Saturday, May 11, 2019

Mother's day

সম্ভবী মিত্রর বয়স ওই পঁচিশ। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় খুবই আদর যত্নে মানুষ। নামী ল স্কুল থেকে আইন পাশ করে এখন হায়দ্রাবাদে একটি বেসরকারি ল ফার্মে বেশ মোটা মাইনের চাকরি করে। অফিসের কাছাকাছি একটা ওয়ান বি এইচ কে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একাই থাকে।
প্রতিদিনের মতোই সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিয়েছে অফিসের পথে। আজ তৈরি হতে দেরি হওয়ায় মেনুতে ছিল চিকেন স্যান্ডউইচ। এই টোটকা কাম রান্নাটা শেখা মায়ের কাছে। ছোটবেলায় টিফিন বানাতে সময় কম থাকলে মা সব সময় এই চিকেন স্যান্ডউইচ দিতো। ফ্রিজে চিকেন সিদ্ধ সব সময় রেডি থাকে। শুধু একটু ব্রেড টোস্ট করে মাখন লাগিয়ে পুরে দাও। ব্যস। সুস্বাদু খাবার তৈরি।
ক্যাবে রেডিও চলছে। এখনো স্থানীয় ভাষাটা রপ্ত হয়নি বটে। তবে বিজ্ঞাপন শুনে বুঝলো। আসন্ন মাদার্স ডে উপলক্ষে অনুভূতিকে সুড়সুড়ি দিয়ে ব্যবসার প্রচেষ্টা। হ্যাঁ, সুড়সুড়িই বটে। নইলে বছরে কি মোটে একটা দিন লাগে মাকে ভালোবাসতে?
এক রাশ বিরক্তি মুখে সম্ভবী অফিসে পৌঁছয়। অফিসের ইমেলে লগ ইন করতেই দেখে এইচ আর থেকে ইমেল। আগামীকাল মাদার্স ডে সেলিব্রেশন। প্রত্যেকের মা ও মহিলা কর্মীদের সন্তান কাল অফিসে আমন্ত্রিত। অফিস থেকে লাঞ্চ অর্গানাইজ করা হবে। আয়োজনের সুবিধার্থে সকলে যেন গেস্ট লিস্ট আপডেট করে দেয় এ এস এ পি। যত ঢং। ছুটি চাইলে ছুটি নেই। ওয়ার্ক ফ্রম হোম চাইলে তাতে না। শুধু ফালতু ফালতু যত উদ্ভট সেলিব্রেশন। বিরক্ত মুড আরো খিঁচড়ে যায় সম্ভবীর। কাজ নিয়ে বসে। কয়েকটা কেসের রিপোর্ট লেখা বাকি। ইন্টারনেট খুলতেই শুধুই মাদার্স ডের বিজ্ঞাপন। চারিদিকে শুধুই অফার আর অফার। কেক পাঠালে ফুল ফ্রি। হীরে কিনলে সোনা ফ্রি। ঘড়িতে ৫০% ছাড়। পারফিউমে এই। শাড়িতে সেই। বিরক্তিকর। তার সাথে এস এম এসের বন্যা। পাশের কিউবিকলে রঞ্জন আর মেহুল অনেকক্ষণ ধরে ফুসুর ফুসুর করছে। আবছা যা কানে আসছে, বুঝলো ওরাও মাদার্স ডে নিয়েই কথা বলছে। মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে সম্ভবীর। এক কাপ কফি না খেলেই নয়। সারাদিনের অনেক কাজ। সামলাতে হবে তো? নইলে ওই রাগী মহিলা...মিসেস কুমুদিনী..লাইফ হেল করে দেবে। যা চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শোনায়। বাপ রে। মা মাসীদের বয়সী মানুষ। অথচ কথায় কোনো রাখ ঢাক নেই। মুখে আগল নেই।
ভেন্ডিং মেশিনের দিকে এগিয়ে গেলো সম্ভবী। পেপার কাপে কড়া কফির লিকার ঢেলেছে কি ঢালেনি, চোখ পড়ল, কাঁচের কেবিন থেকে মিসেস কুমুদিনী ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও দেখছে দেখে হাত নেড়ে ওকে ডাকলো কেবিনে। এই রে। নির্ঘাত এসেই কফি ব্রেক কেন নিয়েছে, সেই নিয়ে কথা শোনাবে ওকে, ভাবলো সম্ভবী। ধুর ধুর। দিনটাই খারাপ। দুরুদুরু বুকে ও কুমুদিনীর কেবিনে প্রবেশ করলো। ওকে সামনের চেয়ারে বসতে বলে বলল, " সকাল সকাল এসেই কফি? শরীর খারাপ? "
সম্ভবী প্রমাদ গুনলো। এই শুরু হলো। হয় বকুনি। নয় লেকচার। ও মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে বললো, "হ্যাঁ মানে মাথাটা একটু ধরেছে।"
"কেন?"
"ঘুম হয়নি ঠিক করে।"
"কখন শুয়েছো?"
সম্ভবী বিরক্ত হয়। এ আবার কী। এত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। ব্যাজার মুখে উত্তর দেয়, "ওই একটার দিকে।"
"আর উঠেছ?"
"সাতটা।"
"এরকম করলে মাথা কাজ করবে না তো। বার্ন আউট হবে। আর কত বলবো তোমাদের? দিস জেনেরশন হ্যাজ গন টু দ্য ডগস।" বিরক্তিভরে মাথা নাড়ে কুমুদিনী।
সম্ভবী চুপ করে থাকে। কোনো কথা বলা মানেই আরো লম্বা আলোচনা। যা এই মুহূর্তে ও কিছুতেই চায় না। কুমুদিনী আবার বলে, " যে জন্য তোমায় ডাকা। কাল কী করছো?"
সম্ভবী মুখ তোলে। "কোথায়? কখন?" জিজ্ঞেস করে।
"অফিস পার্টিতে।"
"কিছুই না। আপনি তো জানেন। আমার মা..."
"হ্যাঁ। ওই জন্যই তো ডেকেছি।"
"মানে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সম্ভবী।
"তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমার কোনো ছেলে মেয়ে নেই।"
"আই সি।"
"আমি চাই কাল তুমি আমার সাথে আমার মেয়ে হয়ে অফিস পার্টিতে এসো।"
সম্ভবী অবাক হয়ে তাকায় কুমুদিনীর দিকে। কুমুদিনী বোঝে। বলে, "অবাক হচ্ছ? ভাবছো কেন তুমি অফ অল পিপল?"
সম্ভবী মাথা নাড়ে।
কুমুদিনী বলে, "আই লস্ট মাই মা ওয়েন আই ওয়াস অনলি সেভেন। মা কে ছাড়া থাকার কষ্টটা আমি তাই বুঝি। তুমি রিসেন্টলি মাকে হারিয়েছ। আমি জানি। ভাবলাম ইউ উড বি আপসেট উইথ এভরিথিং টুমরো। তাই এই প্রস্তাব। ভেবে দেখো। কোনো কম্পলশান নেই।"
সম্ভবী কী বলবে, বুঝে পায় না। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কুমুদিনীর দিকে। ওই রাগী বসের ভিতরেও যে এমন মাতৃসত্ত্বা আছে, অনুভব করে ও বিস্মিত। অবাক। কুমুদিনীর চোখের নীচের কুঁচকে যাওয়া চামড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সম্ভবী। ঠিক ওর মায়ের মতো। মায়েরও তো ছিল এমন। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন কে জানে দুই গাল বেয়ে নামতে থাকে জল। কুমুদিনী অপ্রস্তুত হয়ে ওঠে। নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে সম্ভবীকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, "ধরে নিলাম প্রস্তাবে সম্মতি আছে। ব্যস। মা পেলে আমায়। মায়ের আদরও যেমন দেব, তেমনি শাসনও করবো। দুইই মেনে নিতে হবে। পারবি তো?"
সম্ভবী ওর নতুন মায়ের বুকে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট স্বরে বলে, "হ্যাঁ।"
কুমুদিনী বলে, "যা তাহলে কাজে ফের। ফাঁকি মারলেই বকুনি। লাঞ্চে আসিস ক্যান্টিনে। কালকের প্ল্যান করবো। আমি এইচ আরে মেলটা করে দিই। তোর অপেক্ষায় ছিলাম।"
সম্ভবী আস্তে আস্তে উঠে ফেরে নিজের কিউবিকলে। আবিষ্কার করে এত কিছুর মধ্যে কফির কাপটা সেই খালিই পড়ে আছে। তবে অদ্ভুতভাবে, মাথা ব্যাথাটা কোথায় যেন গায়েব। মুহূর্তেই।
মায়ের পরশ?

No comments:

Post a Comment