Sunday, May 5, 2019

ভাঙা রেডিওটা থেকে ক্ষীণ স্বরে ভেসে আসছে সঞ্চালকের কথা। আগামী চব্বিশ ঘন্টায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা। জেলেদের সমুদ্রে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা। হাতের কাজ সারতে সারতে কথাগুলো কানে যায় ময়নার। ময়নামতী। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। শ্যামলা গায়ের রং। টানা টানা কাজল কালো চোখ। ঠিক যেন কবির কৃষ্ণকলি। এক মাথা কোঁকড়া চুল। টেনে খোঁপা বাঁধা। জেলেপাড়াতেই থাকে মেয়ে সুখীকে নিয়ে। স্বামী এমনই এক ঝড় ঝঞ্ঝায় সেই যে সমুদ্রে গিয়েছিল, আজও ফেরেনি। ময়না জানে, সমুদ্র কখনো কিছু নেয় না। সব ঠিক ফিরিয়ে দেয়। একদিন ওর স্বামীকেও ঠিক পৌঁছে দেবে ওর কাছে। গভীর রাতে যখন ঝুপড়ির সামনে বসে থাকে, বঙ্গোপসাগরের থেকে ভেসে আসা নোনা বাতাসে স্বামীর সোহাগ অনুভব করে সে।

নিউ দিঘায় বীচের ধারে একটা মামুলি ভাতের হোটেল চালায় ময়না। টুরিস্ট মরসুমে বলতে নেই, বেশ ভালোই চলে। যায় ফলে এইসব খারাপ আবহাওয়ার সময়ে দোকানে খরিদ্দার না এলেও কোনোমতে মা মেয়ের চলে যায়। ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে কলকাতায় সাহেব বাবুদের বাড়ি কাজ করতে গিয়ে কত নামী দামী রান্নার গল্প শুনতো। ময়না স্বপ্ন দেখতো, একদিন ওরও এমন কায়দার দোকান হবে। ছোট্ট বাঁশের দোকান। সমুদ্রের ধারে। ঝিনুক দিয়ে সাজাবে। হাওয়াতে উইন্ডচাইমগুলো টুংটাং শব্দে অতিথিদের মাতিয়ে রাখবে। আশে পাশের ভাতের হোটেলের সাথে কোনোরকম সংঘাতে না গিয়ে ওর দোকানে একদম অন্য ধরণের দেশী বিদেশী খাবার হবে। নিজস্ব আইডেন্টিটি হবে। মেনুতে থাকবে বোটি কাবাব, আল ফাহাম কত কিছু। দামও খুব বেশি রাখবে না। ভাইকে দিয়ে দেশের বাড়ি থেকে ফল আনবে। টাটকা। রান্নার হাত ওর বরাবরই ভালো। তাই ওর খাবারের দোকানে পয়লা বৈশাখে কাঁচা আম আর ময়নামতীর নববর্ষের রান্না খেতে ভিড় উপচে পড়বে। কত স্বপ্ন।

বাবা মারা গেলো এক্সিডেন্টে। তড়িঘড়ি কলকাতার পাট চুকিয়ে ময়না, ভাই আর ওর মা ফিরে এলো খড়গপুর। তারপর আর কী, অভাবের সংসার। তাড়াহুড়োয় ভুবনের সাথে বিয়েটা হয়ে গেল। ভুবন মাঝি। গেলো বছর পাড়ার ক্লাবে বায়োস্কোপে এই নামের সিনেমা দেখে এই কাকতলীয় ব্যাপারটা জেনে বেশ অবাক হয়েছিল ময়না। ভুবন যখন নিখোঁজ হয়, সুখী খুবই ছোট। বছর ছয়েক বয়স। ওইটুকু মেয়েকে নিয়ে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রাণপণ লড়াই করে নিতান্তই মনের জোরে সেদিনের সেই কালো মেয়েটা আজ নেমেছে স্বপ্নপূরণের লড়াইয়ে। নিজের রান্নার হাতকে মূলধন করে। হয়তো সেই ছোট্ট ময়নার সেদিনের স্বপ্ন কোনোদিনও পূরণ হবে না। কিন্তু অস্তিত্ব রয়ে যাবে। ময়না আজও স্বপ্ন দেখে। সুখীকে একদিন মানুষের মতো মানুষ করবে। অনেক বড় হবে ও।

বাইরে ইতিমধ্যেই শনশন করে হাওয়া বইছে। ঘরের কাজ শেষ করে সুখীকে নিয়ে বেরোয় ও। এই সময়টা একদম মা মেয়ের, একান্ত। দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের পানে চেয়ে থাকে দুজনে। কোনো কথা নেই কারুর মুখে। দূরে কয়েকটা জাহাজে টিমটিম করছে আলো। জেলে নৌকাগুলো ফিরছে একে একে। বিষ্টুর চায়ের ঠেক থেকে গান ভেসে আসছে। বনমালী, পরজনমে হইও রাধা। এমন সময় চোখ যায় পূবদিকে। একটা ছোট জটলা। প্রতিবেশী পরাণ ওদিক থেকে আসছিল। ওদের দেখে বললো, "বৌদি, ওখানে একটা লোক ভেসে এসেছে। বেহুঁশ। পুলিশ আসবে এখনই। তোমরা বাইরে থেকোনা। ঘরে যাও গে।" ময়নার বুকটা ধক করে ওঠে। তাকায় সুখীর দিকে। ও ও বুঝি তাই ভাবছে। তবে কি...

বালির ওপর দিয়ে এগিয়ে যায় ওরা। এক বুক আশা নিয়ে...

No comments:

Post a Comment