Saturday, May 11, 2019

গরমের ছুটিতে

স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। প্রতিবারই আমাদের এই ছুটিতে দলবল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া হয়। আমরা মানে আমি, মা, বাবা, ওদিকে মাসী, মেসো, ফুল, রেণু, বড় মামা, মামী, তুবড়ি দাদা, চরকি দিদি। কখনও পুরী, কখনও গ্যাংটক তো কখনও ভোপাল, জব্বলপুর। গরমের ছুটি মানে টানা দেড় মাস। আর একদম স্কুল খুলেই পরীক্ষার চোখ রাঙানি নেই। তাই এই ছুটিতে খুব আনন্দ করে আমরা বেড়াই। এই বছর অবশ্য ব্যাপারটা বেশ স্পেশাল। আগামী ২০শে মে আমাদের ছোটমামার বিয়ে। ছোটমামার গল্প তো আগেই বলেছি। ভাগলপুরে থাকে চাকরিসূত্রে। বিয়েটা অবশ্য হবে বর্ধমান জেলার কোন এক গ্রামে। আমরা তিনজন, মাসীরা চারজন আগেভাগেই পৌঁছে গিয়েছি জলপাইগুড়ি। ওখান থেকে সবাই মিলে ট্রেনে একসাথে বর্ধমান আসা হবে। বাবার আর মেসোর বেশ আপত্তি ছিল বটে। ট্রেনে করে কলকাতা থেকে বর্ধমান অনেক কাছে। সেইরকম গেলেই হয়। কিন্তু না। এইসব বিষয়ে মা আর মাসির কথাই ফাইনাল। তাই বাবা আর মেসোকে দুদিন বাড়তি ছুটি নিয়ে জলপাইগুড়ি পৌঁছতে হলো। নেহাত মা অফিসের ছুটি কম পেয়েছে, তাই এক সপ্তাহাগে থেকে যেতে পারেনি। আমার আর বাবার সাথেই গেলো জলপাইগুড়ি।
মামাবাড়িতে গিয়ে দেখি হইহই কাণ্ড। লোকজন আত্মীয়স্বজনে ভর্তি। ভিড়। অমুক মামা, তমুক মাসি, তাঁদের এই এত এত ছেলে মেয়ে। সেই ছেলেমেয়েদেরও আবার কতজনের ছেলেপুলে হয়ে গিয়েছে। এত লোকের নাম ধাম মনে রাখার চেয়ে বাবা হিস্ট্রির ডেট মনে করা সোজা। আমি তাই কেউ এসে আলাপ করলেই শুধু হেসে পালাচ্ছি। চরকি দিদি আর তুবড়ি দাদার অবস্থা অবশ্য সঙ্গীন। যেহেতু নিমন্ত্রিতরা সব ওদের বাড়ি এসেছে, তাই ওদের পালানোর উপায় নেই। আমি, ফুল-রেণু বেশিরভাগ সময়েই ছাদের কোণে গিয়ে বসছি। ওখানে প্যান্ডেল বাঁধার কাজ চলছে। সেইসব দেখছি লুকিয়ে লুকিয়ে। বড়দের চোখ বাঁচিয়ে চলা আর কী। কারণ কেউ দেখলেই ওমনি শুরু হবে, "আরে, তুমি ঝুমকুর মেয়ে না? কত বড় হয়ে গিয়েছ। কোন ক্লাস হলো? অঙ্কে কত মার্কস পেয়েছ? জানো তো, তোমার মা অঙ্কে খুব ভালো ছিল। কোনদিনও ১০০র নীচে নম্বর পায়নি। তোমার কি ষাট পেলে চলে বলো? ভালো করে অঙ্ক করো। নাও দেখি  তো, অমুক তমুক আর তমুকের ল সা গু গ সা গু বলো দেখি?" ব্যস। বুকের ভিতর ধুকপুকানিটা বেড়ে গিয়ে একশা। চোখে মুখে ঘাম। একেই এই প্রচণ্ড গরম। তার মধ্যে এইসব বাঘা বাঘা অঙ্ক। ইতিমধ্যেই আবার দেখবো মা কথা থেকে এসে হাজির। "দেখো না মামা, কেয়াটা একটা ভোঁদড় তৈরি হয়েছে। মাথা ভর্তি গোবর। কিচ্ছু পারে না। এমন সোজা সোজা অঙ্ক পরীক্ষায় ভুল করে কী বলবো। কান্না পেয়ে যায় আমার ওর খাতা দেখলে।" তার মধ্যে আবার কখন মাসিও হাজির হয়ে যাবে। সেও জোট বাঁধবে মায়ের সাথে। ফুল-রেণু নাকি কতটা গাধা, এখনও নাকি ৭ এর নামটা মুখস্থ বলতে পারে না, সেই নিয়ে চলবে তুমুল হা-পিত্যেশ। আর এসবের মধ্যে মামী এসে গেলে তো ষোল কলা পূর্ণ। চরকি দিদি লাস্ট একজ্যামে অঙ্কে ১০০য় ১০০ আর তুবড়ি দাদা ১০০এ ৫৫। "দুই ভাই বোনে যে কী করে এত আলাদা হয় জানিনে বাবা। মনে হয় হাসপাতালে বদল হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা আমার। কোথাকার কোন বুদ্ধুরামকে দিয়ে দিয়েছে দেখো।" এই বলে ঘ্যান ঘ্যান শুরু হবে মামীর। ভাগ্যিস পাশের বাড়ির নন্দা মাসি এসে "এদিকে এসো বৌদি, তত্ত্ব দেখে যাও। ঠিক সাজানো হলো কি না, বলো" বলবে। তাই শুনে মাসি মা আর মামী নীচে যাবে। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবো। কাল দুপুরে খুব হয়রানি হয়েছে। আগামীকাল রাত্রে ট্রেন। আশা করছি সবাই খুব ব্যস্ত থাকবে গোছগাছ করতে। তাই কালকের দিনটা মুক্তি। আজকেরদিনটা পার করে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে।
আজ কলকাতা থেকে আরো অনেক আত্মীয় এসেছে। বাড়িতে বলা যায় তিলধারণের জায়গা নেই। আমাদের পাঁচ বাচ্চাকে (অবশ্য আমার এই বাচ্চা উপাধি শুনতে মোটেই ভালো লাগে না। আমার অলরেডি ক্লাস থ্রি। তুবড়ি দাদা ক্লাস সিক্স, চরকি দিদি ক্লাস ফাইভ। ফুল-রেণু না হয় আপার কেজি, ওরা তাও বাচ্চা বলে চলতে পারে।) প্রতিবেশী বাড়ি মায়া মাইমার কাছে পৌঁছে দিলো। একটু যাতে শান্তিতে আমরা শুতে পারি। মায়া মাইমা যেন সার্থকনামা। যদিও মা মাসির কড়া আদেশ ছিল যাতে আমরা ঘুমোই, কিন্তু এরকম বললে হয় নাকি? ঘুম তো যখন তখন পায় না। জোর করে ঘুম পাড়ানো মানে এক প্রকার শাসন বটে। মায়া মাইমার দুই ছেলে মেয়ে। বকুল দিদি আর মুকুল। মাইমা ওদেরকেও কক্ষনো জোর করে না ঘুমোতে। আমাদের সাতজনের ঠাই হলো বকুল মুকুলের ঠাম্মার ঘরে। এই এত্ত বড়ও ঘর। এই উঁচু তার সিলিঙ। কী সুন্দর নক্সা কাটা কাঠের খাট। সেটাও উঁচু। লম্বা ডাণ্ডা পাখা ঝুলছে। সমস্ত কাঠের জানলা বন্ধ। ঘরে অন্ধকার। লাল সিমেন্টের মেঝে। কী ঠাণ্ডা, কী আরাম। ঠাম্মার বয়স বোধহয় ওই সত্তরের দিকে। এক মাথা কাঁচা পাকা চুল, গায়ে সুতির সাদা ধবধবে শাড়ি। হাতে সরু সোনার চুরি।
ঠাম্মা আমাদের সাতজনকে নিজের চারপাশে বসিয়ে আলমারি থেকে একটা মোটা লাল রঙের বই বের করে বললেন, "আয় সোনারা, তোদের ঘুমোতে হবে না। আমি বরং তোদের আজ গল্প পড়ে শোনাই। শুনবি?" এবার গল্পের কথা বললে কেউ কি না করে? আমরা সদলবলে "হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, শুনবো।" বললাম। ফুল-রেণুর আবদার রাজা রাণীর গল্প চাই। তুবড়ি দাদার চাই যুদ্ধ। চরকি দিদি আর আমার তেমন দাবী দাওয়া নেই। আমাদের গল্প হলেই হলো। বকুল মুকুল শান্ত। ওরা ওদের ঠাম্মার কাছে গল্প শুনতে অভ্যস্ত। সব রকম শোনে।  ঠাম্মা বললেন, "হ্যাঁ রে দাদাভাই, দিদিভাই, তোদের সবার কথাই রাখবো। আজ তোদের যে এমন একটা গল্প শোনাবো, দেখিস। সেখানে আছে রাজা, রাণী, যুদ্ধ, লড়াই, ন্যায় অন্যায়। স-অ-অ-ব। তোদের আজ মহাভারতের গল্প বলবো।" ঠাম্মার হাতের বইটা "ছেলেদের মহাভারত", উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর। সেই যে ঠাম্মা শুরু করলো গল্প পড়া, আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম। উফ, সে কী গল্প। কত লোক, কত লড়াই, কত ধনরত্ন, কত বুদ্ধি...বিকেলে মাইমার কাছেই দুধ মুড়ি খেলাম। মায়েরা ডাকতে এলো আমাদের, নিয়ে যাবে। আমরা তো যাবোই না। যতক্ষণ না গল্প শেষ হচ্ছে। ঠাম্মা বলল, "তোরা যা। কাল আবার বলবো না হয়।" আমরা ততক্ষণে গল্পের নেশায় ডুবে গেছি। বললাম, "কালকে আরেকটা গল্প শুনবো। আজ এটা শেষ করবোই।" সন্ধ্যেবেলা একটা বড় কাঁসার থালায় করে মাইমা দিস্তে দিস্তে লুচি আর জামবাটিতে উঁচু উঁচু করে ভর্তি ডাল, আলু পটলের তরকারি আর আরেকটা থালায় ছানা মাখা দিয়ে গেলো। ঠাম্মা নিজেও খেলো, আমাদের সাত নাতি নাতনিকেও খাইয়ে দিলো। খেয়ে উঠে আবার চলল গল্প। যতক্ষণে পাণ্ডবেরা মহাপ্রস্থানের পথে, রাত প্রায় নটা। আমাদের চোখ ঘুমে ঢুলছে। তবুও উঠবার নাম নেই। শেষ মেশ ঠাম্মার ওপর প্রচুর অত্যাচার করে দশটার দিকে গল্প শেষ করে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে আমরা পাঁচ ভাই বোন বাড়ি ফিরলাম। বকুল মুকুলের বাবা, অর্ধেন্দু মামা আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিলো। বাড়ি ঢুকতেই মাসির গলা, "এতক্ষণে বাড়ি ফেরার নাম হলো?"
মায়ের গলা, "থাক এখন ঘুমক সব। কাল আবার রাত্রে ট্রেন। ঘুমের প্রব্লেম হবে। যাক গে। ছিল না সারাদিন, আমরাও নিশ্চিন্ত ছিলাম।" মা আমায় নিয়ে ঘরে শুইয়ে দিলো। বললাম, "জানো তো মা, আজ না ঠাম্মা আমাদের মহাভারতের গল্প বলেছে। খুব ভালো লেগেছে মা। আমায় আবার পড়ে শুনিয়ো।" মা হাসল। চুলগুলো একটু হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "বাড়িতে আছে। নিজে নিজে পড়বি। নামিয়ে দেবো। যখন বই পড়তে বলি, শুনিস না!"
আমি মনে মনে জিভ কাটলাম। এমন ট্রেজার বাড়িতে আছে আর আমি পড়িনি? মায়ের কথা শুনে চলতে হবে দেখছি এবার থেকে। বিয়েবাড়িটা মিটুক। বাড়ি ফিরেই ঝাঁপিয়ে পড়বো। ঠাম্মা বলেছে, এই লেখকের আরো অনেক দুর্দান্ত লেখা আছে। সবপড়ে ফেলবো।

No comments:

Post a Comment