Wednesday, May 8, 2019

পঁচিশে প্রজ্ঞা

"আগামী বুধবার, ঠিক সন্ধ্যে ছটায় কিন্তু আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলে আসবি।" তুলি মাসির মেসেজ ঢুকলো হোয়াটসআপে। ডেস্কটপে কালো স্ক্রিনে একগাদা কোড চলছে বা বলা ভালো, চলানোর চেষ্টা করে চলেছে সেই সকাল থেকে। কিছুতেই চলছে না। ডিবাগিং সমস্যায় জেরবার প্রজ্ঞা টেবিলে রাখা ক্যালেন্ডারে চোখ বোলালো। সুদূর অ্যাটলান্টাতে বসেও ওর টেবিলে বাংলা ক্যালেন্ডার। বুধবার জ্বলজ্বল করছে লাল কালিতে। রবীন্দ্রজয়ন্তী। এক লহমায় মুহূর্তের সব বিরক্তি কোথায় যেন ম্যাজিকের মতো গায়েব হয়ে যায়। স্ক্রিনে লাইনের পর লাইন কোড চলতে থাকে। প্রজ্ঞার মন ছুটে যায় ফেলে আসা স্কুলবেলায়।

প্রজ্ঞা পড়তো দক্ষিণ কলকাতার এক নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। সেখানে লেখাপড়ার সাথে সাথে সাংস্কৃতিক পঠনপাঠনও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রবীন্দ্র নজরুল জয়ন্তীতে ক্লাসের হয়ে পারফর্ম করতে পারা ছিল আলাদা গর্বের ব্যাপার। প্রজ্ঞা সেই যে ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করেছিলো নাচ ও গান, একেবারে হায়ার সেকেন্ডারি অবধি মঞ্চ কাঁপিয়ে অনুষ্ঠান করেছে। এ ছাড়া পাড়ার অনুষ্ঠানেও দিব্যি সাবলীল। সব মিলিয়ে পঁচিশে বৈশাখের স্মৃতি ওর কাছে বড়ই মধুর। তুলি মাসির মেসেজে যেন সেই সব খনি ওর সামনে আবার উপচে পড়েছে বারবার।

তখন বোধহয় ক্লাস থ্রি। এই প্রথম একক গান গাইবে। নন্দিনী মিস নিজে বসিয়ে ওকে শিখিয়েছেন। " আলো আমার আলো ওগো"। এর আগে দৌড় ছিল সমবেত সঙ্গীতে "আমরা সবাই রাজা" বা "হারে রে রে রে"। মা বাবা দাদুন ঠামুন সব্বাই কি এক্সাইটেড! প্রজ্ঞা এই প্রথম স্টেজে সোলো গাইবে। মা নিউ মার্কেট থেকে ওর জন্য লাল পার গরদের শাড়ি কিনে এনেছে। অনুষ্ঠানের দিন সযত্নে ওকে সাজিয়ে একদম পরীর মতো লেগেছিল। প্রজ্ঞার অবশ্য মনে নেই। কিছু হলদে হয়ে আসা ফটোগ্রাফ সম্বল। স্টেজে উঠে সেদিন অপূর্ব গেয়েছিল ও। নন্দিনী মিস তো স্টেজ থেকে বেরোনোর পর ওর দুই গালে চুমু এঁকে দেন।

মনে পড়ে যায় ক্লাস টেনের কথা। প্রিটেস্টের জন্য পড়ার চাপ। অথচ নাচ করতেই হবে। তাও আবার শ্যামা নৃত্যনাট্যে নাম ভূমিকায়। বাড়িতে বকাঝকা কম হয়নি এই নিয়ে। কিন্তু প্রজ্ঞা গুণী মেয়ে। এবং চালাক। নাচ গানের সাথে সাথে লেখাপড়াটা এত সুন্দরভাবে ম্যানেজ করেছে...কোনোদিনও বাবা মা বকার সুযোগ পাননি। ওই জন্যই উচ্চ মাধ্যমিকের বছরেও জয়েন্ট এনট্র্যান্স ইত্যাদি সবকিছুর প্রিপারেশন নিতে নিতেও চলেছে সমান তালে নাচ ও গানের মহড়া। সেবার তো আবার তাসের দেশ। অনেক অনেক গান। নাচ।

দুর্দান্ত রেজাল্ট করে যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া। ইউনিভার্সিটি জীবনেও মিস যায়নি কোনো অনুষ্ঠান। ওদের গল্ফগ্রীনের প্রোগ্রামে তো ভিড় উপচে পড়তো। ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালীন গানের স্কুলের থেকে চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ হয়েছিল। ও ছিল বরাবরের মতোই নাম ভূমিকায়। অর্জুন হয়েছিল ঋজু বলে একটি ছেলে। অর্জুনের গান গেয়েছিল ওদের স্কুলেরই এক ছাত্র, রেবন্ত। কয়েক বছরের বড়। অসাধারণ গানের গলা। তেমনই মিশুকে। তবে এক বছর ওদের সাথে গান শেখার পরে ও জে এন ইউ তে চাকরি পেয়ে চলে যায় দিল্লী। তারপর আর কোন যোগাযোগ নেই। সেই অনুষ্ঠানে বহু প্রথিতযশা শিল্পীদের ভিড়ে প্রজ্ঞাও মন কেড়ে নিয়েছিল সকলেরই। যখন মাস্টার্স করতে ইউ এস এলো, একটু শঙ্কা ছিল। এখানে এসে নাচ গানটা বজায় থাকবে তো? তবে ওর সমস্ত আশঙ্কা দূর করে তুলি মাসিকে পেলো এখানে। তুলি মাসি আর প্রবুদ্ধ মেসো তিরিশ বছর ধরে অ্যাটলান্টায় থাকেন। নিঃসন্তান এই দম্পতি বড় ভালোবাসেন প্রজ্ঞাকে। গান গল্প খাওয়া দাওয়া লেগেই থাকে ওদের বাড়ি। এমনিই ছুটি ছাটার দিনে তো বটেই, আর বিশেষ বিশেষ দিনে থাকে বিশেষ ভাবে উদযাপন। যেমন, দোল, নববর্ষ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী, বিজয়া সম্মেলনী, সরস্বতী পূজা ইত্যাদি। তুলি মাসির বাড়ি যে এবারেও দারুণ আনন্দ হবে, প্রজ্ঞা জানে।

লাঞ্চ আয়ার্সএ প্রজ্ঞা তুলি মাসিকে ফোন করলো।
"হ্যালো মাসি?"
"মেসেজ পেয়েছিস তো?"
"হ্যাঁ গো। ওই জন্যই তো ফোন।"
"চলে আসবি কিন্তু সময়মতো। এবারে কিন্তু একটা সারপ্রাইজ আছে!"
"সারপ্রাইজ? কী গো?"
"ধুর, তাই যদি বলে দিই, তাহলে আর কীসের সারপ্রাইজ হলো বল?"
"তাও বটে। তা, ড্রেসকোড আছে কোনো? আই মিন, কালার কোড?"
"হুম। সাদা ঢাকাই। যে কোনো রঙের পার।"
"এই রে। আমার যে নেই।"
"আমার কয়েকটা আছে। আজ ল্যাব থেকে ফেরার পথে আসিস। পছন্দ করে নিয়ে যাবি।"
"আচ্ছা। ইউ আর অলওয়েজ এ সেভিয়ার মাসি।"
"আর শোন, ডিনারটা আমার কাছেই করিস। তোর ফেভারিট বাটি চচ্চড়ি করবো।"
"ইয়ে!"

বুধবার এলো। সুপারভাইজরকে বলে আজ হাফ ডে নিয়েছে ও। লাঞ্চ সেরে কাজকর্ম গুটিয়ে বাড়ি পৌঁছে একবার গীতবিতান খুলে বসলো। ঠিক করাই আছে কী কী গান গাইবে। তবুও, ওই ঝালিয়ে নেওয়া। শুরু করবে "আনন্দধারা বহিছে ভুবনে" দিয়ে, তারপর একে একে "বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা", "তাই তোমার আনন্দ" আর সব শেষে "আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে"। তুলি মাসির নীল পার শাড়িটা পরে খোঁপায় ম্যাচিং নীল অর্কিড লাগিয়ে পাঁচটার দিকেই বেরিয়ে পড়ল প্রজ্ঞা। যদিও মাসির বাড়ি ওই মিনিট কুড়ির ড্রাইভ, তাও, হাতে হাতে মাসিকে সাহায্য করাও যাবে। ও জানে, আজ অনেক লোক সমাগম হবেই। আর মাসির একার পক্ষে সব আয়োজন করা কঠিন। তাই তুলি মাসি না বললেও, ও আগেই পৌঁছল। বেল বাজালো। ভিতর থেকে ভেসে আসছে স্পিকারে গমগমে গলায় দেবব্রত বিশ্বাস। "মেঘের পরে মেঘ জমেছে..."। সত্যিই, অ্যাটলান্টার আকাশেও যেন মেঘের ক্যানভাস। তাতে অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভা। অনন্য এক চিত্র। এইসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতে সামনে যাকে দেখলও প্রজ্ঞা, ও এক্কেবারে তাজ্জব! এ কী? এ যে রেবন্তদা !!

"ও মা, তুমি? রেবন্তদা?" প্রজ্ঞার চোখে মুখে বিস্ময়। রেবন্ত ঠিক একই আছে। সেই কোঁকড়া চুল, রোগা লম্বা চেহারা। গালে হাল্কা গোঁফ দাঁড়ি। দুষ্টু দুষ্টু চোখ। সরু রিমের ছোট্ট চশমা। সেই জিন্স আর খাদির হলুদ পাঞ্জাবি। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখন কলেজে অধ্যাপনা করে এবং রীতিমতো সিরিয়াস প্রফেসর।
পিছন থেকে তুলি মাসির গলা পেলো প্রজ্ঞা। "কী? বলেছিলাম না সারপ্রাইজ আছে?"
"কিন্তু তুমি রেবন্তদাকে চিনলে কী করে মাসি?"
"ভিতরে আয়। সব কথা কি বাইরেই হবে নাকি?"
ড্রইং রুমটা ভীষণ এস্থেটিক ভাবে সাজিয়েছে আজ। এত বড় ছবি কবিগুরুর। তার সামনে বড় বড় ফুলের তোড়া। নরম সোফায় গা এলিয়ে আরাম করে বসেছে প্রজ্ঞা। তুলি মাসি বলতে থাকে, "রেবন্ত আমার এক মাসতুতো দিদির মেয়ের দেওর। ও এখানে এসেছে একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্র্যামের জন্য। আমায় দিদি বলল, ওকে একটু দেখতে। আমি তো ফোন করে গল্প জুড়ে দিলাম। তারপর কথায় কথায় জানলাম, ও ভীষণ ভালো গান করে। অবশ্য সেটা সীমাদি বলেছে। রেবন্ত নিজের মুখে বলেনি।"
"হ্যাঁ, রেবন্তদা বরাবরই ওরকম। বড্ড বিনয়ী।"
"তা রেবন্তকে বললাম আমদের অনুষ্ঠানের কথা। কে কে আসে, নিয়মিত গায়, সব বললাম। তোর নাম শুনেই বলল, ওই যে চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, গোলগাল ছোট্ট মেয়েটা? ব্যস, তোর ছবি দেখালাম। বলল, হ্যাঁ, এই সে। এই তো আমার চিত্রাঙ্গদা। তারপর দুজনে মিলে এই প্ল্যান। আজ দুজনে চিত্রাঙ্গদার সব গান গাইবি। কোরাস আমরা ম্যানেজ দেবো। বুঝেছিস?"
" বাবা রে মাসি, তলে তলে এত কিছু?"
"আবার কী?"
"কিন্তু আমি যে এত গান বেছে এলাম?"
"সে গাস। কিন্তু আগে এটা। রেবন্তকে তো রোজ পাবি না। তাই চিত্রাঙ্গদা ফার্স্ট প্রায়োরিটি। এমনিও দেখ, অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এটা করার। অর্জুন পাইনি এতদিন। আজ যখন আমার অর্জুন এসে হাজির নিজেই, এই সুযোগ আমি ছাড়ছি না!"
"বলছো যখন..."
"হ্যাঁ, তোরা চাইলে একটু রিহার্সাল করে নে। অন্যরা আসবে ওই সাড়ে ছটার দিকে। নে, গান ধর...তোর মেসো পাঠ করে দিচ্ছেখন..."

("মণিপুর রাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তার বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তৎসত্ত্বেও যখন রাজককূলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হল, তখন রাজা তাকে পুত্র রূপেই পালন করলেন...")

No comments:

Post a Comment