Friday, May 31, 2019

একটা উস্কোখুস্কো খামখেয়ালি দুপুর।
বইয়ের পাতা এদিক ওদিক, মন যেন বসেই না তাতে।
তার চেয়ে বরং বারান্দার ওই একটা চেনা কোণ, সাদা চেয়ার, তাতে গা এলিয়ে নস্ট্যালজিয়া যাপন?
নাকি পশ্চিমের ওই রোদ মাখা বিছানায় নরম বালিশের হাতছানি?
উঁহু। সেও তো বড্ড একঘেয়ে, ভালো লাগেনা কিছুই।
কী যে করি? কীই যে করি, ভেবেই হই আকুল।
এমনি করেই কেটে যায় আরেকটা দুপুর। এমনি করেই কাটবে আরো বেশ দিনকতক।
তারপর? তার আর পর কী?
তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিয়ে আবার শুরু ফেরার কাউন্টডাউন!


জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাবে? তা বেশ তো, জানিয়ো।


কিন্তু দোহাই তোমার, ওসব কঠিন কঠিন কাব্যি স্টেটাস না।


কেনো? কারণ ওই আদরবাসা লজ্জাবাসা নানানবাসাটাসা


কোন কিছুই যে আমি দিতে পারবো না তোমায় ইন রিটার্ন, ডার্লিং।






আমার দৌড় ওই "মন ছুঁয়ে গেলো", "তুমি যে আমার" এইসব ছাপোশা ফ্রেজ অবধিই সীমাবদ্ধ,


নেহাতই সাধারণ, সহজ কথা, তাই সহজ পাঠেই মুহূর্তরা থাকে মুঠোবন্দী।





অনুভূতিটুকু হোক না খাঁটি, নাই বা হলে রাশভারী,









কারণ দিনের শেষে সেই একলাযাপন, কারণ?

আমি যে "আদতে আনাড়ি"।

শহরের পাঁচালি 7

বিকেল পাঁচটা। রোদের তেজটা একটু হলেও কমেছে। বেরোতে হলে এইবেলাই বেরনো উচিত, এই মনে করে কর্পোরেশন অফিসের ক্যাজুয়াল স্টাফ রবি গুটিগুটি পায়ে ফিরোজদার টেবিলের দিকে এগোল। ফিরোজ এই অফিসের বড়বাবু। ক্যাজুয়াল স্টাফেদের মাইনেপত্তর উনিই দেখেন। কাচুমাচু মুখ করে খানিক দাঁড়ালো রবি। ফিরোজ কোন কাগজপত্র ফাইল টাইল বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখছিলেন। রবি একবার গলা খাঁকড়ি দিলো। ফিরোজ মাথা তুলে তাকালেন, "কীরে রবি? কিছু বলবি?" রবি একটু হাত কচলে, ইতস্তত করে বলল, "ইয়ে মানে ফিরোজদা, আজ তো একত্রিশ তারিখ। এই মাসের মাইনেটা যদি আজ..." রবির কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফিরোজ বললেন, "সে তো জানি রবি। কিন্তু দেখ, ফাইল পাশ হয়নি। কী করে দিই বল তোকে?" কথাগুলো শুনে রবির মুখ চুন হয়ে গেলো। "আসলে কদিন বাদেই তো ঈদ দাদা, বউ আর ছেলে মেয়েদুটোর জন্য নতুন জামা কিনতে হতো..." ফিরোজ প্রবল দুঃখিত মুখে মাথা নেড়ে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেন। রবি মাথা নীচু করে ফিরে আসে নিজের টেবিলে। ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা পনেরো।
জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পায়, নিউ মার্কেট চত্বরের ব্যস্ততা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট দোকান, বড় ঝাঁ চকচকে দোকান, সব জায়গায় দোকানিরা পসরা সাজিয়ে রেখেছে। উৎসবের মরসুম। বিক্রিবাট্টা ভালোই হবে, এই আশায়। ক্রেতারাও এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে পছন্দের জিনিস কিঞ্ছে, সামর্থ্য অনুযায়ী। রবির মনটা খারাপ লাগে। গত বছর ঈদে বউকে একটা সামান্য ছাপা শাড়ি আর ছেলে মেয়েদুটোকে ছিট কাপড়ের জামা প্যান্ট দিতে পেরেছিল। আর কিছু কেনার সামর্থ্য তখন ছিল না। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে, ওভার টাইম খেটে নিজের একটা একতলা বাড়ি বানিয়েছে ও। ভেবেছিল এ বছর অনেকটাই স্থিতি ফিরেছে, একটু ভালো করে দেওয়া থোওয়া করবে। মেয়েটাকে একটা জড়ির কাজের সালওয়ার কুর্তা, ছেলেকে শেরওয়ানি আর বউকে নকশি কাজের শাড়ি কিনে দেবে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে মাইনেই আসছে না। প্রতি সপ্তাহেই শুনছে এই তো, এই সামনের সপ্তাহে দেবে, কিন্তু টাকা আর আসে না। বিল পাশ হয়না। আন্দোলন করে করে ওরা ক্লান্ত। এবারের রোজাতেও তাই উপোস ভাঙতে ফলটলও খুব একটা কেনা হচ্ছেনা। বিষণ্ণ রবি দাঁড়িয়ে থাকে জানলার ধারে।
"রবি, এই রবি?" বর্ণালী দিদির ডাকে সম্বিৎ ফেরে রবির। "আসছি দিদি।" এই বলে রবি এগিয়ে যায় দিদির টেবিলের দিকে। দিদি এই অফিসের অন্যতম সিনিয়র। খুব হাসিখুশি মানুষ। সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। আর তাই সক্কলে দিদিকে ভালোবাসে। রবি দিদির কাছে এসে দাঁড়ালে, দিদি একটা সাদা খাম ওঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, "শোন রবি। এতে সামান্য টাকা আছে। তোর আর তোর পরিবারের জন্য ঈদি। কাপড় জামা কিনে দিস ওদের পছন্দমতো। আর আজকে দেখলাম নিউ মার্কেটে ভালো টাটকা লিচু এনেছে। নিয়ে যাবি এক কিলো। ছেলে মেয়ে আর বউকে খাওয়াবি। বুঝলি?" রবি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ায়। মুখে কোন কথা ফোটে না। "আরে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? নে ধর। আর বেরিয়ে পড়। দোকানে এরপর আরো ভিড় বাড়বে। যা কেনাকাটি কর। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফের।"
রবি কৃতজ্ঞচিত্তে নিজের জায়গায় ফেরে। মনে মনে আল্লার কাছে দিদির জন্য দোয়া চায়। সত্যিই, দিদির মতো মানুষ হয়না। ঠিক যেন ফরিশ্তা।
সেদিন রবি নিউ মার্কেট ঘুরে ঘুরে এ দোকান সে দোকান ঘুরে, ছেলে মেয়ে আর বউয়ের জন্য পছন্দসই জামা কেনে। আম আর লিচুও কিনে ফেলে এক কেজি করে। আহা, এতদিন পর, পরিবারের মুখে একটু হাসি ফুটবে। বাজারহাট করে যখন নিউ মার্কেট চত্বরের ভিড় ঠেলে ও হাঁটতে থাকে, সারাদিনের ক্লান্তি যেন আসন্ন খুশির আশায় কোথায় গায়েব। নতুন জীবনীশক্তিতে রবি তখন উজ্জীবিত। 

Thursday, May 30, 2019

একটা সময়, মানে যখন এই টি টুয়েন্টির দৌরাত্ম্য শুরু হয়নি, আই পি এল এসে সব লন্ডভন্ড করে দেয়নি, যখন ক্রিকেটে ঝড় বলতে শারজার মাঠে শেন ওয়ারনের বলে শচীনের তুলে তুলে ছয় আর সৌরভ গাঙ্গুলির বাপি বাড়ি যা বুঝতাম, তখন ক্রিকেট খেলাটাকে মন প্রাণ দিয়ে ফলো করতাম। সে টেস্ট হোক কি ওয়ান ডে। তখন বেশিরভাগ সময়ই অস্ট্রেলিয়ার সাপোরটার ছিলাম। সৌজন্যে স্টিভ ওয়া আর অ্যাডাম গিল্ক্রিস্ট। তবে নন অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে অবশ্যই ইন্ডিয়া। অজয় জাদেজা, রাহুল দ্রাবিড় এঁরা তখন আমার হিরো। বলতে লজ্জা নেই, সৌরভ গাঙ্গুলিকে তখন কিছুটা হলেও অপছন্দই করতাম, রাহুল দ্রাবিড়ের কম্পিটিটর ভেবে। শচীন শচীন করে সারা দেশ পাগল হলেও আমার পছন্দ বরাবরই হাটকে। তাই রাহুল দ্রাবিড় আর জাদেজা। তখন খবরের কাগজে এই ক্রিকেটারদের প্রচুর ছবি বেরতো। বিজ্ঞাপনে। সব কেটে কেটে রাখতাম। আমার পড়ার বইয়ের তাকের দরজার ভিতরের পাল্লায় বেয়ার জিন্সের বিজ্ঞাপনের অজয় জাদেজা শুয়ে থাকতো কেত মেরে, পেপসির বোতল হাতে থাকতো দ্রাবিড়। এম আর এফের টায়ারের সামনে দাঁড়িয়ে শচীন। মনে আছে, একটা খয়েরি রঙের ডায়েরি ছিল আমার। সেখানে খেলায় অস্ট্রেলিয়া (বেশি করে) আর ইন্ডিয়া (শুধু যদি দ্রাবিড় বা জাদেজা হিরো হয়) জিতলে সেইসব নিউজপেপার কাটিং জমিয়ে রাখতাম। বেড়াতে গেলেও হোটেলের ঘরে টিভি থাক্তেই হবে। ম্যাচ মিস করলে চলবে না। বাড়িতে ফোন করে বলে রাখতাম, খবরের কাগজ যেন তুলে রাখা হয়। সেই ডায়েরিটাও দিনদিন মোটা হতে লাগলো। স্মৃতিতে ঠাসা। হ্যাপি মেমোরিজে ভরপুর।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট সেই আমলে ছিল একটা বিরাট যজ্ঞ। একটা গ্র্যান্ড সেলিব্রেশন। হইহই করে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই শিডিউল কেটে রাখা খবরের কাগজ থেকে। কে কাকে সাপোর্ট করবে, সেই নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা। বিভিন্ন প্রোডাক্ট কিনলে কত ওয়ার্ল্ড কাপ দেখতে যাওয়ার সুযোগ, এই ফাঁদে পা দিয়ে একটার পর একটা অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাবাকে দিয়ে কেনানো, এবং প্রতিবার ওই "বেটার লাক নেক্সট টাইম" পেয়ে সাময়িক হতাশ হওয়া। বিশ্বকাপের স্মৃতি বলতে হঠাৎ মনে পড়ে যায়, কোন একবার,কোয়ার্টার ফাইনালে ইন্ডিয়া পাকিস্তান খেলা চলছে। এদিকে আমি দাঁতের ডাক্টারের চেম্বারে, ই ই ডি এফে। দাঁত তোলার যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বাড়ি ফিরেই টিভির সামনে।
সেইসব দিন গেছে। বারাবারি রকমের ক্রিকেট শুরু হওায় প্রথম প্রথম চেষ্টা করলেও এখন আর তেমনভাবে ফলো করতে পারি না। তবুও ভেবেছি, এই বছর বিশ্বকাপ দেখবো। হয়তো প্রতিটা ম্যাচ, প্রতিটা বল ফলো করা যাবে না, তাও, যতদূর সম্ভব। দেখবোই। এবং সেই আগের মত নিয়ম করে স্পোর্টসের পাতা পড়বোই। আফটার অল, ক্রিকেট বিশ্বকাপ মানেই যেন সেই ফেলা আসা শৈশব, কৈশোর।
আজ থেকে শুরু হচ্ছে আবারও। সেই মহারণ।



শহরের পাঁচালি ৬

সারা বছর দাঁতে দাঁত চিপে রেখে কাজ করে যায় চিত্রাংশী। ভীষণ হোমসিক লাগে মাঝেমধ্যেই, তবুও, ছুটি ও নেয়না। সমস্ত ছুটি জমিয়ে রাখে এই আশ্বিনের শারদ প্রাতের ক'টা দিনের জন্য। সারা বছর বসের চোখ রাঙানি, সহকর্মীদের সাথে বাদানুবাদ, সব মাথা পেতে নেয়, মুখ বুজে সহ্য করে নেয়।

আরে বাবা, পুজোর এই কয়েকটা দিন যদি আপনজনেদের সাথে নাই থাকা হলো, তো কী লাভ? সক্কাল হতে না হতেই স্নান সেরে নতুন জামা পরে দিদিমণির হাত ধরে প্যান্ডেলে যাওয়া, তারপর কোনমতে অঞ্জলি দিয়ে প্রসাদ খেয়েই বন্ধুদের দলে ভিড়ে যাওয়া। সারাদিন এ প্যান্ডেল ও প্যান্ডেল ঘুরে খেয়ে দেয়ে ঘেমে নেয়ে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফেরা। তবে সেও বেশিক্ষণের জন্য না। আবার তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে নেওয়া। সন্ধ্যের স্পেশাল সাজ। সবচেয়ে দামী আর ঝলমলে পোশাক এই রাতের জন্যই। তারপর হুড়মুড় করে এসে পৌঁছনো প্যান্ডেলে। ইতিমধ্যেই বন্ধুরা সব হাজির। পাড়ার মন্ডপের জলসা শুরু হবে যে। চলবে এন্তার ফুচকা, এগ রোল, বুড়ির মাথার পাকা চুল, কোল্ড ড্রিঙ্ক। এ কদিন সমস্ত ডায়েট যাবে শিকেয়, গুরুজনদের শাসন কাজ করবে না। অনেক রাত অবধি চলবে আড্ডা, ঝারি মারা। ব্যাকগ্রাউন্ডে কচিকাচাদের নাচ, গান। বড়দের নাটক। তারপর অনেক রাত অবধি বাংলা ব্যান্ডের গান। চন্দ্রবিন্দু, অভিলাষা... পরেরদিন অষ্টমী হলে আবার আরেক প্রস্থ মিটিং। কাকিমাদের সাথে। কে কোন দায়িত্বে থাকবে। চিত্রার খুব ভালো লাগে সন্ধিপুজোর কাজ করতে। একটা অদ্ভুত রকমের সৌন্দর্য যেন মায়ের মূর্তিতে দেখতে পায় ও। চিত্রা ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। জগতজননীর মধ্যেই খুঁজে পেতে চায় বারবার তাই নিজের মাকে।

Wednesday, May 29, 2019

১।

সাতাশ বছর বয়স হতে চলল, তবুও নামের শেষে ছাত্রী তকমাটা কিছুতেই আর কাটাতে পারেনা ঘুঙুর। ঘুঙুর, ভালো নাম লাবণ্যপ্রভা দাশগুপ্ত। বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করছে। আপাতত গরমের ছুটিতে দু সপ্তাহের জন্য কলকাতা এসেছে। এবং এসেই এই কটা দিন চুটিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ এই বন্ধু, কাল ওই বন্ধু। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি। সব জায়গার যত বন্ধুরা কলকাতায় আছে, সক্কলের সাথে দেখা না করেই নয়। এইসব ক্ষেত্রে অবশ্য চাকুরিরত বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে একটা জিনিস বুঝেছে ও। যতই চাকরি ও তার সাথে মোটা মাইনের হাতছানি এখনও অধরাই রয়ে গেছে ওর কাছে, তবুও, এই ছাত্রীজীবনে বেশ আরাম, বেশ আয়েশ। 

Monday, May 27, 2019

শহরের পাঁচালি ৫

প্লেনটা যখন ল্যান্ড করলো কলকাতার বুকে, এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো অমৃতার। আজ কতগুলো বছর পরে ও ফিরলো নিজের জন্মভূমিতে। তা, প্রায় পনেরো বছর তো হবেই। হ্যাঁ, ঠিকই তো। ক্লাস এইটে সেই যে মা বাবার হাত ধরে ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি চলে যাওয়া... তারপর দেশে এলেও কলকাতায় আর আসা হয়ে ওঠেনি। দাদু ঠাকুমার বাড়ি দিল্লী আর দাদু দিদিমা মামার কাছে ব্যাঙ্গালোরে। কাজেই পনেরো বছরে দেশে বার দশেক এলেও তিলোত্তমার সাথে দেখাটা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এইবারে যদিও ব্যাপারটা ঠিক "ফেরা"র মত ফেরা না হলেও, কাজের সূত্রে এইবারে অন্তত ছ'মাস থাকবে অমৃতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভিসিটিং স্কলারের পদ নিয়ে এসেছে। ইচ্ছে পি এইচ ডির একটা অংশ এখান থেকেই করবে।
কলকাতায় জন্ম এবং টিনেজের শুরু অবধি এই শহরেই কাটানোয়, কলকাতা অমৃতার বড্ড প্রিয়, বড়ই আপন। সেই দেশপ্রিয় পার্কের প্রাইমারি স্কুল, তারপর তিন বছর সেলিমপুরে হাই স্কুল। এরই মধ্যে কত কত বন্ধুত্ব, কত মুহূর্ত... গত পনেরো বছরে যা প্রতিনিয়ত মনে পড়েছে অমৃতার। সেই নীল রঙা স্কুল বাস, ছোট্ট ছোট্ট সিট। ঢিকিস ঢিকিস করতে করতে লেক গার্ডেনসের ভিতর দিয়ে সবাইকে তুলতে তুলতে যাওয়া। রাস্তায় মিনিবাস, এমনি বাস। অটো। হলুদ কালো ট্যাক্সি। রিকশা। বড় মিস করেছে ও। বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাথেই ইমেল ও এখন ফেসবুক হোয়াটসআপের সৌজন্যে যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই যে সামনাসামনি দেখা, কোলাকুলি, খুনসুটি... এসবের অভাব অবশ্যই বোধ করেছে অমৃতা। ইংল্যান্ডের বন্ধুত্বগুলো অবশ্যই ভালো, অন্যরকমের, কিন্তু কলকাতার বন্ধুগুলোর আলাদা টান। অমৃতা ভাগ্যবান, ওর সমস্ত কাছের বন্ধুগুলো সব্বাই কলকাতাতেই রয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ চাকরি করছে, কেউ বা পড়ছে। তাই এই ছ'মাস ওর ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হবেই হবে। শহরটা এই পনেরো বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। নতুন নতুন ঝাঁ চকচকে ক্যাফে, মল, রেস্তোরাঁ, মাল্টিপ্লেক্সে ছেয়ে গিয়েছে। ফেলে যাওয়া শহরটার সাথে যেন এই নবরূপী কল্লোলিনীকে মেলানোই যায় না।
আজ বিকেলে ওদের বন্ধুদের গ্রুপের মিনি রি-ইউনিয়ন। অপালাই সব ব্যবস্থা করেছে। অমৃতার অনারে। সোনালী, মিথিলা, সুরঙ্গমা, পলিন সক্কলের আসার কথা। ওদের স্কুলের কাছেই একটা নব নির্মিত ক্যাফেতে। চারটে নাগাদ। অমৃতা তো দুপুর থেকেই উসখুস করছে। কখন যাবে। কখন দেখা হবে সকলের সাথে। ঝটপট দুপুরের খাওয়া সেরে বান্ধবীদের জন্য আনা উপহারের ডালি নিয়ে পছন্দের হলুদ-কালো ট্যাক্সি নিয়ে চারটের আগেই পৌঁছে গিয়েছে নির্দিষ্ট ক্যাফেতে। মেসেজে সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে পৌঁছসংবাদ। সবাই এই আসছি, অলমোস্ট দেয়ার ও বলে দিয়েছে। এবার ক্ষণিকের অপেক্ষা। একটা কোল্ড কফি অর্ডার করে অমৃতা বসে থাকে, অপেক্ষায়। ঘড়ির কাঁটা ছুটতে থাকে আপন বেগে। রবিবার বিকেলের কলকাতা আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়েছে উইকেন্ড উদযাপন করতে। মাঝে মাঝে ফোন আর মাঝে মাঝে দেওয়ালের মস্ত ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যায় অমৃতার। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে পেরিয়ে যায়। সত্যিই, বেঙ্গলি স্ট্যান্ডার্ড টাইম কি আর সাধে বলে? কিছু কিছু জিনিস অবিকল এক থেকে যায়। এমন সময় হঠাৎ উল্টোদিকে নজর পড়ে অমৃতার। দেখে ট্যাক্সি থেকে বোঁচকা মত ব্যাগ নিয়ে নামছে  পলিন। এবং আলুথালু অবস্থা। পরনে লাল কুর্তি, নীল জিন্স। অমৃতার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই স্কুলবেলার পলিন। লাল স্কার্ট সাদা ব্লাউজের ইউনিফর্মে, পিঠে ব্যাগ, হাতে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে এমন হন্তদন্ত হয়েই স্কুলে ঢুকত ওর নানুর হাত ধরে। স্মিত হাসে অমৃতা। সত্যিই, কিছু কিছু জিনিস, অবিকল এক থেকে যায়। অনন্তকাল ধরে। আর তাতেই বুঝি সযত্নে থাকে প্রিয়জনেরা, প্রিয় মুহূর্তেরা। 

শহরের পাঁচালি ৪

"বাবু, ব্যাগটা ভীষণ ভারী হয়ে আছে। আরেকটা হ্যান্ডব্যাগ নে। মিষ্টিগুলো ভরে নে ওতে।"

"ওষুধগুলো ঠিক করে রাখ। সবকটা নিয়েছিস তো?"

"বাবলু, এবার তাড়াতাড়ি পাততাড়ি গুটিয়ে ফের।"

"সাবধানে যাস।"

ট্যাক্সিতে বসে বসে বাড়ির লোকজনের কথাগুলো বারবার মনে পড়ছিল ওর। এত বছর হয়ে গেল বাড়ি ছাড়া। তবুও অদ্ভুত মন কেমন করে বটে, প্রত্যেকবার। 

তবু, এবারে একটা বাড়তি মন খারাপ। বিষণ্ণতা। যার থেকে ছিল অনেকটা প্রত্যাশা, সেই যে এরকম করলো... এখনও অবিশ্বাস্যই লাগছে। 
প্রতিবার ফোনটা ভাইব্রেট করছে, মনে হচ্ছে, ওর ফোন না তো? বা নিদেনপক্ষে একটা মেসেজ?

একটু পরেই এয়ারপোর্টে ঢুকে যাবে। তারপরেই ফ্লাইট। আর ফোন বা মেসেজের সুযোগ নেই। 
এই ট্র্যাফিক জ্যামটা বড্ড ভালো লাগছে ওর। কিছুই না। একটু সময় কিনে নেওয়া। 

ব্যস্ত শহর যেন আজ ওকে এই কুড়িয়ে পাওয়া কিছু মুহূর্তই উপহার দিচ্ছে, বিদায়ে।

Saturday, May 25, 2019

শহরের পাঁচালি ৩

টং টং করতে করতে শহরের ঘুম ভাঙ্গিয়ে ট্রামটা বেরলো ডিপো থেকে। রাস্তাঘাট শুনশান। রাতের শাটার এখনও নামানো। শেষ রাতের অল্প বৃষ্টির নরম প্রলেপ এখনও শহরের ক্ষতস্থানে প্রলেপ বোলাচ্ছে।
তবুও তারই মধ্যে দেখা যায় ব্যস্ত ত্রস্ত মায়ের হাত ধরে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা বেড়া বেনী, সাদা ফ্রক, পিঠে আলজেব্রা-টরিসেলি-সালোকসংশ্লেষ-এল নিনোর ভার বয়ে হাঁটছে মুনিয়া। ওর ভার যে লাঘব করতে হবে, ক্ষণিকের জন্য হলেও।
আবার ওই যে, পদ্মপিসি চলেছে। হাতে ঘটি। প্রতিদিন সকালের মত আজও যে গঙ্গা মায়ের সাথে সাক্ষাৎটা বাকি।  পান চিবুতে চিবুতে একটু সিরিয়াল-হেঁশেলের গল্প বাকি।
দীর্ঘ রোগে ভুগে জীর্ণ চক্কোত্তি খুড়ো হাতে বাজারের থলি নিয়ে বের হয়েছেন একটু টাটকা আনাজের সন্ধানে। অনেকদিন পর নাতিবাবুকে নিয়ে কন্যার বাপের বাড়ি আগমন আজ। চাঙ্গা করতেই হবে ওঁকে।
মুকুন্দ চলেছে চালপট্টির দিকে। আজকে কাজ না পেলে যে সন্ধ্যেয় হাড়ি চড়বে না। সাহস চাই, চাই ভরসা।
কাজল কালো উদাসীন এক জোড়া চোখ তাকিয়ে রয়েছে জানলার বাইরে। মন ভালো নেই ঊর্মির। মর্নিং কলেজের নিয়ম যদি ভুলিয়ে রাখতে পারতো মুহূর্তগুলিকে।

কাঠের সিট। লোহার শিকের বেয়াব্রু। লজ্ঝরে ট্রাম। আজ শেষবারের মতো বেরলো ডিপো থেকে।
কাল থেকে ওর ছুটি। অনন্ত অবকাশ। আসবে আধুনিকা। সে এক অন্য গল্প। মানুষগুলো সব এক থাকবে। হয়তো। হয়তো না। ভাগ্য কারুর ফিরবে। হয়তো। হয়তো না।
শুধু গুটিকয়েক পড়ে থাকবে স্ক্র্যাপের অপেক্ষায়...

 

Friday, May 24, 2019

শহরের পাঁচালি ২


মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে এই সপ্তাহেই। তিতলি বেশ ভালোই নম্বরও পেয়েছে, প্রায় ৮৫%। সেই নিয়ে গত কয়েকদিন বাড়িতে বেশ উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও উদযাপনও হলো। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব অনেকেই বাড়ি বয়ে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন। তাঁদের সকলের জন্য শরবত মিষ্টির ব্যবস্থা করতে করতেই অনেক কটা টাকা খরচা হয়ে গেলো এই চক্করে। মাসের প্রায় শেষের দিক, পকেট এদিকে গড়ের মাঠ। স্নান সেরে বেরিয়ে ঠাকুর প্রণাম করতে করতে মলয় ভাবেন, "মেয়েটাকে তো ডাক্তার বানাতেই হবে। কত স্বপ্ন। এই তো লড়াই শুরু। ঠাকুর, দেখো। সাথে থেকো।"

রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁক ছোক শব্দ শোনা যায়। সেই কোন ভোরে উঠে একা হাতে সমস্তটা সামলায় পলি। তাড়াহুড়ো করে রান্না সারতে হবে, নইলে মলয়ের অফিসের দেরি হয়ে যাবে। এখন তো অফিস বাড়ি অন্য জায়গায় বদলে যাওয়ায়, যাতায়াতের সময়টাও এগিয়ে এসেছে, পড়েছে পলির ওপর বাড়তি চাপ। এই সময়টা পলিকে জ্বালাতন করতে মোটেই ইচ্ছে করেনা মলয়ের। কিন্তু কীই বা করবে। খুব দরকার এখন ওকেই। এই একটু আগে তিতলি এসে ফর্দ ধরিয়ে গেলো। টিউশন ক্লাসের স্যারেরা সব বইয়ের লিস্টি ধরিয়ে দিয়েছেন। এক আধটা তিতলি ওর মামাতো দাদা বাবাইয়ের থেকে জোগাড় করেছে বটে, কিন্তু তাও বায়োলজির বইগুলো লাগবে। লিস্ট দেখেই মলয়ের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। দাম ভালোই হবে। এদিকে এই গত পরশু তিতলির ইলেভেনের ভর্তির জন্য আড়াই হাজার টাকা জমা করতে হলো। মাসের শেষে ছ-ছটা স্যারেদের মাইনে বাবদ আরো হাজার পাঁচেক। এর মধ্যে আবার বইয়ের এই ফিরিস্তি। কী করে যে কী সামলাবে, ভেবে পায় না মলয়। অফিসের সহকর্মীদের খাওয়ানোর আব্দার না হয় সামনের মাস অবধি ঠেকিয়ে রাখতেই হবে, নিরুপায়। কিন্তু তিতলির বইগুলো... আনতেই হবে, যে ভাবে হোক। মেয়েটার মধ্যে যে প্রতিভা আছে, তাকে আগলে রাখতেই হবে। পলির কাছে ওর জমানো কিছু টাকা যদি থাকে, তবে খানিক সুরাহা হয়।

সন্ধ্যে আটটার দিকে ভিড় কলকাতার জনবহুল ব্যস্ত রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামে বাসটা আটকে। প্রচন্ড গরম, অস্বস্তি। বারবার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছে মলয়। বসার জায়গা পায়নি। আশেপাশের লোকজনের মধ্যে একটা বিরক্তি। অন্যদিনের মলয়ের সাথে তাঁদের কোন অমিল নেই। কিন্তু আজ মলয় আলাদা। আজ মলয়ের মনে অনেকটা নিশ্চিন্তি। স্বস্তি। তিতলির বইগুলো সব জোগাড় হয়েছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে মাথায় এলো কথাটা। মলয় বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে লিস্ট হাতে সোজা চলে আসে কলেজ স্ট্রিট। তারপর এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে, দরদাম করতে করতে অবশেষে লিস্ট মিলিয়ে সবকটা বই কেনা হলো। সিংহভাগই জুটে গেলো পুরনো বইয়ের দোকানে। ফলে, সাশ্রয়টাও মন্দ হলো না। পকেটও খুশি, মনও। পলির জমানো টাকাটা থেকে কিছুটা বাঁচানো গেছে। তিতলির বইও সব এসে গিয়েছে। বাড়তি পরিশ্রম হলো বটে আজ মলয়ের, কিন্তু লং টার্ম সুবিধের কাছে এ তো নগণ্য। মেয়েটাকে যে ডাক্তার বানাতেই হবে। স্টলে স্টলে ডাক্তারি বই, যন্ত্রপাতি দেখতে দেখতে আরো একবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মলয়। খরচা অনেক। জানে ও। কিন্তু সামলে দেবে। হাজার হোক, কলেজ স্ট্রিট আছে তো।

যার কেউ নেই, তার বুঝি কলেজ স্ট্রিট আছে।

Thursday, May 23, 2019

শহরের পাঁচালি

উঁচু সিলিংটা থেকে ঝোলা লম্বা ডান্ডা দেওয়া প্রাচীন পাখাটা চলতে চলতে হুঠ করে থেমে যায়। ধুর, আবার লোডশেডিং। শ্রীময়ী গ্রিল দেওয়া জানলার ধারে সাদার ওপর হাল্কা লাল সবুজ নীল সুতোয় এমব্রয়ডারি করা বালিশে হেলান দিয়ে "সেই সময়" পড়ছিলো। গত জন্মদিনে অম্বরীশের উপহার। সকাল থেকে ঘরদোরের সমস্ত কাজ কর্ম সেরে এই দুপুরেই একটু যা সুযোগ পায় বই পড়ার। মনে হচ্ছে আজকের মত বই পড়া শেষ। ওদের এদিকটায় আজকাল মাঝে মাঝেই দুপুরে কারেন্ট চলে যাচ্ছে। আর একবার গেলে, ফিরতে ফিরতে সেই তিন চার ঘন্টার ধাক্কা। শ্রীময়ী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। শাড়িটা ঠিক করে আলতো হাতে খোঁপা বেঁধে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে জরিপ করলো। হুম, ঠিকই আছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা সিঁদুর কৌটো থেকে একটু সিঁদুর আঙুলের ডগায় মাখিয়ে কপালে টিপ পরলো। হ্যাঁ, এইবারে যথাযথ হলো।

বারান্দায় এসে দাঁড়ালো শ্রীময়ী। ওদের এই বাড়িটার বয়স, প্রায় একশো। অনেক শরিক। তবে দায় দায়িত্ব প্রায় কেউই নেয় না। অনেকদিন বাড়িটা রঙও হয়নি। ভিতরে ভিতরেও মেরামতের প্রয়োজন নেহাত কম না। তবে লোকেশন খাসা। এক্কেবারে বঙ্কিম চ্যাটারজী স্ট্রীটের ওপর। বারান্দায় দাঁড়ালে, সামনেই কলেজ স্কোয়ারের জলাশয়। রাস্তাঘাট শুনশান। গরমে সবাই হয় বাড়িতে, নয় অফিসে। শ্রীময়ী খেয়াল করলো, বাড়ির উল্টোদিকের স্টলগুলিতে দোকানদারেরা হাতপাখা নিয়ে বসে। বৃথা চেষ্টা, একটু ঠাণ্ডা হওয়ার। একটা দুটো খরিদ্দার আসছে মাঝে মধ্যে। ওই টুকটাক কিছু কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক দরদাম করে। আবার কেউ কেউ খালি হাতেই ফিরছে। দোকানীদেরও যেন উৎসাহ নেই আর। সারাদিনের গরমে ওরাও ক্লান্ত।

দু চারটে ছেলে মেয়েকে দেখা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে বেশ কলকল কলকল করতে করতে আসছে। ওদের কয়েকজনের হাতে বড় দামী ক্যামেরা। এদিক ওদিক দেখছে আর মাঝে মধ্যেই টুকটাক ছবি তুলে যাচ্ছে। নির্ঘাত সব কলেজ স্টুডেন্ট। অন্তত বয়স দেখে তাই মনে হয়। হয়তো কলকাতার বাইরে থাকে। ছুটিতে এসেছে। বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরনো শহরে। শ্রীময়ীর মনে পড়ে যায়। ওরাও এক সময় কত এমন ঘুরত। আজ রবীন্দ্র সদন, কাল পার্ক স্ট্রিট, পরশু বাবুঘাট। কতদিন তো বই কিনতে এই বইপাড়াতেও চলে আসত। তারপর কেনাকাটি মিটিয়ে কফি হাউজে বসে খাওয়া, গল্প। সেদিনের সেই মধুমিতা, প্রীতিলতা, সুবর্ণ, সব কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখাই হয় না কতদিন। একটা মৃদু আক্ষেপ হয় শ্রীময়ীর।

শোওয়ার ঘরের বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে পাঁচটার ঘন্টা বাজে। আস্তে আস্তে কলেজ স্কোয়ারের দিকে ভিড় বাড়তে থাকে। প্রবল উৎসাহী এক দল বাচ্চা আর ততোধিক উৎসাহী তাদের মায়েরা। শুরু হবে ব্যায়াম। কসরত। সাঁতার। বারান্দায় মোড়া পেতে বসে একের পর এক দৃশ্য দেখতে থাকে শ্রীময়ী। সত্যিই, এখানে কত প্রাণ। এই একটু আগের নিস্তব্ধ রাস্তাঘাত এখন কেমন নব প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরপুর। শ্রীময়ী ভাবে, ওর জীবনটাও তো তেমনই। এই সারা দুপুর সব শান্ত, স্তব্ধ। আবার খানিক পর থেকেই আবার শুরু হয়ে যাবে তোলপাড়। ব্যস্ততা। লোকে লোকারণ্য হবে রাস্তা। ওর বাড়িও গমগম করবে পরিবারের সকলের সান্নিধ্যে।


Wednesday, May 22, 2019

কলকাতায় সকাল ছটা মানেই চড়া রোদ। এখানে ভোর হয়ে যায় সেই ক-অ-খ-ন। যখন কালো রেডিওটাতে জগন্নাথ বসুর "কালি কথা" শুরু হয়। যখন জেঠু শীত গ্রীষ্ম বর্ষা নির্বিশেষে মোজা জুতো পরে সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটতে বেরিয়ে যায়। মা ততক্ষণে বাসি বিছানা ছেড়ে ফ্রিজ থেকে ডাল তরকারি বের করে ফেলেছে। ঘুম ঘুম চোখে মায়ের চোখ রাঙানি অগ্রাহ্য করে তখন সারা রাত ধরে আসা প্রিয়জনগুলোর নোটিফিকেশন দেখতে দেখতে চলে একটু দিনযাপনের রসদ জোগাড়। 
কষ্টে সৃষ্টে রাতের অপূর্ণ ঘুমকে সাময়িক টাটা বাইবাই করে বাবার সাথে বেরিয়ে পড়া "মর্নিং ওয়াকে"। দিনদিন সময় এগোচ্ছে। একটু গরম কম হবে, এই আশায়। কিন্তু, ঠান্ডা হাওয়া? কোথায় কে? শহর তখন ব্যস্ত রোজের কাজে। গলি গলি থেকে রিক্সায় ভ্যানে মায়ের হাত ধরে স্কুল যাচ্ছে সাদা লাল নীল চেক স্ট্রাইপ ইউনিফর্ম। সাইকেল চড়ে এক দল মুর্গি চলেছে ভবিতব্যের পানে। ল্যাম্প পোস্টের তারে দু পা অন্তর জোড়া শালিক। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলি ফিঙের আরামকেদারা। ইয়া লম্বা ঝাঁটা দিয়ে চলছে ধুলো উড়িয়ে রাস্তা পরিষ্কার। ঠ্যালা গাড়িতে করে শহুরে বাবুদের জন্য আসছে "এক্কেরে ফিরেশ" সব্জি, ফল। মাঠে পার্কে কিছু হতাশ মানুষের জোর করে হা হা হাসি। পোশাকি নাম? লাফিং ক্লাব। ছেলেমেয়েদের ড্রিবলিং প্র্যাকটিস। 
"সর্বশিক্ষা অভিযান" লেখা বিরাট স্কুল বাড়িটা কেবল শান্ত। চুপচাপ দাঁড়িয়ে। গরমের ছুটিতে এখন একটু জিরিয়ে নেওয়া। রবিবার আসতে এখনও ঢের বাকি। ঘুঙুরের শব্দে আর কত্থকের বোলে মুখরিত ছোটবেলাটা যে এখনও "লোডিং"।

Tuesday, May 21, 2019

- মন খারাপ।
- কেন?
- আজকে আমার তোর ওখানে যাওয়ার কথা ছিল। টিকিটটা ক্যান্সেল করলাম।
- হুম।
- কতদিন দেখিনা বল তো?
- একজ্যাক্টলি পাঁচ মাস হচ্ছে আজ।
- রাইট, জিরো রিলিজ করেছিল। ওইদিনই তো মিট করেছিলাম।
- তখনই বোঝা উচিত ছিল। অমন নামের সিনেমা বেরলো, অপয়া যত।
- এ আবার কী কথা? তা বলে ২১ তারিখ আর কিছু ভালো হয়নি কখনো?
- না হয়নি।
- বললেই হল?
- তুই বল কী ভালো হয়েছে।
- এই যে, আমাদের দেখা হয়েছিল।
- সে তো কত দেখা হয়েছে ওরকম। ২১, ২২, ৩০, ৩২...
- তাও, লাস্ট দেখা তো ওদিন। অলওয়েজ স্পেশাল।
- ও, শেষ দেখা বলে স্পেশাল? মানে শেষ হল, তুই বাঁচলি, বল?
- বোঝো কান্ড।
- সব বুঝি হে।
- ছাই বুঝিস।
- তুই বোঝা দেখি?
- ওই যে শেষ দেখলাম... এক বুক আশা নিয়ে তবে থেকে তো রয়েছি। আবার কবে তোর ওই পাখির বাসার মত চোখ দুটোয় প্রাণভরে নিজেকে ডুবিয়ে দেবো।
- থাক, আর কাব্য করতে হবে না।
- এটা কাব্য নয়। তবে সাহিত্য বলতেই পারিস।
- ওই হলো।
- ঝগড়া করে মুড ভালো হলো?
- ভীষণ।
- ভেরি গুড!

Friday, May 17, 2019

রুমুন বাড়ি ফিরে অবাক। এ কী? না হয় ভোটের বাজারে চারিদিক গরম, কিন্তু ওর বাড়িতে এমন চিৎকার চেঁচামিচি কীসের?
"ধর ধর। ওই তো। মার ব্যাটাকে।"
"ওই যে, মীনা, ওইদিকে। যা মার।"
"পারলি না? আরে ওই তো..."
"এর মধ্যে পঁচিশটাকে মেরেছি। একটাও যেন আস্ত না থাকে। ধরে ধরে মার।"
মায়েরই তো গলা। উঠোন দিয়ে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে এইসব শুনে রুমুনের চমকে যাওয়ার অবস্থা।
কিন্তু, কই কাউকে দেখা যাচ্ছে না যে?
ব্যাগ থেকে সদরের চাবিটা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে মা আর মীনাদি ঝ্যাঁটা হাতে। রণং দেহী মূর্তি দুজনেরই।
একটু খোঁজ খবর করতে জানা গেলো, ব্যাপার আর কিছু না।
মা ভার্সেস আরশোলা ওয়ার্ল্ড ওয়ার চলছে। "কালা হিট" স্প্রে হয়েছে। নিরীহ জীবগুলো ছোটাছুটি করছে প্রাণের দায়ে।

চোখে পড়ল এতক্ষণে। দরজার বাইরে ডাস্টবিনে সারি সারি মৃতদেহ। আরশোলার।
রেস্ট ইন পিস!!

(অগ্নিকে খুঁজবেন না প্লিজ! রুমুন দেখলেই অগ্নিকে চাই নাকি?? :P )

Thursday, May 16, 2019

গ্রীষ্ম চরিত ২

# সকাল থেকে এই নিয়ে বোধহয় পঞ্চাশটা বাড়ি গিয়ে গিয়ে চিঠি বিলি করলো সুশান্ত। এই গরমে, তেতে পুড়ে। বাড়ির লোকগুলো কলিং বেলের আওয়াজে বিরক্ত। এসির আরাম ছেড়ে বেরোতে ভালো লাগে নাকি?
কুরিয়ারের ছেলেটাকে এক গ্লাস ঠান্ডা জল দিতেও মনে পড়ে না বিরক্তিতে।

# রোব্বার ভোটটা মিটলে বাঁচে বলবন্ত সিং। এই রোদে পোলিং বুথের বাইরে উর্দি পরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা...

# "বৌদি, কাল আসবো না। এতো গরম পড়েছে, রাত্রে ঘুমোতে পারি না। কাল একটু বেলা করে উঠবো তাই।"
"ইশ, আগে বলবে তো দিদি। দাদাকে দিয়ে একটু বেশি সব্জি আনিয়ে রাখতাম। আরেকটু বেশি করে রাঁধিয়ে রাখতে পারতাম তোমায় দিয়ে। এখন এই গরমে আমায় কাল আবার হেঁশেল ঠেলতে হবে। ধুর ধুর।"


ভালোবাসিস?
খুউউব।
ছেড়ে যাবি না?
কোনোদিনও না।
কথা রেখেছে। রয়ে গেছে ফেসবুক জিমেলের পাসওয়ার্ড হয়ে।

Wednesday, May 15, 2019

# সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া মুর্গিগুলো দেখে খারাপ লাগছিল ছাগলটার। খেয়াল করেনি, পিছনেই দাঁড়িয়ে কসাই বিষ্টু।
# বৃদ্ধাশ্রমের ফোনটা কিছুতেই ধরছেনা কেন, কী হলো মায়ের?
ওমা, এক্কেবারে দেখতে ছুটে চলে এলি খোকা?
# ওয়েটিং লিস্ট টিকিট। দরজার সামনে চাদর পাত। কয়েক রাউন্ড টুএন্টি-নাইন। ২৯ঘন্টা কবেই সাবাড়!
# বাবু, একবার শুনে যা।
আবার কী?
এমনি। মুখটা দেখতে ইচ্ছে হলো।
উফ।
...............
মা, ওমা। সাড়া দাও।
# আজ বাজারে কী পেলে?
মেয়ের পছন্দের আনারস।
আর বাবার পছন্দের হিমসাগর?
হবে না হয় পরে!
শুনলাম এখন বুঝি দশ শব্দের গল্প বলার ট্রেন্ড শুরু হয়েছে। 
***********************************
$ সুখ কারে কয়?
গরম আলু ভাতে, ঘি আর লঙ্কা পিঁয়াজ।
$রেজাল্টটা শেষমেশ পজিটিভই এলো। এক বুক হতাশা। পরীক্ষার পেপারটা HIV।
$বাজতে বাজতে টেলিফোনটা থেমে গেলো। নম্বর অপরিবর্তিত থাকে, সম্পর্কেরা পাল্টায়।
$ঝড় উঠেছে ঈশান কোণে। ঝড় উঠেছে বুকে। প্রেম-বৃষ্টি ঝরে।
$যুদ্ধ শেষে মৃত প্রান্তরে সাদা পতাকাটা ব্যাঙ্গের হাসি হাসে।
$গরমের ছুটিতে কোথায়? দীপুদা?
উহু। ফেলুদা। ঘনাদা। টেনিদা।
$কালবৈশাখী। ছাদ। এক আকাশ তারা। তোর হাতে মাথা রাখার আরাম।
গ্রীষ্ম চরিত।

# "কোয়ালিটি, অ্যাই কোয়ালিটি।" ডাকতে ডাকতে আজও চলে যায় সেই পরিশ্রান্ত দেহ ঘেমো কাকুটা। একটা দিনও যার নিজের জোটেনা একটা স্টিক বা কাপ...

# জলের কলের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই অনেকটা শৈশব কেটে যায় ছোট্ট রুমির। কীই বা করবে, সারাদিন পর মা ঘেমে নেয়ে যখন বাড়ি ফেরে, টাইম কলের জল ততক্ষণে শেষ। আগে মা পারত। এখন পারে না। একটা বাড়ি এক্সট্রা রান্নার কাজ জুটেছে। নিতেই হল। ফ্যাক্টরিতে লক-আউটের পর থেকে একা মায়ের রোজগারেই যে সংসারটা চলছে।

# একটু খাবারের আশায় বেপাড়ায় গিয়েছিল পটলা। যে দিদিভাইটা ওকে রোজ আদর যত্ন করে দুবেলা খেতে দেয়, আজ তিনদিন হলো ওরা তালা চাবি মেরে কোথাও গেছে, তল্পিতল্পা গুটিয়ে। সামার ভেকেশন না কী বলে বোধহয়। বেপাড়ার যত উটকো কুকুরগুলো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তাড়া করে পটলাকে পাড়া ছাড়া করলো। পটলা কোনমতে বারান্দার ছায়ায় বসেছে। পটলা ধুঁকছে। খিদেয়। তেষ্টায়।

# অনেক কষ্টে পুরনো ত্রিপলটা জোগাড় করেছিল সুন্দরী। গতকালের কালবৈশাখীতে সেটাও উড়ে গেলো। আবার মাথার ওপর ছাদ জোটানোর লড়াই শুরু।

# ঋজুর স্কুলটা বন্ধ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তবুও শান্তি নেই। সেই প্রতিদিন টিউশন ক্লাসে যেতে হচ্ছেই। যেহেতু গত পরীক্ষায় নম্বর কম পেয়েছে, আবার এখন এক্সট্রা ক্লাস। খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, এবারের ছুটিতেও অধরাই রয়ে গেলো।
#জিরো_থ্রি_থ্রি

সায়েন্স কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলেই একটা উল্টোদিকের বাস ধরে চলে যেতাম হাতিবাগান। বা কখনো কখনো হাঁটতে হাঁটতেও পৌঁছে গিয়েছি। সেই অলস দুপুর। শতাব্দী প্রাচীন বাড়ির বারান্দাগুলো তখন ঝিম মেরে আছে। পলেস্তারা খসা গোলাপি সবুজ রেলিংয়ে সামনের কৃষ্ণচূড়ার ছায়া। ফুটপাথের হকার দাদারাও তখন একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। তারই মধ্যে ঘুরে ঘুরে কুর্তি সালোয়ারের সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে হরেক রঙের হরেক ডিজাইনের ঝুমকো দুল। অল্প দরদাম। টুকটাক প্রসাধনী। তারপর আবার গুটগুট করতে করতে রাস্তা পেরিয়ে অপেক্ষা। ২৩৪/১ এর। খুব খিদে পেলে কোনো রাস্তার সাধারণ টিমটিমে দোকান থেকে অসাধারণ স্বাদের নরম পাকের শাঁখ বা আম সন্দেশ কিনে খাওয়া। বাস আসতে চটপট উঠে পড়া। ফাঁকা বাস। পছন্দসই পিছনের দিকের টু-সিটার লেডিজ সিট। কানে ইয়ারফোনে তখন এভারগ্রিন গান। কিশোর আর ডি লতা।
বাস চলতে থাকে। প্রাচীন কলকাতার বুক চিরে। ঠনঠনিয়ায় কালীবাড়ির সামনে ঠিক একবার সিগনাল খাবেই। আলতো করে কপাল ছুঁয়ে প্রণাম। মা গো, ভালো রেখো। বৌবাজারের রোশনাই পেরিয়ে চলতে থাকি। বাসও, আর এফ এম এ আর জে ও। বাম্পার টু বাম্পার। চারটে বাজলো। এইবার ঘরে ফেরার পালা।

"There's nothing like Calcutta!"