Monday, May 27, 2019

শহরের পাঁচালি ৫

প্লেনটা যখন ল্যান্ড করলো কলকাতার বুকে, এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিলো অমৃতার। আজ কতগুলো বছর পরে ও ফিরলো নিজের জন্মভূমিতে। তা, প্রায় পনেরো বছর তো হবেই। হ্যাঁ, ঠিকই তো। ক্লাস এইটে সেই যে মা বাবার হাত ধরে ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি চলে যাওয়া... তারপর দেশে এলেও কলকাতায় আর আসা হয়ে ওঠেনি। দাদু ঠাকুমার বাড়ি দিল্লী আর দাদু দিদিমা মামার কাছে ব্যাঙ্গালোরে। কাজেই পনেরো বছরে দেশে বার দশেক এলেও তিলোত্তমার সাথে দেখাটা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এইবারে যদিও ব্যাপারটা ঠিক "ফেরা"র মত ফেরা না হলেও, কাজের সূত্রে এইবারে অন্তত ছ'মাস থাকবে অমৃতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ভিসিটিং স্কলারের পদ নিয়ে এসেছে। ইচ্ছে পি এইচ ডির একটা অংশ এখান থেকেই করবে।
কলকাতায় জন্ম এবং টিনেজের শুরু অবধি এই শহরেই কাটানোয়, কলকাতা অমৃতার বড্ড প্রিয়, বড়ই আপন। সেই দেশপ্রিয় পার্কের প্রাইমারি স্কুল, তারপর তিন বছর সেলিমপুরে হাই স্কুল। এরই মধ্যে কত কত বন্ধুত্ব, কত মুহূর্ত... গত পনেরো বছরে যা প্রতিনিয়ত মনে পড়েছে অমৃতার। সেই নীল রঙা স্কুল বাস, ছোট্ট ছোট্ট সিট। ঢিকিস ঢিকিস করতে করতে লেক গার্ডেনসের ভিতর দিয়ে সবাইকে তুলতে তুলতে যাওয়া। রাস্তায় মিনিবাস, এমনি বাস। অটো। হলুদ কালো ট্যাক্সি। রিকশা। বড় মিস করেছে ও। বন্ধুদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সাথেই ইমেল ও এখন ফেসবুক হোয়াটসআপের সৌজন্যে যোগাযোগ অবিচ্ছিন্ন রয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই যে সামনাসামনি দেখা, কোলাকুলি, খুনসুটি... এসবের অভাব অবশ্যই বোধ করেছে অমৃতা। ইংল্যান্ডের বন্ধুত্বগুলো অবশ্যই ভালো, অন্যরকমের, কিন্তু কলকাতার বন্ধুগুলোর আলাদা টান। অমৃতা ভাগ্যবান, ওর সমস্ত কাছের বন্ধুগুলো সব্বাই কলকাতাতেই রয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ চাকরি করছে, কেউ বা পড়ছে। তাই এই ছ'মাস ওর ওদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হবেই হবে। শহরটা এই পনেরো বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। নতুন নতুন ঝাঁ চকচকে ক্যাফে, মল, রেস্তোরাঁ, মাল্টিপ্লেক্সে ছেয়ে গিয়েছে। ফেলে যাওয়া শহরটার সাথে যেন এই নবরূপী কল্লোলিনীকে মেলানোই যায় না।
আজ বিকেলে ওদের বন্ধুদের গ্রুপের মিনি রি-ইউনিয়ন। অপালাই সব ব্যবস্থা করেছে। অমৃতার অনারে। সোনালী, মিথিলা, সুরঙ্গমা, পলিন সক্কলের আসার কথা। ওদের স্কুলের কাছেই একটা নব নির্মিত ক্যাফেতে। চারটে নাগাদ। অমৃতা তো দুপুর থেকেই উসখুস করছে। কখন যাবে। কখন দেখা হবে সকলের সাথে। ঝটপট দুপুরের খাওয়া সেরে বান্ধবীদের জন্য আনা উপহারের ডালি নিয়ে পছন্দের হলুদ-কালো ট্যাক্সি নিয়ে চারটের আগেই পৌঁছে গিয়েছে নির্দিষ্ট ক্যাফেতে। মেসেজে সবাইকে জানিয়েও দিয়েছে পৌঁছসংবাদ। সবাই এই আসছি, অলমোস্ট দেয়ার ও বলে দিয়েছে। এবার ক্ষণিকের অপেক্ষা। একটা কোল্ড কফি অর্ডার করে অমৃতা বসে থাকে, অপেক্ষায়। ঘড়ির কাঁটা ছুটতে থাকে আপন বেগে। রবিবার বিকেলের কলকাতা আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়েছে উইকেন্ড উদযাপন করতে। মাঝে মাঝে ফোন আর মাঝে মাঝে দেওয়ালের মস্ত ঘড়িটার দিকে চোখ চলে যায় অমৃতার। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে চারটে পেরিয়ে যায়। সত্যিই, বেঙ্গলি স্ট্যান্ডার্ড টাইম কি আর সাধে বলে? কিছু কিছু জিনিস অবিকল এক থেকে যায়। এমন সময় হঠাৎ উল্টোদিকে নজর পড়ে অমৃতার। দেখে ট্যাক্সি থেকে বোঁচকা মত ব্যাগ নিয়ে নামছে  পলিন। এবং আলুথালু অবস্থা। পরনে লাল কুর্তি, নীল জিন্স। অমৃতার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই স্কুলবেলার পলিন। লাল স্কার্ট সাদা ব্লাউজের ইউনিফর্মে, পিঠে ব্যাগ, হাতে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে এমন হন্তদন্ত হয়েই স্কুলে ঢুকত ওর নানুর হাত ধরে। স্মিত হাসে অমৃতা। সত্যিই, কিছু কিছু জিনিস, অবিকল এক থেকে যায়। অনন্তকাল ধরে। আর তাতেই বুঝি সযত্নে থাকে প্রিয়জনেরা, প্রিয় মুহূর্তেরা। 

No comments:

Post a Comment