শহরের পাঁচালি
উঁচু সিলিংটা থেকে ঝোলা লম্বা ডান্ডা দেওয়া প্রাচীন পাখাটা চলতে চলতে হুঠ করে থেমে যায়। ধুর, আবার লোডশেডিং। শ্রীময়ী গ্রিল দেওয়া জানলার ধারে সাদার ওপর হাল্কা লাল সবুজ নীল সুতোয় এমব্রয়ডারি করা বালিশে হেলান দিয়ে "সেই সময়" পড়ছিলো। গত জন্মদিনে অম্বরীশের উপহার। সকাল থেকে ঘরদোরের সমস্ত কাজ কর্ম সেরে এই দুপুরেই একটু যা সুযোগ পায় বই পড়ার। মনে হচ্ছে আজকের মত বই পড়া শেষ। ওদের এদিকটায় আজকাল মাঝে মাঝেই দুপুরে কারেন্ট চলে যাচ্ছে। আর একবার গেলে, ফিরতে ফিরতে সেই তিন চার ঘন্টার ধাক্কা। শ্রীময়ী বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। শাড়িটা ঠিক করে আলতো হাতে খোঁপা বেঁধে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে জরিপ করলো। হুম, ঠিকই আছে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা সিঁদুর কৌটো থেকে একটু সিঁদুর আঙুলের ডগায় মাখিয়ে কপালে টিপ পরলো। হ্যাঁ, এইবারে যথাযথ হলো।
বারান্দায় এসে দাঁড়ালো শ্রীময়ী। ওদের এই বাড়িটার বয়স, প্রায় একশো। অনেক শরিক। তবে দায় দায়িত্ব প্রায় কেউই নেয় না। অনেকদিন বাড়িটা রঙও হয়নি। ভিতরে ভিতরেও মেরামতের প্রয়োজন নেহাত কম না। তবে লোকেশন খাসা। এক্কেবারে বঙ্কিম চ্যাটারজী স্ট্রীটের ওপর। বারান্দায় দাঁড়ালে, সামনেই কলেজ স্কোয়ারের জলাশয়। রাস্তাঘাট শুনশান। গরমে সবাই হয় বাড়িতে, নয় অফিসে। শ্রীময়ী খেয়াল করলো, বাড়ির উল্টোদিকের স্টলগুলিতে দোকানদারেরা হাতপাখা নিয়ে বসে। বৃথা চেষ্টা, একটু ঠাণ্ডা হওয়ার। একটা দুটো খরিদ্দার আসছে মাঝে মধ্যে। ওই টুকটাক কিছু কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেক দরদাম করে। আবার কেউ কেউ খালি হাতেই ফিরছে। দোকানীদেরও যেন উৎসাহ নেই আর। সারাদিনের গরমে ওরাও ক্লান্ত।
দু চারটে ছেলে মেয়েকে দেখা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে বেশ কলকল কলকল করতে করতে আসছে। ওদের কয়েকজনের হাতে বড় দামী ক্যামেরা। এদিক ওদিক দেখছে আর মাঝে মধ্যেই টুকটাক ছবি তুলে যাচ্ছে। নির্ঘাত সব কলেজ স্টুডেন্ট। অন্তত বয়স দেখে তাই মনে হয়। হয়তো কলকাতার বাইরে থাকে। ছুটিতে এসেছে। বন্ধুরা মিলে ঘুরে বেড়াচ্ছে পুরনো শহরে। শ্রীময়ীর মনে পড়ে যায়। ওরাও এক সময় কত এমন ঘুরত। আজ রবীন্দ্র সদন, কাল পার্ক স্ট্রিট, পরশু বাবুঘাট। কতদিন তো বই কিনতে এই বইপাড়াতেও চলে আসত। তারপর কেনাকাটি মিটিয়ে কফি হাউজে বসে খাওয়া, গল্প। সেদিনের সেই মধুমিতা, প্রীতিলতা, সুবর্ণ, সব কে কোথায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেখাই হয় না কতদিন। একটা মৃদু আক্ষেপ হয় শ্রীময়ীর।
শোওয়ার ঘরের বড় ঘড়িটায় ঢং ঢং করে পাঁচটার ঘন্টা বাজে। আস্তে আস্তে কলেজ স্কোয়ারের দিকে ভিড় বাড়তে থাকে। প্রবল উৎসাহী এক দল বাচ্চা আর ততোধিক উৎসাহী তাদের মায়েরা। শুরু হবে ব্যায়াম। কসরত। সাঁতার। বারান্দায় মোড়া পেতে বসে একের পর এক দৃশ্য দেখতে থাকে শ্রীময়ী। সত্যিই, এখানে কত প্রাণ। এই একটু আগের নিস্তব্ধ রাস্তাঘাত এখন কেমন নব প্রাণোচ্ছ্বাসে ভরপুর। শ্রীময়ী ভাবে, ওর জীবনটাও তো তেমনই। এই সারা দুপুর সব শান্ত, স্তব্ধ। আবার খানিক পর থেকেই আবার শুরু হয়ে যাবে তোলপাড়। ব্যস্ততা। লোকে লোকারণ্য হবে রাস্তা। ওর বাড়িও গমগম করবে পরিবারের সকলের সান্নিধ্যে।
No comments:
Post a Comment