেট, চার্মিং চার্লি ইত্যাদি ইত্যাদি দোকান ঘুরে ঘুরে প্রচুর কেনাকাটি করলাম। মূলত ওই দেওয়া থোয়ার জন্য। চকোলেট, পারফ্যুম, একটু জামাকাপড় ইত্যাদি। এতই ঘুরেছি, শেষে দোকান বন্ধ হওয়ার সময়ে এসে গিয়েছে, এদিকে আমাদের কেনা আর শেষ হয় না! বাড়ি ফিরলাম প্রায় দশটার পর। পাতলা মাটন কারি আর চিকেন কোফতা দিয়ে ভাত খেয়ে শুরু হল সেকেন্ড রাউন্ড আড্ডা। সুজাতার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল, ও ওপরে চলে গেল। আমি আর পিসি প্রায় রাত একটা দেড়টা অবধি সুখ দুঃখের গল্প চালালাম।
পরেরদিন সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে বেরোতে হবে। পিসি আমাদের টাইমস স্কোয়ার অবধি পৌঁছে দিয়ে আসবে। কী কী ঘোরাবে হপ অন হফে, দাম কত, সেইসবও দেখতে হবে।
ন্যু জার্সি থেকে ন্যু ইয়র্ক পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগল না গাড়িতে। পথে দূর থেকে ন্যু ইয়র্কের বিখ্যাত স্কাইলাইন দেখতে পেলেও ছবি তোলার অবকাশ ছিল না। গতকাল শপিং করতে যাওয়ার সময় সূর্যাস্ত হচ্ছিল। কমলা আকাশের ব্যাকড্রপে ছাই রঙা বিশাল বিশাল বাড়ি। বড় সুন্দর সে দৃশ্য। যথাসময়ে টাইমস স্কোয়ারে পৌঁছে আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। লোকজন পিলপিল করছে। রাস্তায় লোক উপচে পড়ছে। সে ভিড় শুধুই ট্যুরিস্টের। ন্যু ইয়র্ক অন্যতম পপ্যুলার অ্যামেরিকার, কাজেই এই ভিড় যে হবেই, বলাই বাহুল্য। এবং পদে পদে বিভিন্ন হপ অন হপ অফ কোম্পানির লোকজন হাতে ব্রোশার হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের কাছে বিভিন্ন ট্যুর প্যাকেজের লোভনীয় ও আকর্ষণীয় ডিলস। পিসির সাথে ফোনে কনসাল্ট করে আমরা সিটি ট্যুরসের একটা প্যাকেজ নিলাম। ম্যানহয়াটানের বিশিষ্ট জায়গাগুলি মূলত এতে আমরা ঘুরতে পারব। খানিক লাইনে থাকার পর একটা টুকটুকে লাল রঙের বাস এলো। টপাটপ বাসের ছাদে উঠে গেলাম। ইয়ারফোন দেওয়া রয়েছে, সামনে থেকে গাইড লাইভ কমেন্ট্রি করে যাবেন, শোনার জন্য। ইংরেজিতে শুনলে লাইভ, বাকি আরোবারোটি ভাষা যেমন স্প্যানিশ, চাইনিজ, ইত্যাদিতে শুনতে পাওয়া যাবে বোতাম টিপে, তবে অবশ্যই সেগুলি প্রি-রেকরডেড। হপ অন হপ অফের বৈশিষ্ট্য হল একটাই টিকিটে সারাদিনে জোতবার খুশি বাস থেকে ওঠা নামা করতে পারব। বিভিন্ন স্পটে ইচ্ছে হলে নামতে পারি, নয়ত না। নামলে হেঁটে ঘুরে আবার পরের বাসে উঠে অন্য জায়গায় যেতে পারি।
আমাদের প্ল্যান হল প্রথমে বাসে চক্কর কাটব। তারপর আবার যেখানে যেখানে ইচ্ছে হবে নামতে, সেখানে নেমে পড়ব। আসলে ভীষণ বেশি রোদ ছিল। বাড়াবাড়ি রকমের ঘোরাঘুরি করলে মাথা ধরে যাবে আমার, সেই জন্যই খুব রিস্ক নিতে চাইনি। হাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা মতো সময় ছিল।
টাইমস স্কোয়ারের মধ্যে দিয়ে বাস চলতে লাগল। রাস্তার দুইধারে বিশাল বিশাল বাড়ি এবং তার ওপর নানান বিজ্ঞাপনের বোর্ড। ভীষণই রঙিন। আর লোকের ভিড়। এটাই দেখার। সন্ধ্যেবেলা বিজ্ঞাপনের আলো ঝলমল আলাদা সৌন্দর্য আনে। ফেরার পথে সেটাও দেখেছিলাম সেদিন। গাইড তো পরপর বলেই যাচ্ছেন কিছু না কিছু। কিছু কথা শুনছি, কিছু শুনছি না। একটা কথা যেটা কানে এলো, ন্যু ইয়র্কের সাথে বম্বে আর সাংঘাইয়ের তুলনা করলেন। এই টিনটি শহর নাকি ভীষণভাবে একইরকম, তিনটিই নিজের দেশের ফিন্যান্স ক্যাপিটাল। বম্বে গিয়েছি, বলতে পারি যে হ্যাঁ, খুব ভুল বলেননি। রাস্তায় বড্ড ট্র্যাফিক জ্যাম। ভর্তি গাড়ি। আর বিখ্যাত হলুদ ট্যাক্সি। এই ট্যাক্সিচালকদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় বা পাকিস্তানি বা বাংলাদেশ। বাস চলতে চলতে আমরা ডানদিকে দেখলাম বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন। এটি অত্যন্ত বিখ্যাত ইন্ডোর এরিনা। প্রচুর কন্সার্ট এবং স্পোর্টিং ইভেন্ট হয়েছে, হয়। তারপর পড়ল পোস্ট অফিস। কী বিশাল। আমাদের জি পি ও গোছেরই। সেখানে মোট লেখা, ঝড় জল হলেও ডাক ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাবে। ধবধবে সাদা বিরাট জায়গা জুড়ে কলোনিয়াল আর্কিটেকচার। বাঁ দিকে তারপর পড়ল মেসিস ব্র্যান্ডের সবচেয়ে বড় বিল্ডিং। পৃথিবীর অন্যতম বড় রিটেল আউটলেট, অনেক অনেক তলা, অনেক অনেক স্কয়ের ফিট জুড়ে এই দোকান। পয়সা নেই। সময় নেই। নামলাম না। এরপর পৌঁছলাম এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। একটি পোল অনুযায়ী এইটি অ্যামেরিকার সবচেয়ে প্রিয় স্থাপত্য। ১০৩ তলা এই বিল্ডিঙের ওপরে একটি অবসারভেটরি রয়েছে। তবে প্রচুর দাম এবং ভীষণ ভিড়। সেই জন্য এইটিও বাইরে থেকেই দেখে নিলাম। সন্ধ্যের সময়ে দুর্দান্ত আলোকসজ্জা এটিকে অন্যতম দর্শনীয় করে তোলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই ভিউ পাইনি। এরপর বাইরে থেকে দেখলাম ফ্ল্যাটিরন বিল্ডিং। চ্যাপ্টা, তিনকোণা উঁচু বাড়ি। দেখার মতোই, তবে ওই বিস্ময় ভরে, বাইরে থেকেই। এরপরে পথে পড়ল ইউনিয়ন স্কোয়ের। পার্ক মতো। প্রচুর দোকান বাজার। ভিড়। জর্জ ওয়াশিংটনের ঘোড়ায় চাপা বিখ্যাত স্ট্যাচ্যু রয়েছে। বাসের ওপর থেকেই দেখলাম। বাস ওই ভিড় রাস্তা ঠেলে এগোতে লাগল। চায়না টাউন আর লিটিল ইটালি পড়ে এর পরেই। ক্যানাল স্ট্রিটের স্টপে নেমে গেলাম। ততক্ষণে আসলে লাঞ্চ করার সময় হয়েছে, খিদেও পেয়েছে। সামনেই ছিল একটা ম্যাক ডনাল্ড। যদিও দেশে এক দুইবার খেয়েছি, তবুও অ্যামেরিকায় এসে ম্যাক ডি খাবো না, কেমন একটা লাগছিল। তাই গেলাম। এক ডলারে চারটে চিকেন স্ট্রিপ ফ্রাইজ আর আরো সোয়া এক ডলারে একটা বিশাল গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্ক পেলাম। সেইসব খেয়ে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। পথে পড়ল বিখ্যাত "আই লাভ ন্যু ইয়র্ক" চেইনের একটা দোকান। বাংলাদেশি মালিক, তাই অনেক কর্মচারীই বাংলায় কথা বলছিলেন। বেশ ভালো লাগল। স্যুভেনির কিনলাম। হাঁটার পথে ওয়াল স্ট্রিট পড়েছিল। ন্যু ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জের বিখ্যাত বুল দেখলাম। এত ভিড়, বাবা রে। অনেক কশতে পোজ দিয়ে ছবি তুললাম। খাবার হজম হয়ে যেতে চায়না টাউনের দিকে হাঁটা লাগালাম। চারিদিকে চাইনিজ ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড, বস্টনেরটার চেয়ে বড়।  নিউ ইয়র্কে একাধিক চায়না টাউন রয়েছে। আমরা যেটায় ঘুরলাম, মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বিভিন্ন নাম না জানা মাছ আর শাক সবজির স্টল রাস্তা জুড়ে। জামাকাপড়ের দোকান, জুতোর দোকান। আমরা সবই দেখতে দেখতেঅনেক খুঁজে একটাঠিকঠাক দেখতে রেস্টুরেন্টে গেলাম। চারটে বাজল খাওয়া শেষ করতে। খেলাম আমাদের দুজনেরই পছন্দের ডামপ্লিং আর নুডলস।
ইতিমধ্যে বুচু পিসি জানিয়ে দিয়েছে যে ছটা, সাতটা আর পৌনে আটটায় তিনটে বাস আছে ন্যু জার্সি যাওয়ার। আমরা তাতে উঠলে আমাদের বাস স্টপ থেকে পিক-আপ করে নেবে। তাই আমাদের একটু সময় বুঝে এবারে চলতে হবে। হেঁটে পৌঁছলাম ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেনটার। ৯/১১ এর পড়ে গ্রাউন্ড জিরোতে একটা মেমোরিয়াল বানানো। আগে যেখানে WTC ছিল, সেখানে বিশাল খালি জায়গায় জল পড়ছে সমানে। আর সেটা বাঁধানো কালো পাথরে। সেই পাথরে ওই ভয়ানক দুঃখের দিনে প্রাণ হারিয়েছেন যতজন, প্রত্যেকের নাম লেখা। খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল দেখে। কত দেশের কত ধরমের কত মানুষ। একটা নাম দেখে নাড়া খেয়েছিলাম। "unborn child"।
সেদিন এরপরে আমরা হপ অন বাসে উঠে পড়লাম। ভিড়ের ঠ্যালায় আর কোন কারণে কে জানে, বাসটা আর কোথাও থামছিল না। এদিকে আমাদের যেতে হবে সেই পোর্ট অথরিটি বাস টারমিনাসে। ঘড়ির কাঁটা দৌড়চ্ছে। সাথে আমাদের টেনশন। প্রথম দুটো বাস তো মিস করলাম। শেষটা যেন না করি। টেনশনের চোটে ইউনাইটেড নেশন্স বিল্ডিং বা ট্রাম্প টাওয়ার দেখেও কোন হেলদেল হলোনা। ছবি তুললাম বটে, তবে ওই। এমন কী রকাফেলার প্লাজা এসেও হেলদোল নেই। বরং তখন দৌড়ে দৌড়ে ক্যাবে উঠে বাস স্ট্যান্ড এলাম। সন্ধ্যের টাইমস স্কোয়ের দেখলাম। আলোয় সজ্জিত। ভালোই লাগল, তাও কেমন তখন প্রাণ আনচান। হাঁপাতে হাঁপাতে এঁকে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে বাস টারমিনাসে এলাম। আবার ছুট ছুট। ঠিক ঠিক গেটের সামনে গেলাম। লম্বা লাইন। বাসটা ছাড়ল দেরিতে। আলো কমে আসছে। কাউন্টারে টাকা (ও, টাকা তো না। ডলার) দিয়ে টিকিট কেটে রেখেছিলাম, ড্রাইভারকে বললাম আমাদের ঠিক স্টপেজে নামাতে।

Wednesday, August 15, 2018

আম্রিকা দর্শন পর্ব ১১

বাস থেকে তো নেমে পড়েছি। বাসও ফেরত চলে গিয়েছে। সামনে একটা হোটেল। চারিদিকে প্রায় জনমানবহীন কেমন গণ্ডগ্রাম গোছের জায়গা। কিছু ট্যুরিস্ট এদিক ওদিক দেখছি। কিন্তু এবার? হোটেলটির নিচে দেখলাম একটা রেস্টুরেন্ট কাম বার। নাম বলিউড লাউঞ্জ। বিজ্ঞাপন দেওয়া, পনেরো ডলারে আনলিমিটেড ভারতীয় লাঞ্চ ও ডিনার। সে তো না হয় বুঝলাম। কিন্তু ব্রেকফাস্ট? এখানে কী কিছু পাব? মালপত্র নিয়ে কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকলাম। দেখলাম কিছু লোকজন বসে খাচ্ছে। জানালর ধারে একটা টেবিলে আমাদের জিনিসপত্র রেখে কাউন্টারে গেলাম। জানতে পারলাম, ব্রেকফাস্টও আনলিমিটেড, এবং দাম সেই পনেরো ডলার। কিছু করার নেই। ওই খেতে হবে। সুজাতা কার্ডে পে করে দিল। আমরা খাবার লাইনে গেলাম। প্লাস্টিকের ডিস্পোজেবল প্লেট ও কাটলারি। সারি দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন খাবারের আইটেম। ব্রেড, অমলেট, হ্যাম, সসেজ, বেকন, পটেটো ফ্রাইজ, কর্ণ ফ্লেক্স, ম্যুস্লি, দুধ, চা, কফি, জুস ইত্যাদি। মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতা (নাকি গরীব পি এইচ ডি স্কলারের মানসিকতা, কে জানে?)। দুজনেই ঠিক করলাম, প্রচুর খাব। পারলে যাতে লাঞ্চ না করতে হয়, বা হলেও অল্পের ওপর দিয়ে যায়। দুই তিন রাউন্ড খেলাম। আমার হ্যাম জিনিসটা খুব পছন্দ হয়েছিল। বেকন স্ট্রিপ্স ভালো লাগেনি। বড্ড বেশি নুন। এই প্রসঙ্গে একটা খুব মজার ঘটনা বলি। যখন দেখলাম হ্যাম নিয়ে এসেছে বেশ গরম গরম ভেজে টেজে, আমি তো তখনও জানিনা ওটা কী। বেশ তেল চপচপ করছে। দুর থেকে দারুণ চকচকে। ইন্ডিয়ান দোকান। ভাবলাম , আহা, রসে চোবানো গোল গোল মালপোয়া মনে হয়। ব্যস, জমে যাবে। যে মেয়েটি খাবারটা ঢালছিল, ওকে বললাম (বেশ কনফিডেন্টলি), "এক্সকিউজ মি, ইস দ্যাট মালপুয়া?" মেয়েটি খানিকক্ষণ আমার দিকে "এ কোথাকার কোন গাধা এসেছে, কিছুই জানেনা" লুক দিয়ে বলল যে না, ওইটি হ্যাম। শূকরের মাংস। আমার মধ্যেকার ভানু ব্যানারজী প্রচন্ডভাবে দুঃখ পেয়ে মাংসে মন দিল। দ্বিতীয় রাউন্ড খেতে খেতে আমাদের এয়ারবিএনবি হোস্টকে ফোন করা হল। সে বলল যে না, এখন তো চেক-ইন করা যাবেনা। আগেরদিনের গেস্টের এগারোটায় চেক-আউট। আবার ফোন করা হল জানতে যে লাগেজ ড্রপ করতে পারি কি না। বলল, হ্যাঁ, বেশ, তা করতে পারি। আমরা খাওয়ারের পাট চুকিয়ে ক্যাব ডেকে সাড়ে নটার পর পৌঁছলাম এয়ারবিএনবিতে। অরচারড পার্কওয়ে নাম জায়গাটার। ভীষণ সুন্দর গাছপালায় ভর্তি। রাস্তার দুই দিকেই লম্বা গাছ। বাড়িগুলো মোটামুটি একই প্যাটার্নের। দোতলা। ইন্সট্রাকশান অনুযায়ী আমরা তালা খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম। চারিদিকে নোটিস লাগান। এদিকে যাবেনা, ওদিকে না। ইত্যাদি। একতলাতে একটা লিভিং রুম, কিচেন আর তিনটে বেডরুম আর স্টাডি। একটা বেডরুমে আমাদের থাকার ব্যবস্থা। সানফ্লাওার রুম লেখা। ছবি দেখেছিলাম ওয়েবসাইটে। দেখলাম কোন গেস্ট নেই। যিনি হোস্ট, ক্রিস্টিন, ওর ঘর বন্ধ। নক করার ইচ্ছে হল না। ঘুমোচ্ছে কি কে জানে। ইতিমধ্যে ওর তিনটে পোষা বিড়ালের দেখা পেলাম, দুটো বড়, লোমশ, সাদা কালো। অসম্ভব মিষ্টি তুলোর বলের মতো। আরেকটা ছোট্ট। দুটো আমাদের সাথে খেলল। সুজাতা আর আমি দুজনেই বিড়াল কুকুর ভীষণ ভালোবাসি। সুজাতার সিএটলে একটা বিড়াল আছেও। আমদের বেশ সময় কাটছিল। তবে এত ক্লান্ত ছিলাম, কখন কে জানে খেলতে খেলতে কার্পেটের ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছি!
এগারোটার পর ক্রিস্টিন আমাদের ঘর রেডি করে দিল। খুব বেশি কথা বলেনা, তবে বিড়াল ভালোবাসি বলে একটু খুশি হল দেখলাম। স্নান টান সেরে বেরোলাম প্রায় বারোটার পর। ক্যাব নিয়ে নায়াগ্রা স্টেট পার্ক।

অবশেষে। টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে এগোলাম। একদিকে দেখলাম সাইনবোর্ড লেখা। ক্যানাডা যাওয়ার রাস্তা। ওইখানেই ইমিগ্রেশনের অফিস রয়েছে দেখলাম। নায়াগ্রা ফলসের এদিকে অ্যামেরিকার নিউ ইয়র্ক স্টেট আর ওইদিকে ক্যানাডার অন্টারিও। যাদের দুই দেশের ভিসা/পাসপোর্ট আছে, তারা সহজেই রেনবো ব্রিজ টপকে এদিক ওদিক করতে পারে। আমাদের ইচ্ছে ছিল নায়াগ্রা সিনিক ট্রলি বলে একধরনের ওই টয় ট্রেন গোছের ট্রেনে ওঠার। সবুজ রঙের, মাঝে হদুদ বর্ডার। তিন ডলারের বিনিময়ে সারাদিনে যতবার খুশি ওঠা নামা করা যায়। মোটামুটি গোটা পার্ক ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু সকাল সকাল প্ল্যান পরিবর্তন হওয়ায় সেটা আর সম্ভব হল না। নায়াগ্রার মূল আকর্ষণ, মেইড অফ দি মিস্ট রাইডটা নিতেই হবে। পার্ক না হয় পরে ঘুরে নেওয়া যাবে যতটা সম্ভব। হাঁটা লাগালাম ডিরেকশন দেখে। একটু এগোতেই দূর থেকে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত নায়াগ্রার দর্শনও পেলাম। বিশাল জলরাশির খানিকটা হলেও তো দেখলাম। আহ। যাক।

মেইড অফ দি মিস্ট হল একটি বোট রাইড। ফলসের সামনে দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। নায়াগ্রা ফলসের ওই বিশাল উচ্চতা (পঞ্চাশ মিটার) ও অত চওড়া জলপ্রপাতের সামনে সারাক্ষণই একটা কুয়াশার মতো থাকে। সেটা কিছুই না। ওই জলের কণাগুলিই পড়ে আবার উঠে ভাসে। সেই জন্যই ওই "মিস্ট"। এবং স্বাভাবিকভাবেই যখন বোটটি সামনে দিয়ে যায়, জামাকাপড় ভিজে যাবেই। তাই মেইড অফ দি মিস্টের টিকিট কাটার সময়ই তার সাথে দাম ধার্য করে নেওয়া হয় ওয়াটারপ্রুফ জামার। কিছুই না। নীল রঙের প্লাস্টিকের রেইনকোট গোছের। প্রায় কুড়ি ডলারের কাছাকাছি টিকিটের দাম। হয়ত অনেক, তবুও কিছু কিছু জিনিস হাতছাড়া করা যায় না, উচিতও না। আমরা টিকিট কেটে লাইন দিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম বোটে। নামেই বোট, আসলে বিশাল স্টিমার গোছের। পিলপিল করছে লোক। অ্যামেরিকার সাইড থেকে এই ক্রুজটাকে বলে মেইড অফ মিস্ট, আর ক্যানাডার দিকে যেটা হয়, সেটা হরনব্লোয়ার ক্রুজ। ওইদিকের ওয়াটারপ্রুফের রঙ লাল। একেকটা স্টিমারে বেশ কয়েকশো লোক এঁটে যায়। মিনিট কুড়ির রাইড। গাইডের কথা প্রায় শোনাই যায়না লোকের আহা উহুতে। তবে দরকারও নেই। ফলসের ইতিহাস পড়ার জন্য বা জানার জন্য উইকিপিডিয়া রয়েছে। রয়েছে হাজার হাজার বই। কিন্তু ওই যে চাক্ষুস দেখা, অনুভব করা। ওই অভিজ্ঞতা অবর্ণনীয়। গায়ে সমানে জলের ফোঁটা ছিটকে আসছে। ক্যামেরাটাকে কোনমতে বাঁচাচ্ছি প্লাস্টিকে মুরে। ফোন দিয়ে খানিক ছবি তোলা। তারপর ভাবা, ধুর, ক্যামেরা গেলে যাবে। পরে দেখা যাবে। ছবি তো তুলি।
অ্যামেরিকান ফলস, ব্রাইডাল ভেল আর হর্স শু ফলস। এই তিনটি নিয়ে নায়াগ্রা। এই তিনটের মিলিত জলরাশি উত্তর অ্যামেরিকার সর্ব বৃহৎ। হর্স শু ফলসটা অ্যামেরিকা ওর ক্যানাডার বর্ডারে। ব্রাইডাল ভেল আর অ্যামেরিকান ফলস অ্যামেরিকার সাইডে। ব্রাইডাল ফলসটা অ্যামেরিকান ফসলের পাশেই, সরু। আর হর্সশুটা আরো চওড়া। যখন বোট সামনে দিয়ে যাচ্ছিল জলপ্রপাতের, সামনে একটা সাদা জলের বিরাট দেওয়াল রয়েছে মনে হচ্ছিল। ক্রমাগত ওই উচ্চতা থেকে আছড়ে পড়ছে বিরাট জলপ্রপাত। সাদা জল, মাঝে মাঝে নীলচে সবুজ, তার ওপর রোদের ঝিকমিক। স্বর্গীয় অনুভূতি। অপূর্ব। অসামান্য। আরো পঁচিশ ডলার জনপ্রতি খরচ করলে আরেকটা রাইড নেওয়া যায়, কেভ অফ দি উইন্ড। সেটা এক্কেবারে ফলসের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের অতটা অ্যাডভেঞ্চারের সাহস ছিল না। মেইড অফ দি মিস্ট করে আমরা পার্কে ফেরত এলাম। তখনও একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছই। কী দেখলাম, কী অসামান্য, ভয়ঙ্কর সুন্দর। এসব কোন কিছু দিয়েই বোঝানো যাবে না আমাদের সেই মুহূর্তের অনুভূতি। মাঝে রাস্তায় ভিউ পয়েন্ট থেকে বাড়িতে ও বন্ধুদের ফোনকরে লাইভ ফলস দেখালাম। ছবি তোলা পর্ব চলল। খানিকক্ষণ তারপর পার্কের ঘাসে গা এলিয়ে ফলস দেখতে দেখতে রেস্ট নিলাম। অল্প খিদে পাচ্ছিল। ফুড স্টলগুলি থেকে আমি হ্যামবার্গার আর সুজাতা চিকেন বার্গার খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে (ম্যাপ দেখে) এয়ারবিএনবিতে ফিরলাম। গোটা অঞ্চলে সেরকমভাবে দোকান বাজার কিছু তেমন নেই, তবে যেটুকু যা দেখলাম, বেশিরভাগই ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট, ইন্ডিয়ান স্টোর, ইত্যাদি। হয়ত প্রচুর ভারতীয় ট্যুরিস্টের যাতায়াত বলে।
বিকেলে লাগেজপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য ফলসের ইলুমিনেটেড চেহারা দেখব। রাত্তির সাড়ে দশটায় বাস। আমরা সাড়ে সাতটার মধ্যে স্টেট পার্কে পৌঁছে গেলাম। সাথে মালপত্র আছে বলে উঁচুতে ভিউ পয়েন্টে উঠলাম না। একটু নিচের দিকে অথচ ফলসকে সুন্দর দেখা যাবে এমন জায়গায় রইলাম অপেক্ষায়। পৌনে নটায় ইলুমিনেশন শুরু হওয়ার কথা। ক্যানাডা আর অ্যামেরিকা, দুই দিক থেকেই ফলসের গায়ে নানান রঙের ফ্লাডলাইট দিয়ে আলো ফেলার ফলে অপূর্ব সিনিক ভিউ হয়। ছবি দেখেছিলাম অনেক। তবে ওই যে আগের এক পর্বে বলেছিলাম, নটার আগে অন্ধকার হয় না। তাই একটু সন্দিগ্ধ ছিলাম। দেখতে পাব তো? মধুরিমা তো বারবার বলেছিল, চান্স খুব কম। পৌনে নটা বাজতে আলো ফেলা শুরু হল। কিন্তু বাইরে তখনও হাল্কা দিনের আলো। তাই তেমনভাবে বোঝা যাচ্ছিল না। সাদার ওপর হাল্কা গোলাপি আভা। আলো আলোর মতো পড়তে লাগল। বর্ডারের ওপারে ক্যানাডার শহরে বাড়িগুলো রাস্তাঘাট বরং বেশি আলো ঝলমলে লাগছিল। জুম লেন্স দিয়ে দেখছিলাম। যেন হাতের মুঠোয় ক্যানাডা। ঠিক নটার একটু পরেই ঝুপ করেই অন্ধকার নামল। তারপর প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দেখলাম রঙের খেলা। লাল নীল বেগুনি গোলাপি কমলা হলুদ। সে যে কী অপূর্ব রঙের ছটা। অসাধারণ ভিউ। ইচ্ছেই করছিল না ওখান থেকে সরে আসতে। এদিকে বাসের জন্য আসতেই হবে। ডিনারও কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এই অবিশ্বাস্য সুন্দর নায়াগ্রাকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেছি সবে, শব্দ পেলাম বাজি ফাটার। তার মানে এই এখন শুরু হল ফলসে ফায়ারওয়ার্কস। দশটার পর থেকে রাত দুটো অবধি টানা চলে। আমাদের কপাল খারাপ। মিস করলাম সেই দৃশ্য। থাক, সব পেলে তো আর আবার ফিরবার টান থাকবেনা, তাই না? না হয় পরের বার এই দৃশ্য দেখবো। একটা ইন্ডিয়ান ফুড ট্রাক থেকে ল্যাম্ব আর চিকেন রোল দিয়ে আমাদের ডিনার হল। সাত ডলার করে জনপ্রতি। এইবারে আমাদের ট্রেলওয়েজের বাস। অনেক বেশি ভালো গ্রেহাউন্ডের চেয়ে। বেশি লেগ স্পেস, কেবিন সুন্দর। মসৃণ। এইবারে আর ভুল নেই। বাসের পেটে সুটকেস। আমরা ভিতরে। পৌঁছলাম বাফেলো। আবার রাত সাড়ে বারোটায় পরের বাস। ন্যু জার্সি যাওয়ার। সেটিও ট্রেলওয়েজের। এই বাসের ড্রাইভার আমাদের সকালের জন। আমাদের দেখে চিনতে পেরে খুব খুশি। আমরাও চেনা মানুষ দেখে নিশ্চিন্ত। বাফেলোর বাস স্ট্যান্ডে সেই ভারতীয় ছেলেটিকেও দেখেছিলাম। ও ফিরে গেল বস্টন। বাস ছুটল গভীর রাতে নর্থ ইস্ট অ্যামেরিকার হাইওয়ে দিয়ে। পথে পড়ল সেরাক্যুজ, আল্বানি। হল্টগুলিতে নামলাম। নামলাম না। একদম ভোরের আলো ফুটতে পৌঁছলাম ন্যু ইয়র্ক। পোর্ট অথরিটির বাস টারমিনাস। বিশাল বাড়ি। সাতশো গেট। একেকটা গেট দিয়ে একেকটা জায়গার বাস। একেক কোম্পানির। ঘুম চোখে কোনমতে ঠিকঠাক গেটে গিয়ে ন্যু জার্সির বাস ধরলাম। পিসিকে জানিয়ে দিলাম। নেওয়ার্ক বাস স্টেশনে নামবো। সেখানে পিসি এসে আমাদের পিক-আপ করবে। এখান থেকে এবার পিসির জিম্মায়।

Tuesday, August 14, 2018

আম্রিকা দর্শন পর্ব ১০

সামারে বাড়ি গিয়েছিলাম, এক সপ্তাহর জন্য। বেশ হেলতে দুলতেই কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই ফেরার দিন তিনেক আগে আমায় বাবা আর জেঠু এক সান্ধ্য চায়ের আসরে (মনে আছে, সাথে মায়ের গরম গরম ফিস চপ ছিল) জিজ্ঞেস করে, "হ্যাঁ রে। তোর গোটা ট্রিপের মোট কটা ডিটেল্ড প্ল্যান বল তো? একটু ঝালিয়ে নে।" ব্যস। শেষ। আমি তোতলে থতকে একাকার। জেরায় জেরায় জেরবার। ওদের নিদান এলো, এ মেয়েকে যে ছাড়া বেশ রিস্কি। সঙ্গে সঙ্গে গল্পের বই (শরদিন্দু অমনিবাস পঞ্চম খণ্ড রিভাইজ করছিলাম তখন) কেড়ে নেওয়া হল। রেডিও বন্ধ করে দিল। হাতের কাছে একটা ছোট্ট রাইটিং প্যাড আর একটা কলম এলো। আদেশ। আগামী দুইদিনের মধ্যে পুরো প্ল্যান চাই। সলিড প্ল্যান। অগত্যা, ট্রিপঅ্যাডভাইসরের সাহায্য। আমট্র্যাকের ওয়েবসাইট। গ্রেহাউন্ডের সাইট। নানান এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার, লগ সিরিজ ই সিরিজ পারম্যুটেশন কম্বিনেশন করে প্ল্যান করলাম। সেই প্ল্যানের তেমন ভাবে কিছুই বস্টনে কাজ করেনি ঠিকই, তবে স্কেলিটনটা বজায় ছিল। অন্তত জানি এই দিন অমুক সময় তমুক জায়গা থেকে বাস ধরতে হবে। অগত্যা টিকিট কাটা জরুরি। সেই মতো সুজাতা গ্রেহাউন্ডের টিকিট কেটে রেখেছিল বস্টন থেকে নায়াগ্রা। ও যখন পি ডি এফে টিকিটটা আমায় মেল করে, আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। বলে কী। আট পাতা দুজনের টিকিট। এবং যা বুঝলাম দেখেশুনে, আমাদের চারটে চেঞ্জের ব্যাপার আছে। বস্টন থেকে আল্বানি, তারপর সেরাক্যুজ, বাফেলো আর সব শেষে নায়াগ্রা। গ্রেহাউন্ড সম্পর্কে ধারণা বলতে আত্মপ্রকাশেই রোশনিদির পুরনো লেখা আর আরো আগে পড়া নবনীতা দেব সেনের কিছু লেখাপত্তর। প্রচুর ইন্টারনেট ঘেঁটে টেটেও কিছুই বুঝলাম না কী হবে না হবে, ভগবানের হাতে আর বাকিটা যা হবে দেখা যাবে গোছের হাবভাব নিয়ে বেরোলাম।
গ্রেহাউন্ডে সিট নম্বর দেয়না। লাইন করে উঠতে হবে বাসে। তারপর যে যেমন পারো, জায়গা নিয়ে বসো। সাড়ে সাতটায় বাস ছিল। আমরা পৌনে সাতটার মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বাস স্টেশনে। বিশাল বাড়ি, প্রচুর কাউন্টার। বহু বাস কোম্পানি, তাদের কাউন্টার। কিছু দোকানপাট। আর একগাদা সাইনবোর্ড। নিজের গন্তব্য খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হওয়ার কথা না। বোর্ড দেখেশুনে আমরা পৌঁছলাম গ্রেহাউন্ডের নির্দিষ্ট গেটে। একদম এয়ারপোর্ট গেটের মতোই ব্যবস্থা। লাইন করে থাকো, সময় হলে একজন টিকিট পরীক্ষা করে গেট খুলে দেবেন, বাসে উঠে পড়ো। মধুরিমার কাছে শুনেছিলাম ওর গ্রেহাউন্ডে খুব একটা ভালো অভিজ্ঞতা না। মানে সহযাত্রীরা অনেক সময়েই খুব পছন্দসই হয়না। কিছু করার নেই। আমাদের ট্যাঁকের কন্সট্রেইন্ট ছিল। আর সময়েরও। তাই যা হোক, এতেই যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। আমাদের লাইনে পিছনদিকেই একটি ভারতীয় ছেলেকেও দেখলাম। হিন্দিতে কারুর সাথে কথা বলছিল, নিজের প্ল্যান জানাচ্ছিল। বুঝলাম কোন কারণে কলেজ ছুটি, তাই একদিনে নায়াগ্রা ঘুরে আসবে। আমাদের মতই। কেন জানিনা, ওই বিদেশ বিভূঁইয়ে স্বদেশের একজন আরো আছে ভেবেই আশ্বস্ত লাগল।
যদিও টিকিটে পরিষ্কার লেখা ছিল আধ ঘণ্টা আগে বোর্ডিং হবে, তাও প্রায় সাতটা কুড়ির পর তবেই চালু হল। টিকিট কাটার সময় যদিও দেখেছিলাম লাগেজ রেস্ট্রিকশনের ব্যাপারে, সুজাতা দেখেছিল অ্যাডিশানাল লাগেজের জন্য পনেরো (নাকি পঁচিশ) ডলার বাড়তি চার্জ। আমাদের ধারণা ছিল আমাদের ব্যাগ স্যুটকেস ছোটর দিকেই, কাজেইবাসের কেবিনে এঁটে যাবে। আর বাসের পেটের ভিতরে লোকজন ব্যাগ রাখছে মানেই নির্ঘাত ওটার জন্য ওই এক্সট্রা খরচ। এইসব ভেবে টেবে তো মালপত্র নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম। দ্বিতীয় রোতে বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু এইবারে বাঁধ সাধল লাগেজ। ওভারহেড কেবিন যে এতটুকু হতে পারে, এক্কেবারে কল্পনাতীত। এবং সবচেয়ে খারাপ, ইলাস্টিকের যেই পারটিশান করা, সেটিও যারপরনাই লুজ। যার ফলে পিঠের ব্যাকপ্যাকটুকুও আঁটছেনা। ওই ভারতীয় ছেলেটি আমাদের স্ট্রাগল করতে দেখে এগিয়ে এলো সাহায্য করতে। সুজাতা আর আমি দুজনেই প্রায় সমান হাইটের তো, দুজনেরই এক অবস্থা। কোনমতে সিটের সামনে ওর স্ট্রলিটা রাখার পর তার উপরে আমারটা রাখলে আর বসার জায়গা নেই। কেলেঙ্কারি কাণ্ড। এদিকে পরপর লোক উঠছে বাসে। আইল ব্লক করে রাখাও যাচ্ছেনা। আমরা ভাবলাম বেশ, সবাই থিতু হোক, তারপর দেখা যাবে কী করা যায়। সেই ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিককে জায়গা দিতে আমি সামনের সিটে বসলাম। আমার গলায় তখনও পরম মূল্যবান স্লিং ব্যাগটি ঝুলছে। এক বেশ ভারি চেহারার ভদ্রমহিলা তখন পিছনদিকে যাচ্ছিলেন। এমন হ্যাঁচকা একখানা টান মারলেন যেতে গিয়ে, আমার গলা থেকে ব্যাগটি ছিঁড়ে পড়ে গেল। ল্যাজে গোবরে অবস্থা যাকে বলে তখন। এক তো মালপত্র নিয়ে টেনশন, তার উপর এই ব্যাগটি গেল। এবার কী হবে। ইতিমধ্যে বাসের ড্রাইভার উঠে সব দেখে টেখে এক বিদঘুটে অ্যাক্সেন্টে বলে গেলেন। কেবিনে না আঁটলে, বাসের পেটের ভিতর দিতে হবে। রাস্তা ব্লক করা চলবে না। যেহেতু সুজাতা জানলার ধারের সিটে রীতিমত ট্র্যাপড, আমিই সাহস টাহস করে নামলাম। সাহস বললাম এই জন্য যে ইংরেজিতে মন্দ না হলেও এই দেশের বিভিন্ন মানুষের অ্যাক্সেন্টে একটু সমস্যা হচ্ছিল। তাই মুখচোরা মোড অন ছিল আমার। যে মহিলা লাগেজ হ্যান্ডল করছিলেন, তাকে বললাম। আমাদের দুটো সুইটকেস ভরতে হবে। উনি যে কী বুঝলেন বললেন, কিছুই বুঝলাম না। অদ্ভুত মুখ করে তাকিয়ে রইলাম দুজনেই। কথাবার্তা কোনভাবেই এগোচ্ছেনা দেখে আমার স্ট্রলিটা নিয়ে নামলাম। দেখাই যাক কী হয়। দেখলাম বেশ কিছু না বলেই দিব্যি নিয়ে নিলেন। তখন সাহস বেড়ে গিয়েছে। সুজাতারটাও নিয়ে সাবধানে বাসের পেটের ভিতর চালান করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলাম বাসে। উফ। এইটা যে করা যায়, জানলে আগেই করতাম। এইসব ফালতু ঝামেলা হত না। মাঝখান থেকে আমার ব্যাগটা গেল। কপালে থাকলে যা হয় আর কী। মধুরিমার কোথায়, ফাঁড়াটা ব্যাগের ওপর দিয়ে কেটে গেল!
ড্রাইভার এরপর উঠে সবাইকে বাসে স্বাগত জানালেন এবং রুট ম্যাপ বললেন। এও বললেন যে চারটে হল্ট আছে। যা বুঝলাম আল্বানি বা সেরাক্যুজে আমাদের বাস পাল্টাতে হবেনা। এক্কেবারে বাফেলোতে গিয়ে যা হওয়ার। বেশ। বাফেলো পৌঁছতে ভোরবেলা। রাতটা ঘুমনো যাবে। যেহেতু নাইট জার্নি, বাসের ভিতরটা অন্ধকার রইল। এবং সকলে চুপচাপ থাকার নির্দেশ দিলেন।  বাড়িতে জানিয়ে দিলাম আপডেট। বাস চলতে শুরু করলো বস্টন শহরের মধ্যে দিয়ে। তখনও বাইরে আলো হাল্কা।
আল্বানি পৌঁছলাম পৌনে বারোটার দিকে। আধ ঘণ্টার হল্ট। বাস স্টেশনটি ছোট। ওয়াশরুম ব্যবহারযোগ্য। খিদেও পেয়ে গিয়েছিল আমার। পাঁচ ডলার দিয়ে ভেন্ডিং মেশিন থেকে (ক্রেডিট কার্ডে!) চিকেন বার্গার নিলাম। একটা কথা এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো। চীজ বার্গার মানে কিন্তু শুধু চীজ না। অবধারিতভাবে বীফ আছে ওতে। বার্গার খেয়ে সাময়িক স্বস্তি। যদিও সাথে বিস্কুট, সেই চীজকেক, ফল সবই আছে, তাও কেন জানিনা জার্নি করার সময়ে বেশিই কিনে কিনে খেতে ইচ্ছে করে।সেশ্মেশ কিন্তু ওই সাথের খাবারগুলো বাফেলো পৌঁছনর আগেই ট্র্যাশ করেছিলাম। বাসের মধ্যে বেশ বেশ ঠাণ্ডা। ব্যাকপ্যাকের মধ্যে মায়ের কুলু শালটা ছিল। ওটা সুজাতাকে দিলাম। আমি সুইটকেস থেকে wind cheater আর মাফলার বের করে বেশ চাপাচুপি দিয়ে বসলাম। উত্তর পচিম অ্যামেরিকার রাস্তা দিয়ে গভীর অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বাস চলতে লাগল। সেরাক্যুজে নামিনি। লোক উঠছে নামছে। বস্টন থেকেই এক মাতাল লোক উঠেছিল বাসে। ভাগ্যিস আল্বানিতেই নেমে গেল।
বাফেলো পৌঁছলাম সক্কাল  পৌনে ছটার দিকে। এখানে আমাদের বাস পালটাবে। এরপর দেবে ট্রেলওয়েজের বাস। কিন্তু সেটা এক ঘণ্টা পর। ততক্ষণে দুজনেই ওভারনাইট জার্নি করে বিধ্বস্ত। বাবার সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, ফেরার বাস টিকিট কাটিনি তো। ওটা অনলাইন ছিল না। গ্রেহাউন্ডের কাউন্টারে আবার সেই টিকিট কাটা হল। টাইমিং প্ল্যান করা ছিল। নায়াগ্রা থেকে বাফেলো একটা বাসে, তারপর বাফেলো থেকে ন্যু জার্সি। আমাদের নায়াগ্রা যাওয়ার বাসটি পেলাম সাড়ে ছটার দিকে। এইবারের ড্রাইভার বেশ হাসিখুশি। উনি সেদিন রাত্রে ন্যু ইয়র্ক ফিরবেন বাড়িতে, সেই আনন্দে যাকে পারছেন, তাকেই বলছেন। লেক ইরির ধার দিয়ে বেশ খানিকটা পথ চলে প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমরা পৌঁছলাম নায়াগ্রা। ও মা, এ যে দেখি কোন বাস স্টেশনই না। প্লেন একটা হোটেলের সামনে ড্রপ। বাসটা আমাদের নামিয়ে আর রিটার্ন ট্রিপের যাত্রীদের নিয়ে ফেরত চলে গেল। ওই ড্রাইভার আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, কিছু সাহায্য লাগবে কী না। আমাদের তো বুকিং করা আছে, তাই না বললাম। এদিকে বুকিঙে চেক-ইন বিকেলে। খুব অসুবিধে হলে এগারোটার পর। প্ল্যান ছিল বাস স্টেশনেই ফ্রেশ হয়ে লাগেজ নিয়েই ঘুরতে চলে যাবো নায়াগ্রা ফলস। এদিকে যে এই কাণ্ড? অগত্যা?

Sunday, August 12, 2018

ক্রাশ কাহিনী (রিভাইজড)

একটা পুরনো লেখা সাজিয়ে গুছিয়ে লিখলাম। রিলেট করতে পারেন নাকি?

#ক্রাশ_কাহিনী

"সাতটা বেজে কুড়ি মিনিট। শুনছেন রেডিও মির্চি, ৯৮.৩ এফ এম। এরিজ টু ভার্গো শুনে নিন আপনার দিনটা আজ কেমন যাবে।

Aries। কর্মক্ষেত্রে আজ সাময়িক বাধার সম্মুখীন হতে পারেন। অনেকদিন ধরে যাকে মনের কথা বলবেন ভাবছিলেন, আজ বলেই ফেলুন। লাকি সংখ্যা ৩,৬,৯; লাকি রঙ হাল্কা বেগুনি, চকলেট ব্রাউন ও কালো।" মীরের গমগমে কণ্ঠস্বরে দিন শুরু হয় সুদীপের।

বেশ, তাহলে পুজোয় কেনা ব্রাউন শার্টটা আজ পরলেই হয়। সাথে কালো জিন্স। কিন্তু বেগুনি? কিছু তো নেই। আগে জানলে গেঞ্জিটা একটু না হয় বেশী উজালা দিয়ে কাচলে হত। কি মুশকিল! এখন কী করা যায়?

বছর সাতাশের সুদীপ, সব সময় বড়ই দোনামনায় ভোগে। প্রতি মুহূর্তে কী করব, এটা না ওটা, এই করতে করতেই বেশিরভাগ সুযোগ হাতছাড়া হওয়াটা প্রায় গা সওয়া হয়েই গিয়েছে ওর। এর থেকে একটু সুরাহা পেতে, মাসতুতো বৌদির পরামর্শে এখন সুদীপের অন্যতম প্রিয় হবি রাশিফল দেখা বা শোনা। আনন্দবাজারের ভিতরের পাতায় আজ অবধি যত জ্যোতিষীর বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে, মনে হয় সকলের কাছে একবার অন্তত গিয়ে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করালেও কোনদিনও সন্তোষজনক কিছু শোনেনি। দুই হাত মিলিয়ে কম পক্ষে আটখানা আংটি তো আছেই; এছাড়া গলায় তাবিজ, কোমরে মাদুলি, সব রয়েছে। সকাল সকাল উঠে রেডিওতে ও আনন্দবাজারের রাশিফল না দেখেশুনে অফিস যায়না। এবং এটা বেশ কিছু বছরের অভ্যেসই বটে। ওর বিশ্বাস, রেডিওতে শুনে হলুদ রুমাল পকেটে রেখেছিল বলেই এই চাকরিটা ওর হয়েছে, নইলে ইন্টারভ্যুতে যা ছড়ান ছড়িয়েছিল ও। চাকরিটা হওয়ার কোন চান্সই ছিল না।

সুদীপের ইদানীং জীবনে এক "সমস্যা" হয়েছে। না না। ঘাবড়ানোর মতো কিছু না। হৃদয়ঘটিতই। একটু বুকের বামদিকে চিনচিনে ব্যথা। তবে এটা যেহেতু ওর ক্রনিক অসুখ, এখুনি "ডাক্তার বদ্যি" করার তো প্রয়োজন নেই। অমৃতলাভ করতে পারলেই কেল্লাফতে। তা আমাদের সুদীপ বড়ই লাজুক ছেলে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মোটামুটি ভালোই কথাবার্তা বলতে পারলেও মেয়েদের সামনে গেলে রীতিমত তোতলায়। ইয়ে মানে ওই আর কী, এইসবের জ্বালায় বহু সুন্দরীর প্রতি হৃদয়ের গহিন গহ্বর থেকে প্রেম রসের উদ্রেক হলেও কোনটাই পরের স্টেজে পৌঁছতে পারেনি।

সুদীপ আমাদের কর্মঠ ছেলে। অফিস কলিগ অমৃতার ওপর যবে থেকে ক্রাশ হয়েছে, তবে থেকে শুরু করেছে রিসার্চ। এবং প্রথমেই খেয়েছে ধাক্কা। HR এ থাকার সুবাদে খুব সহজেই অমৃতার পার্সোনাল ডিটেলস জানতে পেরেছে। দেখেছে ওর জন্মদিন ১০ই জানুয়ারী। এই রে! এ যে দেখি Capricorn, আর সুদীপ কিনা Aries। কেলেঙ্কারি কাণ্ড; বেজান দাড়িওয়ালা, গোঁফওয়ালা সব্বাই সারাক্ষণ বলে গেছে যে এই জুটি নাকি সবচেয়ে incompatible। যাহ। এবার কী হবে? জানা ইস্তক ও খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কাজে মন নেই, রাত্রে ঘুম আসেনা। বড়ই শোচনীয় ব্যাপারস্যাপার। প্রাণের বন্ধু, দেবেশকে শেষে একদিন বলেই ফেলল অনেক কিন্তু কিন্তু করতে করতে। দেবেশ তো শুনে হাহা হোহো করে প্রায় উড়িয়েই দিচ্ছিল। এই যুগে এসে কেউ এমন বিদঘুটে কারণে সাফার করে, এ তো কল্পনাতীত। অনেক অট্টহাসির পর সে সুদীপের ক্যাবলা ভ্যাবলা অবস্থা দেখে দয়াপরবশ হয়ে সুচিন্তিত পরামর্শ হিসেবে অমৃতা কে মনের কথা খুলে বলতে বলল।

সুদীপ রোজই রাত্রে ভাবে, হ্যাঁ, কাল অমৃতাকে বলবেই বলবে। এমন কী, ঠিক কীভাবে কথা শুরু করবে, সেইসবেরও প্ল্যান এ বি সি বানিয়ে ফেলে। কিন্তু ওর কপাল ভালো না। প্রতিদিনই আর জে বলছে যে রোম্যান্সের পক্ষে এখন সময় ভালো যাচ্ছেনা। বেটার লেট দ্যান সরি। পাছে আবার এইটাও ফেল করে, সেই নিয়ে বেশ চিন্তিত। অমৃতাকে বলবে কি বলবে না, এই করতে করতে ইতিমধ্যে আরো এক সপ্তাহ কেটে গেল প্রায়। তবুও শেষমেশ মনে জোর এনে একদিন ভাবল যে নাহ, আজ বলবেই বলবে। সেইদিন নানান অছিলায় ওর সাথে কথা বলতে এগোলও। তবে চিরকালের লাজুক ছেলে সে, তার ওপর আবার বাংলা মিডিয়ামে পড়াশোনা করা, বয়েজ স্কুলে। অমৃতার মত নামী ইংরেজী মিডিয়ামের স্মার্ট মেয়েটির সাথে কথা বলতে গেলেই কিরকম জিভ জড়িয়ে যায়।

আবার গত দুই তিনদিন ধরে যা দেখছে, আর রিস্ক নিতে সাহস হচ্ছে না। আইটির ভাইটি রজত, তার সাথে খুব হেসে হেসে গল্প করতে দেখা যাচ্ছে অমৃতাকে। কানাঘুষোয় শুনেছে রজত নাকি আবার বসের কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়। বলা যায়না, অমৃতাকে সেই সুবাদে পটিয়ে ফেলল হয়ত। তবে সুদীপ এখনও হাল ছাড়েনি।

রোজ রাশিফল দেখে শুনে শুভক্ষণ খোঁজে মন হাল্কা করার; কিন্তু কপাল ভালো না। তবে অনেক কষ্টে আজ মীরের মুখে এইরকম বচন শুনে যারপরনাই খুশী হয়েছে। ঠিক করেছে, যে করেই হোক, অমৃতার কাছে আজ নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবেই, যে করেই হোক। লাকি রঙের জামা কাপড় পরে, ভালো করে দাড়ি কামিয়ে, অনেকটা আফটারশেভ ঢেলে রীতিমত প্রচুর মাঞ্জা দিয়ে তাই সে আজ অফিস গেল।

পৌনে নটায় অফিসে ঢুকে প্রথমেই নিজের কম্পিউটার অন করল। অটোতে আসতে আসতে প্ল্যান ছকে ফেলেছে। লাকি নম্বর অনুযায়ী ঠিক ৯টায় অমৃতাকে একটা ইমেল করবে। বাংলায় বরাবর ভালো সে, তাই ঝটপট একটা প্রেমপত্র লিখে ফেলতে বিশেষ অসুবিধে হলনা। তাছাড়া বয়ান তো এতদিনের প্ল্যানিং পর্বে বহুবার রিভাইসড হয়ে এখন মুখস্থ। নিজের ভালোবাসার কথা বলে চিঠিটা শেষ করল এই বলে যে অমৃতা যেন ওকে শীগগিরই নিজের মনোভাব জানায়।

দশটার একটু আগে অমৃতা ঢুকল। আজ পরেছে একটা সাদা রঙের চিকন কাজের চুড়িদার কুর্তা। আর একটা হাল্কা বেগুনি রঙের ওড়না। ঠিক যেন ডানাকাটা পরী। সুদীপের ডেস্ক থেকে তেড়ছা করে তাকালে অমৃতার টেবিলটা দিব্যি দেখা যায়। হাঁ করে তাকালে অবশ্য ব্যাপারটা বেশ বাজে হয়ে যাবে, তাই মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখে নিচ্ছিল ওদিকে। আজ যেন একবারও অমৃতা পেপারওয়ার্ক থেকে মুক্তি পাচ্ছেনা। কম্পিউটার খুলবার সময়ই পায়নি। একগাদা ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছে। মাঝে এক দুইবার চোখাচোখি হতে অদ্ভুত বিরক্ত মুখে তাকালো অমৃতা।

এই সেরেছে, মুড অফ নাকি? চিঠির এই প্রতিক্রিয়া? কেস করেছে। এটাও ফেলিওর? ধিক্কার সুদীপ, ধিক্কার। এইসব ভাবতে ভাবতে মাঝে এক সময় সুদীপ দেখল অমৃতা ক্যান্টিন যাচ্ছে। সুযোগ বুঝে সুুদীপও পিছু নিল। লাইনে একদম পরপর হয়ে যাবে ভেবে ইচ্ছে করেই একটু আসতে আসতে গেল। যতক্ষণে স্যান্ডউইচ নিয়ে টেবিলের দিকে যাবে সুদীপ, কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কী, অমৃতা ততক্ষণে সখী পরিবৃত হয়ে অন্য টেবিলে হাসির কলতান শুরু করে দিয়েছে। সুদীপেকে দেখে মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

লাঞ্চের পর ডেস্কে ফিরল সকলেই, কিন্তু অমৃতার রুটিন একই রয়ে গেল। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে তিনটে পেরিয়ে চারটে, চারটে পেরিয়ে পাঁচটার দিকে যেতে গেল বলে। সুদীপদের অফিস ঠিক সাড়ে পাঁচটা বাজলেই খালি হয়ে যায়। যাহ। এটাও তবে আনসাকসেসফুল। সামনাসামনি উত্তর না পেলেও অন্তত ভেবেছিল চিঠিটা পেয়ে অমৃতার কী রিএকশন হয়, নিদেনপক্ষে সেইটুকু দেখবে। কিন্তু তাও কপালে নেই। নির্ঘাত ওই হাল্কা বেগুনি কিছু সাথে নেয়নি বলে এমনটা হল। আচ্ছা বিচার তো ওপরওয়ালার! ও যে ব্রাউন আর কালোটা মেন্টেন করল, সেইবেলা? উনিও কি কর্পোরেট অফিসের মতোই নাকি? ভালোটা চোখে পড়েনা, কেবলমাত্র একটু পান থেকে চুন খসল কি, সঙ্গে সঙ্গে পেনাল্টি। ধুর। ভাল্লাগেনা।

এই শেষ, আর প্রেমে পড়বেনা। আর ক্রাশ টাশ হবেনা। মা এবার বিয়ে নিয়ে কথা পাড়লেই আর কাটিয়ে দেবেনা, বরং মা কেই বলবে পাত্রী জোগাড় করতে। ওর দ্বারা তো আর এ জন্মে প্রেম করা হলনা একটাও, এদিকে ওর কিছু বন্ধু বান্ধবরা তো প্রায় তিন চারটে প্রেম করে ফেলল। হতাশ হয়ে সাড়ে পাঁচটা বাজতে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে লিফটের দিকে মাথা নিচু করে এগোল সুদীপ। আর কপালও এমন, ঠিক একটুর জন্য মিসও করল। পরেরটা ওদের এই তেরোতলা পৌঁছতে দেরি আছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ব্যাঙ্কের পাঠানো এক গাদা এস এম এস ডিলিট করতে লাগল। তখনই কাঁধে একটা হাল্কা টোকা টের পেল। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে, আরে অমৃতা! ঠিকঠাক দেখছে তো?

"কী হল? উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যাচ্ছ যে? কৌতূহল নেই নাকি?"

(এ যে মেঘ না চাইতেই জল)

"তু-আপনি চিঠিটা পড়েছেন?"

"হ্যাঁ! না পড়লে কি করে বলছি?"

"না মানে আপনাকে সারাদিন তো একবারও কম্পিউটার খুলতে দেখলাম না, তাই ভাবছিলাম বুঝি আপনি ইমেলটা দেখেননি।"

"হুম, আজ খুব কাজের চাপ ছিল, তবে তোমার মেলটা আমি বাসে আসতে আসতে ফোনে পড়েছি।"

"ও আচ্ছা। আমার আসলে সাধারণ ফোন তো, তাই খেয়াল থাকেনা।"

"বেশ।"

ইতিমধ্যে লিফট এসে গিয়েছিল। দুজনেই ঢুকল ভিতরে। সুদীপ তো বরাবরের ক্যাবলা, ক্যাবলাই রয়ে গেল। মনে মনে খুব উসখুস করছিল অমৃতার উত্তর জানবার, কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা আর করতেই পারছেনা। এটা যদি সিনেমা হত, পাক্কা ব্যাকগ্রাউন্ডে এখন প্রাণ চায় চক্ষু না চায় বাজত। মেন গেট অবধি একসাথে হাঁটলও দুজনে। "বেশ, কাল তাহলে দেখা হবে, আজ আসি।" এই বলে অল্প হেসে সুদীপ অটো স্ট্যান্ডের দিকে চলতে শুরু করতেই, পিছন থেকে অমৃতা ডেকে উঠল। "আচ্ছা, উত্তরটা তো শুনলেইনা। চল অন্তত একটা আইস্ক্রিম খাওয়া যাক। "

(বেটা মন মে লড্ডু ফুটা!)

"আইস্ক্রিম? আসলে আমার না টন্সিলের প্রব্লেম আছে, ঠান্ডা খাওয়া বারণ। আপনি বরং যান। একা খান।"

"আরে ধুর ছাই, তোমার মত ক্যাবলা ছেলে জীবনে দেখলাম না আমি। ডেটে ডাকছে ক্রাশ, আর উনি নাকি টন্সিলের ছুঁতো করছেন। উফফ। চল। তুমি নাহয় কফি খাবে। আর হ্যাঁ, প্লীজ আপনি বলাটা থামাবে?"

এই প্রথম অনেকদিন বাদে সুদীপের মুখে চওড়া হাসি ফুটলো। তাহলে ব্রাউন শার্টের এফেক্টে বেগুনির না থাকাটা পুষিয়ে গেল। কী বলেন?

Saturday, August 11, 2018

আম্রিকা দর্শন পর্ব ৯



কুইনসি মার্কেট নাকি বস্টনের অন্যতম দেখার জায়গা। চেন্নাই থেকেই জেনে গিয়েছিলাম। শপিং করা যাবে। লিফট থেকে নামলাম যখন, সুজাতার মেসেজ এলো যে ও পৌঁছে গিয়েছে। এবং অবধারিতভাবে দুজনে দুই জায়গায়। ওর ফোনের চার্জ প্রায় শেষ। তাই আমিই গুগল ম্যাপ খুলে পৌঁছলাম ওর কাছে। দাঁড়িয়ে ছিল হার্ড রক ক্যাফের সামনে। প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। সন্ধ্যে হবো হবো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা ঢুকলাম কুইনসি মার্কেটে। আসলে কিছুই না, একটা বড় মার্কেট কমপ্লেক্স গোছের। কোথায় গিয়ে যেনও আমাদের হগ মার্কেটকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। চারিদিকে দেয়ালে গাছে টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো। মনে হবে যেন ক্রিসমাস এসে গিয়েছে আগে আগে। তবে দোকান পাট দেখে হতাশ হলাম। খুব বেশি দাম। সাধ্যের বাইরে। বাইরে কিছু ঠ্যালাগাড়ি মতো দোকান ছিল। সেখান থেকে খুচখাচ যেটা না কিনলেই না, এমন স্যুভেনির কিনলাম। ওই ফ্রিজ ম্যাগনেট, চাবির রিং।

আমার তো ওই ফিশ ট্যাকো খেয়ে তখনও বেশ পেট ভর্তি। শুধু বড্ড জল টান হয়েছিল। তাই আইস কোল্ড ফ্যানটা কিনে ঢকঢক করে ৬০০এম এলের এক বোতল পুরোটা একসাথে খেলাম। আমার এক জেঠু বলে দিয়েছিল বস্টনে ক্ল্যাম চাউডার নাকি খুব বিখ্যাত। অবশ্যই যেন খাই। কুইনসি থেকে বেরিয়ে এলাম ফেনুইল হল চত্ত্বরে। তার উল্টোদিকেই বিল্ডিং একটা। সেখানে সারি সারি খাবারের দোকান। অনেক দোকানেই বস্টন চাউডার বিক্রি হচ্ছে। আমরা দেখে শুনে একটায় গেলাম। বেশ ভিড় ছিল। আমি শুধু টেস্ট করব, তাই সুজাতা একটাই নিলো। চাউডার মনে ওই থকথকে স্যুপ গোছের। আর ক্ল্যাম এক ধরণের সামুদ্রিক প্রাণী। চিংড়ি জাতীয়। গোটা বস্তুটা মন্দ লাগেনি। হয়তো খিদে থাকলে আরো ভালো লাগতো। ফেনুইল হল হলো বস্টন ফ্রিডম ট্রেলের অন্যতম পয়েন্ট। আমেরিকার সিভিল যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। মহৎ জায়গা। ফ্রিডম ট্রেল আড়াই কিলোমিটার মতো হাঁটা পথ। জায়গায় জায়গায় সেখানে সিভিল ওয়ারের চিহ্ন। আমরা কেউই ইতিহাস নিয়ে অত উৎসাহী নয়। আর হাতে সময়ও কম। তাই ফ্রিডম ট্রেল বাদ। তবুও কপাল জোরে এই চত্বরটা দেখা হলো। সামনেই একটা এট্রিয়াম মত। দুইজন ছেলে গিটার বাজিয়ে লাইভ শো করছিল। খেতে খেতে শুনতে মন্দ লাগছিলো না। অনেকেই ওদের রাখা বাক্সে সাধ্যমতো ডলার বিল রাখছিল। শিল্পের কদর করি কিন্তু পকেটের টান। তাই ইচ্ছে থাকলেও এক ডলারের চেয়ে বেশি রাখতে পারিনি। খাওয়ার পাট মিটিয়ে আবার গাড়ি ডেকে বাড়ি ফেরা।

পরেরদিন আমাদের বস্টন ছাড়ার কথা। এয়ার বিএনবির চেকাউট টাইম দুপুর বারোটা। এদিকে আমাদের সন্ধ্যেবেলা বাস সাড়ে সাতটায়। এতক্ষন কী করব? আলেকজান্দ্রিয়াকে ফোন করে আমরা বললাম আমাদের অবস্থা। ও বললো কোনো অসুবিধে নেই। লিভিং রুমে লাগেজ রেখে বেরিয়ে যেও। বিকেলে নিয়ে নিও। আমরাও খুব খুশি হয়ে গেলাম। সেই আনন্দে ঝটপট ব্রেকফাস্ট আমিই বানালাম সেদিন। একই মেনু। সাথে আপেল। ইতিমধ্যে আমি মার্কিনি কায়দার গ্যাস ওভেন ব্যবহার শিখে মজা পেয়ে গিয়েছি। বাড়িতে ফোন করে ভিডিও চ্যাট করতে করতে রান্না করা আর তারপরে ওয়াটসএপ কলের মাধ্যমেই রেডিও মির্চি কলকাতা শোনা। চেন্নাইতে থাকতে মিরের কণ্ঠে ঘুম কাটাতাম। ওখানে টাইম জোনের দৌলতে অগ্নির হৈচৈ ক্যাফে শুনতে শুনতে একই কাজ হয়ে যেত। সত্যি, প্রযুক্তি আমাদের কোথায় নিয়ে গিয়েছে, না?

সুজাতার ইচ্ছে ছিল বেশ কয়েকটা টক শুনবে। আমার মতলব ছিল ঝিমনোর। তবে লাঞ্চ সেশন অবধি টক শুনে ও হল ও হাল দুইই ছেড়ে দিলো। টার্কি স্যান্ডউইচ দিয়ে লাঞ্চ সেরে আমরা ম্যারিওটের লবিতে বসে ভাবতে লাগলাম, কোথায় যাওয়া যায়। বস্টনের ডাক ট্যুরস বিখ্যাত। বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কিছু গাড়িকে রং চং করে সাজিয়ে গুছিয়ে ট্যুরিস্টদের ঘোরানো হয়। বস্টনের মূল কিছু দর্শনীয় স্থান দেখায়। আর তারপর সেই একই গাড়ি জলে নেমে যায় স্কাইলাইন দেখাতে। ওই জন্যই নাম ডাক ট্যুরস। হাঁসের মতো জলে ও স্থলে উভয়েই চলে বলে। আমাদের শখ হয়েছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম। দেড় ঘন্টা ঘোরাবে, তাতে মাথাপিছু পঁয়তাল্লিশ ডলার। এছাড়া আবার টিপস থাকবে। লবিতে বিভিন্ন ট্র্যাভেল এজেন্সির হপ অন হপ অফ ট্যুরের ব্রোশ্যার দেখলাম। কিছুই ট্যাঁক ফ্রেন্ডলি হচ্ছিল না। আসলে শহরটার দেখার জায়গা খুব বেশি নেই। তাই ওই অত দাম ঠিক জাস্টিফাই করতে মন চাইছিল না। কী করা যায় ভাবতে গিয়ে ঠিক করলাম বেশ একবার না হয় চার্লস নদীর ধারে যাই। তারপর ভাবা যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ক্যাব বুক করে রওনা দিলাম আমরা লঙ ওয়ারফ ওয়াটারফ্রন্টে। পথে অন্য যাত্রীকে নামবে বলে আমরা চায়না টাউন দেখে ফেললাম। বস্টনের বুকে এক টুকরো চায়না। দোকান বাজার ব্যাংক অফিস। সর্বত্র চাইনিজ ভাষায় লেখা। প্রচুর চাইনিজ লোকজন। দেখার মতোই জায়গা। স্রেফ কপাল করে আমরা দেখে ফেললাম, প্ল্যানে না থাকলেও। পায়ে হেঁটে ঘুরলে এর চেয়ে বেশি কিছু হতো বলে মনে হয় না।

ওয়াটারফ্রন্ট পৌঁছে দেখি এলাহী কান্ডকারখানা। একটা বিরাট ইয়াচ দাঁড়িয়ে। ওয়েল ওয়াচিং করায়। এক পিঠ আটাত্তর ডলার। আঁতকে উঠলাম। সর্বনাশ। পঁয়তাল্লিশএর ধাক্কা এড়াতে এসে আটাত্তর। নাহ, এও গেল। তাহলে? সামনেই ছিল নিউ ইংল্যান্ড অ্যাকওয়ারিয়াম। বেশ পকেট ফ্রেন্ডলি। তিরিশ ডলারের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে। সময়ের অভাবে আমরা থ্রি ডি মুভি শো মিস করলাম। ঢোকার আগে আবার বাইরে দাঁড়ানো স্টল থেকে আরেক প্রস্ত স্যুভেনির শপিং করলাম দুজনেই। এক ভারতীয় গ্রুপের সাথে দেখা হলো। দুই প্রবীণ দম্পতি। ছেলে মেয়েরা এখানে থাকে। ঘুরতে এসেছেন এখানে। মূলত ওদের উৎসাহে অ্যাকওয়ারিয়ামের টিকিট কেটেছিলাম। খানিকক্ষণ বাইরেটা দেখলাম। কত লোক। সব নদীর ধারে ছোট ছোট ক্যাফেতে বসে খাচ্ছে আর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে। অনেকে ক্রুজের অপেক্ষায়। এক দল লোক ফিরলো ক্রুজ থেকে। মুখে হাসি। হয়তো দারুন কিছু দেখেছে।

অ্যাকওয়ারিয়ামের ভিতরে ঢুকে প্রথমেই গেলাম সি লায়ন দেখতে। ফার সিল ও সি লায়ন দুইই একই এনক্লোজারে রাখা। অতীব মিষ্টি প্রাণীগুলো। দিব্যি জলের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ পাথরে শুয়ে আলসেমি করছে। তারপর গেলাম মূল অ্যাকওয়ারিয়ামে। সেখানে শুরুতেই রয়েছে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের দল। বেঁটে খাটো সাদা কালো এই প্রাণীগুলো গুটিগুটি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। জলে লাফাচ্ছে। খাচ্ছে। দেখতে ভারি মজা লাগলো। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের দেখলাম। ছবিও তুললাম। তারপর এগোলাম অন্য দিকে। গোটা জায়গাটা একটু আলো আঁধারী মতো। নীল হালকা একটা আলোর মৃদু আভা। অনেকটা কোনো থিমের পুজোর প্যান্ডেল যেন। একটা ওয়েলের বিরাট কঙ্কাল সাজিয়ে রাখা। এরপর ramp বরাবর পরপর বিভিন্ন ইকো সিস্টেমের মিনিয়চার। বহু বহু প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক স্পিসিজ। যেমন কোরাল স্টারফিশ জেলিফিশ ইল কচ্ছপ ইত্যাদি। একটা জায়গায় সাপ (আমি দেখেই পালিয়েছি)। প্রত্যেকটা এনক্লোজারে বাইরে সেই প্রাণী সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া। চারতলা সমান জলের ট্যাঙ্কে ডুবুরিরা নেমে মাছেদের ও অন্যান্য পশুদের খাবার দিচ্ছে, দেখলাম। অন্ধকারের জন্য ভালো ছবি না উঠলেও চাক্ষুস দেখার অভিজ্ঞতা বেশ বেশ ভালো। মনে হলো স্কাইলাইন বা ওয়েল ক্রুজ না করে খুব ভুল করিনি। এটা মোটামুটি পয়সা উসুল। সব দেখে টেখে বেরোতে বেরোতে প্রায় চারটে। গত দুদিন সূর্যের আলো দেখে সময় বুঝতে গিয়ে খুব ঠকান ঠকেছি। আজ তাই কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখা। সন্ধ্যের বাস। মিস করলে মুশকিল। বস্টনের ঘোরাঘুরিকে আপাতত বিদায় জানিয়ে এরপর ফিরলাম বাড়ি। ফ্রিজ থেকে আমাদের ফলমূল ও চীজকেক বের করলাম। প্যাক করে নিতে হবে। ফোনেও চার্জ চাই। আর ঘন্টাখানেক সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে রেস্ট।

ছটা নাগাদ মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গ্রে হাউন্ড বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। পরের গন্তব্য নায়াগ্রা।


আম্রিকা দর্শন পর্ব ৮


আমি বেশ চিল্ড আউট পাবলিক। বিকেলে আমার পোস্টার প্রেজেন্টেশন। সেই নিয়ে কোন তাপ উত্তাপ নেই। দিব্যি সকালবেলা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠলাম। ইতিমধ্যে দেখি সুজাতা উঠে পড়েছে। ধীরেসুস্থে ফোন পর্ব শেষ করে স্নান টান সেরে যখন বেরোলাম, দেখি সুজাতা ইতিমধ্যে আমার আর ওর জন্য ব্রেকফাস্ট রেডি করে ফেলেছে। বেগেল টোস্ট, সাথে চীজ স্প্রেড আর অনেকটা ডিম ভাজা। যেহেতু টেট্রাপ্যাকের ডিম আর বাসনেরও অভাব ছিল, ব্যাপারটা অমলেট বা পোচ না হয়ে তৈরি হল ওই অলমোস্ট স্ক্র্যাম্বল্ড এগস। খেয়ে দেয়ে গেলাম কপ্লি প্লেসের ম্যারিওটে। সারাদিন বেশ বোরড হলাম। আমার না লেকচার টেকচার শুনলে বড্ড ঘুম পায়। খুব কষ্ট করে জেগেছিলাম। দুপুরে কনফারেন্সেই লাঞ্চ দিয়েছিল। চিকেন স্যান্ডুইচ, আপেল, কুকি, চিপস আর ড্রিঙ্কস। অল্পবিস্তর খাওয়াদাওয়া করে আমি একটু লবিতে রইলাম। ফোনে প্রেজেন্টেশনটা দেখে টেখে একটু মেন্টাল প্রিপারেশন নেওয়া আর কি। সময় মতো পোস্টার সেশন শুরু হল। শেষও হল। কিছু অতি উৎসাহী মানুষজন এলেন। তাঁদের আমার কাজ সম্পর্কে বললাম। ব্যস, মিটে গেল কাজের কাজ। এইবার শুধুই ভ্রমণে মন দেওয়া যাবে।
বেরোতে বেরোতেই প্রায় সাতটা হয়ে গিয়েছিল। আমরা হাঁটতে হাঁটতে হেলতে দুলতে রওনা দিলাম আমাদের থাকার জায়গার উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল বিখ্যাত চীজকেক ফ্যাক্টরি। এই দোকানের চেনটি গোটা অ্যামেরিকা জুড়ে আছে। এখন তো বোধহয় অন্যান্য কিছু দেশেও খুলেছে ব্রাঞ্চ। চীজকেক ফ্যাক্টরির বৈশিষ্ট্য কি কিছু আছে? তেমন না। শুধু এই যে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন ফ্লেভারের অনন্য স্বাদের (এবং অবধারিতভাবে প্রচণ্ড পরিমাণে ক্যালরিযুক্ত) পরম সুস্বাদু চীজকেক। এ ছাড়াও আরো অন্যান্য খাবার আইটেমও পাওয়া যায় অবশ্যই। আমরা যারা খুব জনপ্রিয় টিভি সিরিজ দ্য বিগ ব্যাং থিওরি দেখে আনন্দ পাই, তাদের কাছে দ্য চীজকেক ফ্যাক্টরির আলাদা টান, কারণ এখানেই সিরিজের প্রিয় ক্যারেক্টাররা মাঝে মাঝেই এসে খেতেন, মঙ্গলবার করে। আমরা তো দুজনে ঢুকলাম দোকানে। দাম দেখে একটু ছ্যাঁকা খেলাম। তবে সুজাতার অবস্থা আমার চেয়ে বেটার, ও স্টাইপেন্ড পায় ডলারে। আমার মতো প্রতিবার এক ডলার মানে তখন উনসত্তর যাচ্ছে, এরকম ভাবতে হচ্ছেনা। ওই বলল, এটা ওর ট্রিট। আমার অ্যামেরিকা আসাকে সেলিব্রেট করতে। লেমন চীজকেক পছন্দ করে নিলাম। দাম খেয়াল নেই, তবে ওই টিপস দিয়ে টিয়ে প্রায় কুড়ি ডলারের কাছাকাছিই হবে। বেশ বড় পিস, দুজনে মিলে আরাম করে খাওয়া যায়। আর সাথে প্রচুর চেরি দেওয়া। ফেরার পথে রাস্তায় একটা বিশাল বিল্ডিং ছিল, কীসের কী, জানিনা। আন্ডার রেনোভেশন ছিল। তার সামনে বেশ বড় একটা ফোয়ারা ছিল। সেখানে বাচ্চারা ছোটাছুটি করে খুব মজা করছিল দেখলাম। আমরা ধারে বসলাম খানিক। একটু চিজকেক খেলাম। বাইরে তখন রোদ পড়ে আসছে। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা বেজে গিয়েছে। ডেজারট গুছিয়ে রেখে হাঁটা লাগালাম। গতকালের ওই জঘন্য চাইনিজ ডিনারের পর ইচ্ছে ছিল আজ রাত্রে ভালো কিছু খেতে হবে। তাই গেলাম ক্যুডোবা নামের এক মেক্সিকান রেস্টুরেন্টে। মেনু দেখে আমার তো ওই ভগবান জানে এসব কী, খায় না মাথায় দেয় অবস্থা। সুজাতার জিম্মায় ছেড়ে দিলাম অর্ডার করার দায়িত্ব। আমরা নিলাম চিকেন বারিটো রাইস বোল। বানালো আমাদের সামনে। কিছুই না। ওই রাজমা চাউলকে বিদেশি নাম ও সাজ দেওয়া। রাজমা, ভাত এর সাথে কিছু টক ঝাল সস, প্রচুর শসা পিঁয়াজ ও টমেটো মিশিয়ে একটা চাট চাট ব্যাপার। ভিতরে মাংসের টুকরো ভালো মতোই। খেয়েদেয়ে ফিরলাম বাড়ি। পরেরদিন সুজাতার প্রেজেন্টেশন। ও খুব সিরিয়াস এইসব ব্যাপারে।আমি ভাবতে বসলাম আমার দিনপঞ্জি কী হতে পারে। বস্টনে ঘোরার মতো খুব বেশি কিছু নেই। তাও তার মধ্যে যা যা দেখার আছে, সেখান থেকে কিছু একা একা ঘুরে নেওয়া যায় কি না।
আমার আই আই টির জ্যুনিওর দেবজ্যোতি হার্ভার্ডে পি এইচ ডি করছে। ওকে বলে রেখেছিলাম আমায় হার্ভার্ড ঘোরাতে। বস্টন এসে ওই পাড়ায় না যাওয়াটা পাপ। ওকেই তাই জিজ্ঞেস করলাম মেসেজ করে। পরেরদিন ওর কী প্ল্যান প্রোগ্রাম। বলল লাঞ্চ টাইমে চলে এসো। ব্যস। আমারও প্ল্যান সেট। কোনমতে ঘুমোতে ঘুমোতে প্রথম সেশন কাটালাম কনফারেন্সে। সুজাতার ল্যাপটপটা বিগড়েছিল। ও মাঝপথেই ছুটল অ্যাপল স্টোরে। আমি লিফট শেয়ার ডেকে রওনা দিলাম কেম্ব্রিজের দিকে। বস্টন আর কেম্ব্রিজ (যেখানে হার্ভার্ড), আমাদের হাওড়া কলকাতার মতোই। গঙ্গার বদলে চার্লস নদী।
ইউ এসে যেটা এই দুদিনেই বুঝে গিয়েছিলাম, মানুষজনের সৌজন্যবোধটা খুব বেশি। ক্যাবেই যাও কী দোকানে, প্রথমেই হাই, হাউ আর ইউ যেন বলতেই হবে। সাথে অবশ্যই চওড়া হাসি। আমিও ক্যাবে উঠে চালককে হাই হ্যালো করলাম। ভদ্রমহিলা চালক। মাঝবয়সী। দারুণ লাগল ব্যাপারটা দেখে। ভারতে তো কোনদিনও এমন দেখিইনি। অথচ মার্কিনে বেশ কয়েকবার মহিলা চালিত শেয়ার ক্যাব দেখলাম।  ঝলমলে আকাশ। রোদ। ট্র্যাফিক তেমন বেশি না। আমি একটু ভদ্রমহিলার সাথে গল্প করার চেষ্টা করলাম। আহা কী সুন্দর ওয়েদার বলে টলে। তবে দেখলাম উনি হয়ত স্বচ্ছন্দ নন। আমিও চুপচাপ জানালর বাইরে মন দিলাম। চওড়া রাস্তা। গাড়ি চলছে অনেক। ক্রমে আমরা পড়লাম একদম নদীর ধারের রাস্তায়। বেশ লাগছিল। গাড়িতে চলছে এফ এম। সেখানে কিছু চেনা সাম্প্রতিক ইন্টারন্যাশনাল হিটস বাজছে (শেপ অফ ইয়ু, ডেস্পাচিতো)। পাশ দিয়ে নদী। সাড়ে বারোটা নাগাদ পৌঁছলাম হার্ভার্ড স্কোয়ারে। দেবজ্যোতির দেখা নেই। ফোন করলে দেখি রিসিভ করছেনা। ওয়াটসঅ্যাপেও সারা নেই। এই রে। গেলো কোথায় ছেলেটা। ভাবতে ভাবতে দেখি সে হাজির। আমায় ক্যাবে আসলে নাকি ভুল জায়গায় নামিয়েছিল। বেশ।
কেমন আছ/আছিস এইসবের পালা মিটিয়ে শুরু হল আমাদের হার্ভার্ড ভ্রমণ।
অভিজ্ঞ ট্যুরিস্ট গাইডের মতো আমায় সমস্ত কিছু বোঝাল, দেখাল। গোটা কেম্ব্রিজ চত্বরের যে বেশিরভাগ বাড়িই হার্ভার্ড ইয়ুনিভারসিটির সেটা জানলাম। এবং সেই সমস বাড়িকে প্রায় চেনার একটা অব্যর্থ উপায় হল বাড়ির রঙ। একটা সিগনেচার লালচে দেওয়াল। পুরনো আর্কিটেকচার। মেন গেট দিয়ে ঢুকলাম হার্ভার্ডে। বিশাল সবুজ লন। আর আরেকটু এগোলেই ঐতিহাসিক হার্ভার্ডের স্ট্যাচ্যু। দেখলাম ট্যুরিস্টের ভিড় সেখানে। এই স্ট্যাচ্যুটা হার্ভার্ডে আসলে দেখেই দেখে লোকে। এটিকে বলা হয় স্ট্যাচ্যু অফ ঠরই লাইজ। অর্থাৎ, তিনটি মিথ্যের স্ট্যাচ্যু। প্রথমটি হল বলা হয় এটিই হার্ভার্ডের প্রতিষ্ঠাতা জন হার্ভার্ডের স্ট্যাচ্যু। আসলে কিন্তু আদপেই এটি জন হার্ভার্ডের মূর্তি না। দ্বিতীয়ত হার্ভার্ড মোটেই সেই অর্থে ইউনিভারসিটির প্রতিষ্ঠাতাও নন। উনি প্রথম অনুদান করেছিলেন ইউনিভারসিটির জন্য, তা ঠিক। তৃতীয়ত মূর্তিতে লেখা হার্ভার্ড প্রতিষ্ঠা হয় ১৬৩৮এ। আসলে তা না। হয় আরো দুই বছর আগে। বলা হয় এই মূর্তিতে মাথা ঘষে গেলে নাকি কপাল ফেরে। পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে তা করে যায় নিয়মিত। ট্যুরিস্টও তাই করে। আর তাই এই স্ট্যাচ্যুটি বেশ চকচকে। আমার অবশ্য মাথা ঠোকা বা পাশে পোজ দিয়ে ছবি তোলা কোনটাই হয়নি। অত ভিড় ঠিক ইচ্ছে হয়নি। দূর থেকেই ছবি তুলেছি।
এরপরে আমাদের গন্তব্য ছিল ওয়াইডনার লাইব্রেরি। এটি হার্ভার্ডের তথা পৃথিবীর সমস্ত ইউনিভারসিটির মধ্যে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। যখন লাইব্রেরিটি বানানোর জন্য অনুদানা সে, তখন একটি শর্ত ছিল যে বাইরের ফ্যাসেডটি বদলানো যাবেনা। কিন্তু দিন যত এগিয়েছে, লাইব্রেরির কালেকশনে বই ততই বেড়েছে। কী উপায়? বুদ্ধি খাঁটিয়ে এবং স্থাপত্যবিদ্যার যথাযথ প্রয়োগ করে বর্তমানে বিল্ডিঙটির ছতলা ওপরে এবং মাটির নিচে আরো বারোতলা রয়েছে। একেই এতোগুলো তলা, তার ওপর এরিয়াও বিশাল। একেকটি ফ্লোর নর্থ ইস্ট ওয়েস্ট সাউথ উইঙে বিভক্ত। মোটামুটি সারা পৃথিবীতে যত ভাষায় যত বই প্রকাশ হয়, প্রত্যেকটার একেক কপি অন্তত এই লাইব্রেরিতে আছে। আমি দুটো ফ্লোর ঘুরেছিলাম। তাও সমস্ত উইং না। কিন্তু তাতেই ওই অত অত বই দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। হিউম্যানিটিজ থেকে সায়েন্স, টেকনোলজি থেকে ফিল্ম, যা চাই, সব আছে। আর অসামান্য ক্যাটালগিং সিস্টেম। দেবজ্যোতির কাছে শুনলাম যে এই লাইব্রেরি থেকে বিভূতিভূষণ তুলে পড়েছে যেমন, তেমনি প্রচুর ওল্ড ইংলিশ ক্লাসিক সিনেমাও দেখেছে। বিপুল সম্ভার। রিডিং রুমগুলোও অপূর্ব। সেই স্থাপত্য যে কোন মধ্যযুগীয় রাজপ্রাসাদকে হ্যাঁর মানাতে পারে কারুকার্যে। ও ওর প্রিয় স্পট দেখাল। জানলার ধারে সোফা আর টেবিল পাতা। বাইরে হার্ভার্ড লন দেখা যাচ্ছে। বেশ কফি কাপ হাতে আরামে পা ছড়িয়ে বসে সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়, এমন সুন্দর।
এরপরের গন্তব্য মেমোরিয়াল হল। এই মেমোরিয়াল হলেই রয়েছে স্যান্ডারস থিয়েটার। সিনেমা স্ক্রিনিং হয়। অক্সফোর্ডের এক থিয়েটার হলের অনুকরণে তৈরি এই হলটি নাকি তার অ্যাকস্টিক ও ডিজাইনে রজনয় বিখ্যাত।  ভিতরে ঢুকতে পারিনি। বাইরে থেকে দেখলাম।তার পাশেই রয়েছে অ্যানেনবারগ হল। এটি মূলত স্টুডেন্টদের ডাইনিং হল। এবং তারপরে রয়েছে মেমোরিয়াল ট্রান্সেপ্ট। যারা যারা হ্যারি পটারের সিনেমা দেখেছেন, হগওয়ারটসের প্রাসাদ যেমন রাজকীয় দেখিয়েছে, তার চেয়ে কোন অংশে কম না। রঙ্গিন কাঁচের জানলা, বিশাল উঁচু দেওয়াল। সেই দেওয়াল জুড়ে নাম লেখা সিভিল ওয়ারের সময় হার্ভার্ডের যে সমস্ত মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলেন ইউনিয়নের জন্য।
ইতিমধ্যে দুপুর দেড়টা বেজে গিয়েছে। খিদে খিদে পাচ্ছে। আমরা গেলাম লাঞ্চ সারতে। কেম্ব্রিজ কমন্স বলে একটি রেস্টুরেন্টে। টিপিকাল অ্যামেরিকান রেস্টুরেন্ট। ভিতরটা লাল (আর অল্প কালো) রং। সেদিন ফ্রান্স আর বেলজিয়াম (বোধহয়, খেয়াল নেই) ম্যাচ চলছিল। রেস্টুরেন্ট ভর্তি লোক। সবার হাতে বিয়ার, প্লেটে খাবার আর দুই চোখ টিভি স্ক্রিনে। আমরা গিয়ে বসলাম। ফিস ট্যাকো আর ব্রাউনি উইদ আইসক্রিম সহযোগে বেশ হেভি লাঞ্চ হল। পকেটেও হেভি (জনপ্রতি টিপস সহ ২৪ ডলার), পেটও ভালোই ভরেছিল। ওই দুপুরের চড়া রোদে ঘুরতে ঘুরতে বড্ড টায়ার্ড হয়ে গিয়েছিলাম। গেলাম দেবজ্যোতির হোস্টেলে। আই আই টির হোস্টেলে সীমিত পরিকাঠামোয় অভ্যস্ত। হার্ভার্ডের হোস্টেল দেখে থ। হোটেলের ঘর বলা চলে প্রায়। সুন্দর এসি লাগানো ঘর, সাথে আবার অ্যান্টি রুম। আরামকেদারা। বেশ কোজি অ্যান্ড কমফোর্টেবল। গল্প করলাম খানিক। ও স্নান করতে গেল যখন, আমি মনের সুখে ওর বইয়ের তাক ঘাঁটলাম।
আমাদের ইচ্ছে ছিল কমন রুমে বসে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ দেখবো। কিন্তু বকবক করতে করতে আর তা হয়ে ওঠেনি। চারটের দিকে বেরোলাম আরো বাকি জায়গাগুলো ঘুরতে। পরপর বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিং দেখলাম। নিজে বায়োলজির স্টুডেন্ট বলে বায়োসায়েন্সের বিল্ডিং দেখে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি হল। ডি এন এ ডবল হেলিক্সের আবিষ্কারের যুগান্তকারী কাজ যেখানে বসে হয়েছে, সেটিও  দেখলাম বটে। সমস্ত দিকপাল মানুষজনেরা যেই যেই ল্যাবে কাজ করেন, সেই ল্যাবগুলি চাক্ষুস দেখলাম। অমর্ত্য সেনের অফিস বিল্ডিঙটিও দেখলাম। কী অসম্ভব নিষ্ঠা ও মনোযোগ দিয়ে স্কলাররা কাজ করেন, তাঁদের ল্যাব, অফিস...সত্যি, পীঠস্থান বটে।  মেকানিক্স বিল্ডিঙের চিলেকোঠায় বসে যে হার্ভার্ডের একটা দারুণ রূপ দেখা যায়, সেই অভিজ্ঞতাও হল। সাধারণ ট্যুরিস্টের চেয়ে ঢের বেশিই চিনলাম যেন হার্ভার্ডকে। ল স্কুলের সামনে সেই স্থাপত্য দেখে খানিক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর চললাম নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে। চার্লস ওয়াটারফ্রন্ট যার পোশাকি নাম। নদীর অপরদিকে অলস্টন আর বস্টন শহর। নদীতে কেউ কায়াকিং করছে, কেউ বা এমনিই ধারে বসে। কেউ রোয়িং করছে তো কেউ রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই সুন্দর বেঞ্চ পাতা। আমরা একবার বসে একটু জিরোলাম। পিঠে ব্যাগ। একদম কনফারেন্স থেকে চলে এসেছি, সাথে আবার ভারি ক্যামেরা। একটু টায়ার্ড লাগছিল। নদীর ধারে রাস্তা পার হলে সারি দিয়ে স্টুডেন্টদের থাকার জায়গা। স্টুডেন্ট হাউজিংগুলিও একেকটা দেখার মতো স্থাপত্য।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছলাম ম্যাগাজিন বিচে। ছোট্ট একটু জায়গা। নদীর জলে পৌঁছনো যায়। দেবজ্যোতি জলে নামল। আমি আবার জুতো মোজা খোলার চক্করে যেতে হবে বলে নামলাম না। পটাপট কিছু ছবি তুললাম। ইতিমধ্যে সুজাতা জানালো ও রেডি। বেরিয়ে পড়ছে। আমি বেশ টায়ার্ড, তাই আরো হেঁটে এম আই টি অবধি গেলাম না। দেবজ্যোতি বলেছিল যে এম আই টিতা ঠিক সুন্দর না। মানে হ্যাঁ, সেন্টার ফর এক্সিলেন্স বটে, কিন্তু হার্ভার্ড যেমন সুন্দর, দেখে ভালো লায়ে, তেমন কিছুই না। আর তাই আফসোস না করেই লিফট ডেকে ফেললাম। যেখানে ক্যাবে উঠলাম, সেখানে দেখি একটা ওপেন এয়ার জিম। দিব্যি ইনোভেটিভ লাগল ব্যাপারটা। খোলা আকাশের নিচে শারীরিক কসরত, কিন্তু সমস্ত সফিস্টিকেটেড ইক্যুইপমেন্টস দিয়ে। ভারতবর্ষে এদিন আসতে কত দেরি কে জানে।