বিকেল পাঁচটা। রোদের তেজটা একটু হলেও কমেছে। বেরোতে হলে এইবেলাই বেরনো উচিত, এই মনে করে কর্পোরেশন অফিসের ক্যাজুয়াল স্টাফ রবি গুটিগুটি পায়ে ফিরোজদার টেবিলের দিকে এগোল। ফিরোজ এই অফিসের বড়বাবু। ক্যাজুয়াল স্টাফেদের মাইনেপত্তর উনিই দেখেন। কাচুমাচু মুখ করে খানিক দাঁড়ালো রবি। ফিরোজ কোন কাগজপত্র ফাইল টাইল বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখছিলেন। রবি একবার গলা খাঁকড়ি দিলো। ফিরোজ মাথা তুলে তাকালেন, "কীরে রবি? কিছু বলবি?" রবি একটু হাত কচলে, ইতস্তত করে বলল, "ইয়ে মানে ফিরোজদা, আজ তো একত্রিশ তারিখ। এই মাসের মাইনেটা যদি আজ..." রবির কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফিরোজ বললেন, "সে তো জানি রবি। কিন্তু দেখ, ফাইল পাশ হয়নি। কী করে দিই বল তোকে?" কথাগুলো শুনে রবির মুখ চুন হয়ে গেলো। "আসলে কদিন বাদেই তো ঈদ দাদা, বউ আর ছেলে মেয়েদুটোর জন্য নতুন জামা কিনতে হতো..." ফিরোজ প্রবল দুঃখিত মুখে মাথা নেড়ে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেন। রবি মাথা নীচু করে ফিরে আসে নিজের টেবিলে। ঘড়ির কাঁটায় তখন পাঁচটা পনেরো।
জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখতে পায়, নিউ মার্কেট চত্বরের ব্যস্ততা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে। ছোট ছোট দোকান, বড় ঝাঁ চকচকে দোকান, সব জায়গায় দোকানিরা পসরা সাজিয়ে রেখেছে। উৎসবের মরসুম। বিক্রিবাট্টা ভালোই হবে, এই আশায়। ক্রেতারাও এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে পছন্দের জিনিস কিঞ্ছে, সামর্থ্য অনুযায়ী। রবির মনটা খারাপ লাগে। গত বছর ঈদে বউকে একটা সামান্য ছাপা শাড়ি আর ছেলে মেয়েদুটোকে ছিট কাপড়ের জামা প্যান্ট দিতে পেরেছিল। আর কিছু কেনার সামর্থ্য তখন ছিল না। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে, ওভার টাইম খেটে নিজের একটা একতলা বাড়ি বানিয়েছে ও। ভেবেছিল এ বছর অনেকটাই স্থিতি ফিরেছে, একটু ভালো করে দেওয়া থোওয়া করবে। মেয়েটাকে একটা জড়ির কাজের সালওয়ার কুর্তা, ছেলেকে শেরওয়ানি আর বউকে নকশি কাজের শাড়ি কিনে দেবে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে মাইনেই আসছে না। প্রতি সপ্তাহেই শুনছে এই তো, এই সামনের সপ্তাহে দেবে, কিন্তু টাকা আর আসে না। বিল পাশ হয়না। আন্দোলন করে করে ওরা ক্লান্ত। এবারের রোজাতেও তাই উপোস ভাঙতে ফলটলও খুব একটা কেনা হচ্ছেনা। বিষণ্ণ রবি দাঁড়িয়ে থাকে জানলার ধারে।
"রবি, এই রবি?" বর্ণালী দিদির ডাকে সম্বিৎ ফেরে রবির। "আসছি দিদি।" এই বলে রবি এগিয়ে যায় দিদির টেবিলের দিকে। দিদি এই অফিসের অন্যতম সিনিয়র। খুব হাসিখুশি মানুষ। সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করেন। আর তাই সক্কলে দিদিকে ভালোবাসে। রবি দিদির কাছে এসে দাঁড়ালে, দিদি একটা সাদা খাম ওঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন, "শোন রবি। এতে সামান্য টাকা আছে। তোর আর তোর পরিবারের জন্য ঈদি। কাপড় জামা কিনে দিস ওদের পছন্দমতো। আর আজকে দেখলাম নিউ মার্কেটে ভালো টাটকা লিচু এনেছে। নিয়ে যাবি এক কিলো। ছেলে মেয়ে আর বউকে খাওয়াবি। বুঝলি?" রবি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ায়। মুখে কোন কথা ফোটে না। "আরে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? নে ধর। আর বেরিয়ে পড়। দোকানে এরপর আরো ভিড় বাড়বে। যা কেনাকাটি কর। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফের।"
রবি কৃতজ্ঞচিত্তে নিজের জায়গায় ফেরে। মনে মনে আল্লার কাছে দিদির জন্য দোয়া চায়। সত্যিই, দিদির মতো মানুষ হয়না। ঠিক যেন ফরিশ্তা।
সেদিন রবি নিউ মার্কেট ঘুরে ঘুরে এ দোকান সে দোকান ঘুরে, ছেলে মেয়ে আর বউয়ের জন্য পছন্দসই জামা কেনে। আম আর লিচুও কিনে ফেলে এক কেজি করে। আহা, এতদিন পর, পরিবারের মুখে একটু হাসি ফুটবে। বাজারহাট করে যখন নিউ মার্কেট চত্বরের ভিড় ঠেলে ও হাঁটতে থাকে, সারাদিনের ক্লান্তি যেন আসন্ন খুশির আশায় কোথায় গায়েব। নতুন জীবনীশক্তিতে রবি তখন উজ্জীবিত।
No comments:
Post a Comment