Wednesday, May 1, 2019

Fan fiction OMG

এক মধ্যবয়সী সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি গৃহবধূ আর পাঁচটা উইকডের বিকেল সাড়ে চারটেয় যা করেন, আমাদের সরলাদেবীও মোটেই তার ব্যতিক্রম নন। স্টার জলসা, জি বাংলা আর এ বি পি আনন্দর অলিতে গলিতে রিমোটের সাহায্যে ঘুরছেন। সামনে আজকের আনন্দবাজারটা পড়ে আছে। সকালের টাটকা ভাঁজটা এখন আর নেই। এলোমেলো কাগজের পাতাগুলি গুছিয়ে রাখতে রাখতে রাখতে টিভির পর্দায় চলা দৃশ্য নিয়ে দিব্যি নিজের মনে সমানে চলেছে ধারাভাষ্য। "ইস, কী বোকা রে তুই, তোর বর ওদিকে  এদিক সেদিক ফষ্টি নষ্টি করে বেড়াচ্ছে, আর তুই তার জন্য এই এখনো ব্রত পালন করে চলেছিস। বোকা কোথাকার।" হঠাৎ দেওয়ালে টাঙানো সিলভার ঘড়িটার দিকে চোখ গেল। পৌনে পাঁচটা। "ও বাবা, আবার তো কৃষ্ণার আসার সময় হয়ে এলো। দেখি তার আগে যদি বাবুটার জন্য কিছু রান্না করা যায়। ছেলেটা সেই কোন সকালে বেরিয়েছে, কে জানে সারাদিন কী খেলো না খেলো। একবার ফোন করি, জিজ্ঞেস করি কী খাবে।"

সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলটা হাতে নিলেন সরলাদেবী। বাবুর থেকে মোটামুটি কাজ চালানোর মতো ফোন করা, হোয়াটসআপ করাটা শিখলেও এখনো তেমনভাবে আত্মবিশ্বাস আসেনি। তবুও টুকটুক করে চেষ্টা করে বাবুর নম্বরে ডায়াল করলেন। অপর প্রান্তে ফোন বাজছে। খানিক পরে বাবুর গলা শোনা গেল।

- হ্যালো।
- হ্যালো বাবুউউ?
- ইয়ো, বলো!
- এক থাপ্পড়। কতবার বলেছি না, আমায় এই ইয়ো ইয়ো করবি না?
- মা, ইয়ো-ইয়ো ইজ এ গেম। আমি তোমায় ইয়ো বলি। ইট ইজ কুল!
-ইয়ো-ইয়ো ইজ এ গেম, আমায় এটা শেখানো হচ্ছে? ছোটবেলায় সাপুইপাড়ায় মেলা থেকে তোর জন্য কষ্ট করে কে এনে দিতো ওই লাল গোলাপি নীল সবুজ প্লাস্টিকের খেলনা? ভারী এসেছে আমায় বড় বড় লেকচার শোনাতে!
-তুমি সাপুইপাড়ার মেলা থেকে আমায় ইয়ো-ইয়ো এনে দিতে?
-না। সে ওসব আনতাম না। কিন্তু কষ্ট করে, লাইন দিয়ে, ভিড় দোকান থেকে কত খুঁজে খুঁজে তোর জন্য বার্বি ডল এনে দিতাম। সেগুলো?
-মা হু প্লেইজ উইথ বার্বি?
-হ্যাঁ, এখন তো এসব বলবিই। তখন তো বুল্টির বার্বি দেখে কত কান্না জুড়তিস। মঞ্জু মাসির বাড়ি গেলেই তোর সে কি কান্না। বল? কাঁদতিস না? এখন লেকচার ঝাড়িস আমায়। বড় এসেছে আমার বখতিয়ার খিলজী।
-আমি? আমি মোটেই বার্বির জন্য কাঁদতাম না। সে বুল্টি আমায় ধরে পেটাতো, তাই কাঁদতাম। ভ্যা ভ্যা করে।
-এ বাবা। আর আগে বলবি তো। এদিকে আমি তোর বাবার সাথে ঝগড়া করে, মানিব্যাগ থেকে মাঝেসাঝে টাকা সরিয়ে কত কষ্ট করে তোর জন্য ঠিক বুল্টির মতো খেলনা জোগাড়ের চেষ্টা করতাম। জানিস, কম কথা শুনিয়েছে তোর বাবা এই জন্য আমায়? আমি বলতাম, দেখো, বাবু আমাদের এই এইটুকু ছেলে। ওর শখ আহ্লাদ পূরণ তো করতেই হবে। এখানে সব পাওয়া যায় না। না হয় তুমি একটু নিউমার্কেট থেকে খেলনা এনে দিলে। বুল্টির বাবা তো কী সুন্দর আনে। মঞ্জু উঠতে বসতে আমায় শুনিয়ে দেয়। কিন্তু না। তোর বাবার সেই এক বুলি। বুঝেশুনে খরচ করো। আরে বাবা, কী হাড় কেপ্পণ বাড়িতে যে আমার বিয়ে দিয়েছিল। তখন মা কে পইপই করে বলেছিলাম। এই বাড়িতে বিয়ে দিয়ো না। শুনলো না। সারা জীবন শুধু দাসীর মতো খাটিয়ে মারলো এরা আমায়। তোর আর তোর বাবার জ্বালায় আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল। ভাল্লাগেনা আমার।
-ব্যস, এই শুরু হলো আবার। মা ইউ আর ইনক্রেডিবল। যা ইচ্ছে, যে কোনো টপিক নিয়ে কথা বলতে বলো, ঠিক ঘুরে ফিরে সেই এক এক কথায় ফিরবেই। উফ।
-হ্যাঁ হ্যাঁ। তা তো বলবিই। যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর। জানিস? কতদিন নতুন শাড়ি কিনিনি। হলুদ মশলা লাগা এই ন্যাতা শাড়ি দিয়ে কাজ চালিয়েছি। ম্যাগাজিন কিনিনি। শুধুমাত্র টাকা জমিয়ে যাতে তোর জন্য খেলনাপাতি আর চকলেট কিনতে পারি। আর তুই, এখন তুই এসব তো বলবিই। তুই আর তোর বাবা। আমার জীবনটা শেষ করে দিলি। (slow pause)
শোনো...মায়ের ওপর করছো,করে নাও। বউ কিন্তু সহ্য করবে না।
-বউ তো টয়শপের মালিক।
-কী? বাবুউউ?

(ফোন কাটার শব্দ)
 "ধুর, কী যে বলে না। শেষে কিনা বাবু একটা দোকানদার বিয়ে করবে? এত লেখাপড়া কেন শেখালাম? সব ওর বাবার দোষ। ভগবান। এদিকে যার জন্য ফোন করলাম, কী যে খাবে, জিজ্ঞেসও করা হলো না।"

এমন সময়ে কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল। সরলাদেবী শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে দরজা খুললেন। দরজার ওপারে কৃষ্ণাকে দেখবেন ভেবে বিড়বিড় শুরু করলেন। "কৃষ্ণা, জানো তো, বাবু আমার একদম বিগড়ে গিয়েছে। কী যে করি। তোমার ওই চেনাজানা কে আছে না ওই যে মন্ত্রতন্ত্র পড়ে..."
-কী হাবিজাবি বলছো মা?
বাবুর কৌতুকভরা গলার আওয়াজ শুনে সরলাদেবী মুখ তুলে তাকান।
-ও মা, তুই? আমি ভাবলাম কৃষ্ণা। তা এসে গিয়েছিস যখন, ফোনে বললি না কেন? মিছিমিছি বেল বাজালি। জানিস মাসে মাসে কত টাকা ইলেক্ট্রিসিটির বিল দিতে হয়? সংসারের কোনো খবর রাখবি না। তুই আর তোর বাবা। দুজনেই এক। শুধু বড় বড় বাত।

(বাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে। হাতে একটা রঙিন প্যাকেট। ফর্মাল শার্টের পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে তাতে কিছু একটা খুঁজছে।)

-কীরে চুপ করে আছিস যে বড়? কী হলো?
খুব শান্তস্বরে বাবু বললো, "তোমার কথা শেষ হলো? আমি এবার একটু বলি?"
-বল।
-(গানের সুরে) চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি সরলা শুনছো?
আর মাত্র কয়েকটা মাস ব্যস।
স্টার্টিংয়ে ওরা চল্লিশ দেবে, ছয়মাস পরে পঞ্চাশ।
(Humming চলতে থাকে)
এই যে অনেকদিন ধরে যে চাকরিটার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম, যার ফার্স্ট ইন্টারভিউয়ের দিন তুমি ফোনের পাশে দাঁড়িয়ে আমায় ইরিটেট করেই যাচ্ছিলে, ওটার আজ কনফার্মেশন এলো। এই যে, ইমেল। নাও এবার শ্যামল, বুল্টি, মঞ্জু সবাইকে জানাও। ছেলে তোমার আবার নিজের পায়ে দাঁড়ালো। আর হ্যাঁ, এইটা তোমার জন্য।" এই বলে হাতের রঙিন প্যাকেট থেকে একটা সুন্দর দামী সিল্কের শাড়ি বের করে মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিলো। বাক্সের মধ্যে রাখা এক খানা নোট। সরলাদেবী সেটি হাতে নিয়ে দেখেন গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

"To all the sacrifices that you have made so far,
To all your scoldings and teachings,
You are the best Ma,
Yo! You are the best.
Love yo'...

সরলাদেবীর চোখের কোণটা যেন চিকচিক করছে। বাবুর দুই গালে চুমু খেতে খেতে বললেন, "বাংলায় লিখতে পারিস না হতভাগা? শুধু পটর পটর করে ইংরেজি, না? (Slight pause) শোনো...এসব মায়ের ওপর করছো, করে নাও। বউ কিন্তু সহ্য করবে না।"
বাবু হাসিমুখে বললো, "বউ তো শেক্সপিয়ারের বংশধর!"
- পাগল ছেলে আমার। দেখি তোর বাবাকে জানাই। আমার ছেলে বলে এতদিন কথা শোনাত বড়। আজ বলুক দেখি। আমার সোনা ছেলে। সোনা বাবুটা। শোন, কিছু খাবি তো? একটু নাগেটস ভেজে দিই। সারাদিন তো কিচ্ছু খাসনি। মুখচোখ এক্কেবারে শুকনো হয়ে গিয়েছে। আহা রে...


No comments:

Post a Comment