মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে এই সপ্তাহেই। তিতলি বেশ ভালোই নম্বরও পেয়েছে, প্রায় ৮৫%। সেই নিয়ে গত কয়েকদিন বাড়িতে বেশ উচ্ছ্বাস, আনন্দ ও উদযাপনও হলো। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব অনেকেই বাড়ি বয়ে এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলেন। তাঁদের সকলের জন্য শরবত মিষ্টির ব্যবস্থা করতে করতেই অনেক কটা টাকা খরচা হয়ে গেলো এই চক্করে। মাসের প্রায় শেষের দিক, পকেট এদিকে গড়ের মাঠ। স্নান সেরে বেরিয়ে ঠাকুর প্রণাম করতে করতে মলয় ভাবেন, "মেয়েটাকে তো ডাক্তার বানাতেই হবে। কত স্বপ্ন। এই তো লড়াই শুরু। ঠাকুর, দেখো। সাথে থেকো।"
রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁক ছোক শব্দ শোনা যায়। সেই কোন ভোরে উঠে একা হাতে সমস্তটা সামলায় পলি। তাড়াহুড়ো করে রান্না সারতে হবে, নইলে মলয়ের অফিসের দেরি হয়ে যাবে। এখন তো অফিস বাড়ি অন্য জায়গায় বদলে যাওয়ায়, যাতায়াতের সময়টাও এগিয়ে এসেছে, পড়েছে পলির ওপর বাড়তি চাপ। এই সময়টা পলিকে জ্বালাতন করতে মোটেই ইচ্ছে করেনা মলয়ের। কিন্তু কীই বা করবে। খুব দরকার এখন ওকেই। এই একটু আগে তিতলি এসে ফর্দ ধরিয়ে গেলো। টিউশন ক্লাসের স্যারেরা সব বইয়ের লিস্টি ধরিয়ে দিয়েছেন। এক আধটা তিতলি ওর মামাতো দাদা বাবাইয়ের থেকে জোগাড় করেছে বটে, কিন্তু তাও বায়োলজির বইগুলো লাগবে। লিস্ট দেখেই মলয়ের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। দাম ভালোই হবে। এদিকে এই গত পরশু তিতলির ইলেভেনের ভর্তির জন্য আড়াই হাজার টাকা জমা করতে হলো। মাসের শেষে ছ-ছটা স্যারেদের মাইনে বাবদ আরো হাজার পাঁচেক। এর মধ্যে আবার বইয়ের এই ফিরিস্তি। কী করে যে কী সামলাবে, ভেবে পায় না মলয়। অফিসের সহকর্মীদের খাওয়ানোর আব্দার না হয় সামনের মাস অবধি ঠেকিয়ে রাখতেই হবে, নিরুপায়। কিন্তু তিতলির বইগুলো... আনতেই হবে, যে ভাবে হোক। মেয়েটার মধ্যে যে প্রতিভা আছে, তাকে আগলে রাখতেই হবে। পলির কাছে ওর জমানো কিছু টাকা যদি থাকে, তবে খানিক সুরাহা হয়।
সন্ধ্যে আটটার দিকে ভিড় কলকাতার জনবহুল ব্যস্ত রাস্তায় ট্র্যাফিক জ্যামে বাসটা আটকে। প্রচন্ড গরম, অস্বস্তি। বারবার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছছে মলয়। বসার জায়গা পায়নি। আশেপাশের লোকজনের মধ্যে একটা বিরক্তি। অন্যদিনের মলয়ের সাথে তাঁদের কোন অমিল নেই। কিন্তু আজ মলয় আলাদা। আজ মলয়ের মনে অনেকটা নিশ্চিন্তি। স্বস্তি। তিতলির বইগুলো সব জোগাড় হয়েছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে মাথায় এলো কথাটা। মলয় বিকেল বিকেল অফিস থেকে বেরিয়ে লিস্ট হাতে সোজা চলে আসে কলেজ স্ট্রিট। তারপর এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে, দরদাম করতে করতে অবশেষে লিস্ট মিলিয়ে সবকটা বই কেনা হলো। সিংহভাগই জুটে গেলো পুরনো বইয়ের দোকানে। ফলে, সাশ্রয়টাও মন্দ হলো না। পকেটও খুশি, মনও। পলির জমানো টাকাটা থেকে কিছুটা বাঁচানো গেছে। তিতলির বইও সব এসে গিয়েছে। বাড়তি পরিশ্রম হলো বটে আজ মলয়ের, কিন্তু লং টার্ম সুবিধের কাছে এ তো নগণ্য। মেয়েটাকে যে ডাক্তার বানাতেই হবে। স্টলে স্টলে ডাক্তারি বই, যন্ত্রপাতি দেখতে দেখতে আরো একবার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মলয়। খরচা অনেক। জানে ও। কিন্তু সামলে দেবে। হাজার হোক, কলেজ স্ট্রিট আছে তো।
যার কেউ নেই, তার বুঝি কলেজ স্ট্রিট আছে।
No comments:
Post a Comment