Saturday, June 29, 2019

বিবাহ অভিযান ২

- তোমার পাহাড় ভালো লাগে নাকি সমুদ্র?
- পাহাড়।
- সমুদ্র একটুও ভালো লাগে না?
- না তেমন না।
- শিওর?
- হ্যাঁ।
- ঠিক তো?
- আরে বাবা। এই সামান্য জিনিস নিয়ে এত প্রশ্ন কেন!
- আসলে হানিমুন প্যাকেজটা সমুদ্রের ধারে বুক করেছিলাম। তাই। ঠিক আছে। ক্যানসেল করে নেব।
- ক্যান্সলেশন ফিজ?
- তা ভালোই যাবে।
- তাহলে থাক।
- কী থাক?
- প্যাকেজ যেমন আছে, থাক। সমুদ্রেই না হয় যাবো।
- না না। তুমি পাহাড় ভালোবাসো তো।
- তুমি তো সমুদ্র ভালোবাসো।
- ঠিক আছে। সে না হয় পরের ভেকেশন সমুদ্রে হবে। বছরে দুটো তো যাওয়ার কথা হয়েই আছে।
- তাও। আমার চয়েসটাই প্রায়োরিটি পাচ্ছে।
- তাতে কী। নেক্সট টাইম আমারটা পাবে।
- তবুও...
- বেশ, এত যখন খুঁতখুঁত করছো, খোঁজ নিই ডেট পাল্টানো যায় কি না। আগে তাহলে টুক করে তিনদিনের জন্য দার্জিলিং থেকে ঘুরে আসি। তারপর সমুদ্র। যেখানে বুক করেছি।
- দেখো।
- দেখলাম। হবে না। রিসিডিউলিং করতেও খরচ ভালোই।
- তাহলে আর জিজ্ঞেস করলে কেন?
- না মানে তোমার ওপিনিয়ন নেওয়াটা উচিত বলে।
- ওপিনিয়ন আদৌ নিচ্ছ?
- বলছি তো ক্যানসেল করে দিই।
- ফালতু ফালতু খরচ হবে। তারপর তো আমায় কথা শোনাবে।
- না না সে কেন। এ বাবা।
- না থাক। সমুদ্রই চলো।
- শিওর?
- উফ। বললাম তো।
- বেশ। তাহলে কিন্তু এর ক্যানসেল করছি না।
- বললাম তো।
- ঠিক আছে। কনফার্ম করে দিলাম।
- করে দিলে?
- হুম। কেন?
- না কিছু না।
- আরে, বলো?
- না।
- বলবে তো?
- সেই দেখলে তো, তোমার চয়েসটাই প্রাধান্য পেলো।
- আরে আমি তো তোমায় এতবার করে জিজ্ঞেস করলাম। তুমিই তো বললে টু গো এহেড।
- সে তো মুখে বলেছি। মিন করেছি নাকি?
- সে আবার কী কথা? মুখে এক, মনে আরেক?
- অবশ্যই। তুমি আমার কথা শুনবে না। আমি তারপর গোঁসা করবো। মান অভিমান হবে। তবে না দাম্পত্য?
- বোঝো ঠ্যালা!
- দেখো বাপু, চব্বিশ ঘন্টা হয়েছে ডিল ডান করেছি। ই কমার্স রিটেল সাইটেও উইদিন ২৪ আয়ার্স ফ্রি রিটার্ন, নো কোয়েশ্চেন আসকড। চান্স আছে তোমার। চাইলে ফিরে যেতে পারো।
- নাঃ। রিটার্ন আমি করিনা। এক্সচেঞ্জ করি খুব। এই ক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ পলিসি আছে?
- বুড়োর কত শখ দেখো না! হুহ।

(কালকেই আপনারা মশারি, ওয়াশিং মেশিন, থালা বাসন ইত্যাদি পয়েন্টস রেইজ করলেন। দেখুন, সংসার শুরুই করেনি। তার আগেই কেমন ঝামেলা লেগে গেছে!!)

Friday, June 28, 2019

বিবাহ অভিযান ১

- আচ্ছা শোনো, লেটস গেট ম্যারিড।
- রিজন?
- তুমিও বিয়ে করবে করবে ভাবছ, আমিও তাই। দুজনের ফ্যামিলিও ইন্সিস্ট করছে। প্লাস আমরা দুজনে দুজনকে চিনি। খুব একটা অসহ্য কারুরই কারুকে লাগেনা। সো...
- মেকস সেন্স বলছ?
- হ্যাঁ।
- বেশ। করাই যায়।
- তবে হ্যাঁ, আই কাম উইথ আ লট অফ ইমোশনাল ব্যাগেজেস।
- আই অ্যাম নো লাইট ট্র্যাভেলার ইদার!
- তাও, দুজনের কম্বাইন্ড লাগেজ হয়তো পারমিসিবল লিমিটে থাকবে।
- হোপ সো।
- তাহলে ডান ডিল ধরি?
- দাঁড়াও, কয়েকটা বক্তব্য আছে।
- বলো।
- রাদার দাবী।
- নির্দ্বিধায় বলে ফেলো।
- বছরে দুটো ভেকেশন চাই। ফাইভ স্টার, exotic কিছু না। তবে বেড়ানো।
- যদি বলি তিনটে?
- অত ছুটি কে দেবে?
- পয়েন্ট! চলো, নেক্সট?
- তোমার এই এনভিয়েবল বইয়ের কালেকশনে আমায় হাত দিতে দেবে তো? অন্যদের তো দিতে চাও না।
- হ্যাঁ অবশ্যই। আর কিছু?
- দাঁড়াও। হাঁপিয়ে গেলে নাকি? আরো কয়েকটা আছে।
- বলো।
- এত বিষয়ে পড়াশোনা করো, এত গভীর জ্ঞান... মাঝে মাঝে আমায় গল্পের ছলে এসব শোনাতে হবে।
- খুব খুশি হবো!
- গুড। ভালো ভালো ছবি তুলে দিতে হবে। সব ফেসবুকে দেবো না। তাও। বি মাই পার্সোনাল ফোটগ্রাফার।
- মাই প্লেজ্যার!
- ব্যস। আপাতত আর কিছু মনে পড়ছে না। পরে পড়লে বলবো।
- বেশ তো। সব পয়েন্টেই আমি রাজি।
- তোমার কিছু বক্তব্য আছে?
- আমার তেমন কিছু না। ওই ইউজ্যুয়াল রেস্পেক্ট, ইক্যুয়ালিটি এটসেট্রা এটসেট্রা।
- হ্যাঁ হ্যাঁ, ওগুলো তো বাই ডিফল্ট।
- তাহলে ভালোই। আমার আর কিছু বলার নেই।
- ও, মনে পড়েছে। তুমি রান্না করতে ভালোবাসো, আমি ততটাও না। তাই রান্নার লোডটা শেয়ার হবে এমনভাবে যে মেজরিটি রান্না তুমিই করবে। ভালো মন্দ খাওয়াবে রেঁধে বেড়ে। আমি নাহয় উইক্লি ডাইন-আউটের খরচটা বেয়ার করবো।
- ওকে। আর?
- কী করে বুঝলে এর মধ্যেই আমার আরেকটা পয়েন্ট মাথায় এসে এগছে?
- বন্ধু তো রে বাবা। সব বুঝে যাই।
- গুড। নেক্সট পয়েন্ট, দুজনেই মোটা। বলছি না স্লিম অ্যান্ড ট্রিম হতে হবে। কিন্তু বেসিক মিনিমাম ওয়ার্ক-আউট করবো। একসাথে। বি মাই ওয়াকিং পার্টনার অ্যাট লিস্ট। হ্যাপি হরমোনসরিলিজ হবে। গুড ফর আস।
- ঠিক আছে। এগ্রিড।
- ওকে। ডান ডিল দেন।
- লেটস রেইজ আ টোস্ট টু দিস ডিল। চিয়ার্স।
- চিয়ার্স। টু নিউ বিগিনিংস।


তুয়ার হিজিবিজি ২০

হাইওয়ে বরাবর চলছে গাড়িটা। মা বাবা দুজনেই এসেছেন ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে। পুজোর ছুটিতে। বাবা ড্রাইভারের পাশে বসে। মাঝের সীটে জানলার ধারে বসে আছে তুয়া। পাশে মা। আর মায়ের পাশে শ্রীময়ী ম্যাম। জানলার কাঁচ নামানো। কাল রাত্রে বৃষ্টি হয়েছে। চতুর্থীর আকাশ বড়ইমেঘলা। ঠান্ডা ভিজে হাওয়া এসে ঝাপটা দিচ্ছে তুয়ার মুখে। তুয়া ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। সেদিনের সেই বিভীষিকার পর থেকে কেমন একটা চুপ করে থাকে সারাক্ষণ।
ওই ভয়ঙ্কর দিনে ও যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল মকবুলের ফ্ল্যাট থেকে, তারপর সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক হেঁটে বেড়িয়েছে। উদ্দেশ্যহীন। দিকভ্রান্ত। এমনই অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পৌঁছে গিয়েছিল ও এক্সাইড মোড়ে, কী করে, কিচ্ছু জানে না তুয়া। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ উল্টোদিক থেকে আসা একটা গাড়ির সামনে এসে পড়ে ও। ও এখনো জানে না। ও কি তাহলে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল? সৌভাগ্যবশত গাড়িটা সঠিক সময় ব্রেক করে। ড্রাইভারের সিট থেকে বেরিয়ে আসেন শ্রীময়ী ম্যাডাম। তুয়াকে দেখে, তাও এই অবস্থায়, উনি যারপরনাই অবাক হন। বোঝেন, কিছু গভীর সমস্যা। ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়িতে তুলে সোজা চলে আসেন নিজের বাড়ি। তুয়া কুঁকড়ে যায় সোফা দেখে। সারা শরীর কাঁপতে থাকে ওর। শ্রীময়ী কিছু বলেন না। চুপ করে বসে থাকেন ওর পাশে। খানিক পরে তুয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। শ্রীময়ী তুয়ার কাঁধে স্নেহের আলতো চাপ দিতেই তুয়া শ্রীময়ীর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। শ্রীয়ের স্নেহভরা সান্ত্বনার পরশ কাজ করে ম্যাজিকের মতো। ও শ্রীময়ীকে সমস্ত ঘটনাটি বলে।
শ্রীময়ী বিচক্ষণ মানুষ। তার ওপর এখন খুব জনপ্রিয় একটি মিডিয়া হাউজে চাকরি করেন। সঙ্গে সঙ্গে তুয়াকে নিয়ে লোকাল থানায় গেলেন এবং মকবুলের নামে কমপ্লেন লেখালেন। থানা প্রথমে বিদেশি নাগরিক ইত্যাদি শুনে বেগড়বাই করলেও প্রেস দেখেই একদম সুরসুর করে যাবতীয় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। শ্রীময়ী এরপর হৈমন্তী ম্যামের নম্বর জোগাড় করে কলেজেও জানালেন মকবুলের এই কুকীর্তির কথা। জেঠু জেঠিমাকে জানিয়ে তুয়াকে কটাদিন নিজের কাছেই রাখলেন শ্রীময়ী। তুয়ার এখন দরকার মানসিক বল ভরসা। তুয়ার কথামতই তক্ষুনি ওর বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়নি। দিন তিনেক পর তুয়া কলেজ যাওয়া শুরু করলো। প্রথম দিন ভীষণ আড়ষ্ট ছিল ও। সব্বাই বুঝি ওর দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, আর আড়ালে হাসি ঠাট্টা করছে। দেখো, খুব তো উড়ছিলে। এবার বোঝো কত ধানে কত চাল! তুয়ার কান্না পেয়ে যেত। লাইব্রেরিতে বসে একটা কর্নারে হাপুস নয়নে কাঁদতো। কপাল ভালো। কদিনের মধ্যেই শুরু হলো টার্ম একজ্যাম। সবাই নিজের নিজের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। তুয়ার পরীক্ষা খুব খারাপ হলো। কিন্তু একটাই সান্ত্বনা, পরীক্ষা শেষেই পুজোর ছুটি। দু সপ্তাহের।
শ্রীময়ী তুয়ার খুব যত্ন করেছেন এই কদিন। কিন্তু এবার যে তুয়াকে ফিরতেই হবে বাড়ি। তুয়া চায়নি ওর মা বাবাকে কিছু জানাতে। পাছে তারা আর ওকে কলকাতায় একা থাকতে না দেন। যদি কলেজ ছাড়িয়ে দেন। শ্রীময়ী ওকে অনেক বোঝালেন। বললেন, "মা বাবা বিচক্ষণ। এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না। কিছু একটা সলিউশন ঠিক আসবে। আর নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ কর। ঘৃণ্য কাজ যে করেছে, তার লজ্জা পাওয়া উচিত। তুমি কেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকবে? মনে করো কোনো খারাপ ইনফেকশন হয়েছিল। এখন ওষুধ পড়েছে। সেরে গেছে। তা বলে কি তুমি তাও লুকিয়ে থাকবে? জীবন মোটেই শেষ নয় তুয়া। সামনে লম্বা জীবন। নানান সময়ে নানান বাধার সম্মুখীন হবে। লড়াই করতে হবে তো? হাল ছাড়লে কী করে হবে? শোনো, তুমি যথেষ্ট সাহসী মেয়ে। এবং স্ট্রং। নিজের ওপর ভরসা রাখো। এগিয়ে চলো। ঠিক পারবে। কাদা ছিটিয়েছে বলে রাস্তায় হাঁটা বন্ধ করে দেবে? না পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আবার রোজের জীবনে ফিরবে? এটাও তাই। মকবুল ছিল একটা পাঁক। ওই ময়লা থেকে এখন তুমি মুক্ত। স্নান সেরে পরিচ্ছন্ন। কেন ওই নিয়ে আর ভাববে? তুমি কোনো দোষ করোনি। ভালোবাসা, ভরসা করা কোনো পাপ না। দোষের না। দোষ তো করেছে মকবুল। ঠকিয়েছে তোমায়। অসাধু আচরণ করেছে। আর তার শাস্তি পাবেই ও। পুলিশ ব্যবস্থা করবে। তুমি নিজেকে গুছিয়ে ফেলো তো। সামনেই পুজো। আনন্দ করো। মন ভালো রাখো। কলেজে ফিরে দেখবে, বন্ধুরা আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ততদিন তো আমি রইলামই, বন্ধু ভাবো না আমায়?"
শ্রীময়ী নিজে তুয়ার মা বাবাকে সমস্ত ব্যাপারটা জানান। এবং কাউনসিলিং করার কথাও বলেন। মা বাবা প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে লেগে পড়েন এই লড়াইয়ে। মেয়েকে আবার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার লড়াই।
গাড়িটা চলতে চলতে থামে এক জায়গায়। চায়ের ব্রেক। শ্রীময়ী তুয়াকে নিয়ে গাড়িতেই বসেন। মা বাবা চা খেতে যান। জানলার বাইরে দিয়ে আকাশে তখন মেঘের আড়াল কেটে সূর্যদেব বেরিয়েছেন। আকাশও ঝকঝকে নীল হবো হবো। এক দল ঢাকি দল বেঁধে ঢাকের বোল তুলতে তুলতে এগিয়ে চলে। সামনের কোনো মণ্ডপে বায়না আছে। দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে। এইবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তুয়া শ্রীময়ীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে।

Monday, June 24, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ১৯

অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত শুক্রবার হাজির। বৃহস্পতিবার রাত অবধি ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়লেও সকাল থেকে শরতের আকাশ নীল। ঝকঝকে। সাদা মেঘের ভেলা। পুরো কাব্যিক ও আইডিয়াল পরিবেশ। গিনির সাথে আলাপ আলোচনা করে সাজ পোশাক ঠিক হয়ে গিয়েছে। পেঁয়াজ রঙের কুর্তি আর গাঢ় নীল জিন্স। কিছুদিন আগেই কেনা। ম্যাচিং কানের দুল। দুদিন আগে পার্লার থেকে ঘুরে এসেছে তুয়া। ফেশিয়াল, হেয়ার স্পা। ফুরফুরে চুলকে খোলাই রেখেছে। আই লাইনারের ফাইনাল টাচ দিয়ে একবার নিজেকে দেখে নিলো তুয়া। সেলফি তুলে গিনিকেও পাঠালো। ওর এপ্রুভাল লাগবে যে। ঘড়ির কাঁটায় দশটা। এবার বেরোতে হবে। একটু বুক ধুকপুক করছে তুয়ার। অন্য সব ব্যাপারে মাকে বলেই কাজ করে ও। কিন্তু এই মকবুলের সাথে সম্পর্কের কথাটা যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছে। আর এইসব সময়েই ওর আরো মনে হয়। ভাগ্যিস আলাদা থাকে। তাই বাড়ির লোকের কাছে কোনো জবাবদিহি করতে হয়না ওকে।
রাস্তাঘাট সম্বন্ধে খুব বেশি সড়গড় না মকবুল। তাই ঠিক ছিল দুজনেই সাউথ সিটি মলের সামনে দেখা করবে। মকবুলের ভাড়া বাড়ির কাছেই। সেখানে সিনেমা দেখে লাঞ্চ সেরে ভিক্টরিয়া। এইরকমই প্ল্যান। কী সিনেমা, কিছুই মকবুল বলেনি। তুয়া জিজ্ঞেস করতে, খালি বলে গেছে। দেখতেই থাকো। আমি গোটা দিনটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছি। দেখো, দিনের শেষে তোমার ভালো লাগবে। তুয়া আর এরপর কিছু বলতে পারেনি। বেশ আসন্ন সারপ্রাইজের কথা ভেবে উত্তেজিত।
পৌনে এগারোটা নাগাদ সাউথ সিটি পৌঁছলো তুয়া। মকবুল ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। আজ ওর পরনে সাদা লাল চেক শার্ট আর কালো জিন্স। চোখে নীল সানগ্লাস। ক্লিন শেভড। ঠিক যেন গ্লসি কোনো ম্যাগাজিন কাভারের মডেল। তুয়া হা করে তাকিয়ে থাকে। মকবুল এগিয়ে এসে আলতো হেসে "লুকিং গ্রেট" বলে। তুয়া লক্ষ্য করে, মকবুলের চোখেও সেই একই রকমের মুগ্ধতা। "যাওয়া যাক। সিনেমা হলের ফ্লোরে", এই বলে মকবুল তুয়াকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে মলের। সিনেমার বুকিং কাউন্টারে লম্বা লাইন। তুয়াকে পাশে দাঁড় করিয়ে লাইনে আসে মকবুল। এদিক সেদিক টুকটাক কথাবার্তা চলে। হাসি মজা। লাইন এগোয়। এমন সময় মকবুলের ফোন বাজে। "আব্বুর ফোন। ধরতে হবে।"
এক তরফা কথা শুনে তুয়া বোঝে, মকবুলকে জরুরি কিছু ডকুমেন্ট মেল করতে হবে এক্ষুণি। আর সেই ডকুমেন্ট যে বাড়িতে, সেটা মকবুল জানায় তুয়াকে। ও তুয়াকে মলে খানিক অপেক্ষা করতে বলে। ও গিয়েই নিয়ে আসবে কাগজ। সিনেমার টিকিটও কাটতে যায় দুজনের। কিন্তু না। তুয়া একা একা একটুও সিনেমা দেখবে না। ও বলে, ও মকবুলের সাথেই যাবে। কাছেই যখন, অসুবিধাও নেই যাওয়ার। ও যাবে। মকবুল খানিক ইতস্তত করে। তারপর "শিওর? তাহলে চলো" বলে এগোয়। তুয়াও পিছু পিছু হাঁটা লাগায়। একটু যেন দমে আছে। এ কী, শুরুতেই বাধা। মনমরা হয় ও। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। না। মন খারাপ করলে চলবে না। সামনে গোটা দিন বাকি।
রিকশা চেপে ওরা পৌঁছয় মকবুলের ভাড়া বাড়িতে। একটা তিনতলা বাড়ির দোতলায় ফ্ল্যাট। এক কামরার। মকবুল আর আরো একটি ছেলে থাকে। ওরা ঢুকতে দেখলো ছেলেটি কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। জুতো পরছে। মকবুল পরিচয় করিয়ে দিল তুয়ার সাথে। ছেলেটি মেডিকেল রেপ্রেজেন্টেটিভ। নাম শ্যামল। তুয়াকে দেখে হেলো বলে মকবুলকে "ভাই, এলাম। এঞ্জয়" বলে বেরিয়ে গেল। মকবুল তুয়াকে বললো, "তুমি একটু বসো। আমি আসছি।" রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস জল এনে দিল। মকবুল ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলো। তুয়ার তেষ্টা পায়নি। তবুও এক ঢোক জল খেলো।
ভিতরের ঘর থেকে আলমারি দেরাজ খোলা বন্ধর আওয়াজ আসছে। "আর খানিকক্ষণ, আসছি।" মকবুল বলে। তুয়া ফোন হাতে খুটখাট করে। ওয়াটসআপে গিনিকে জানায় আপডেট। গিনি একটু স্যাড স্মাইলি পাঠায়। ফেসবুকের জগতেও তেমন কিছুই আপডেট নেই। প্রায় মিনিট কুড়ি পর মকবুল আসে ঘরে। সোফায় এসে ঠিক ওর পাশটিতে এসে বসে। একদম গায়ে গায়ে। তুয়া মনে মনে রোমাঞ্চ বোধ করে। বুকের ধুকপুক বেড়ে যায়। দুজনের হাতে হাত ছুঁয়ে যায়। তুয়া একটু ভীতু। ও এক চটকায় হাত সরিয়ে দেয়। ওর মধ্যবিত্ত মানসিকতা ওকে এখনো তেমন সাহস দেয়নি।
মকবুল আবার ওর হাতের মধ্যে তুয়ার হাত চেপে ধরে। তুয়া হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। পারেনা। মকবুলের হাতের জোর খুব বেশি। এবং তারপরই একদম হঠাৎ করেই তুয়ার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। তুয়ার ভালো লাগেনা। অস্বস্তি হয়। ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। মকবুল শক্ত হাতে তুয়াকে সোফায় ফেলে দেয়। বন্য। উন্মত্ত মকবুল। অসহায় তুয়া লড়াই চালাতে থাকে। মকবুলের কমনীয় রূপ যেন আসুরিক শক্তিতে পরিণত। চোখ বন্ধ করে তুয়া নিজেকে ছাড়ানোর লড়াই চালিয়ে যায়। হাত পা ছুঁড়তে থাকে। ক্রমশ ওর প্রতিরোধ শক্তি কমে আসে। মকবুল পশুর মতো ওকে ছিঁড়ে খেতে যায়। ধস্তাধস্তিতে তুয়া সোফার ধারে পৌঁছে গিয়েছে। এমন সময় ঠিক মিরাকেলের মতো তুয়ার হাত ঠেকে যায় সাইড টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে। প্রাণপণে শেষ চেষ্টা করে তুয়া সেটি হাতে নিয়ে মকবুলের মাথায় মারে। মকবুল হকচকিয়ে যায় এই অতর্কিত আঘাতে। তুয়াকে ছেড়ে মাথার পিছনে হাত চেপে বসে পড়ে। তুয়া কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের ব্যাগ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রোবটের মতো চলতে থাকে। কোনদিকে তাকায় না। বেশভূষা চুল সব আলুথালু। রাস্তাঘাট জনমানবহীন।
তুয়া হাঁটে। দু চোখ বেয়ে জল গড়ায়। সেই জলে ধেবরে যায় আই লাইনার। গালে চোখের জলের দাগ। আর গড়িয়ে পড়া কালো লাইনার।
বিধ্বস্ত। ত্রস্ত। স্তম্ভিত।

তুয়ার হিজিবিজি ১৮



ফ্রেশার্সের পর মাস দুয়েক কেটে গেছে। তুয়ার জীবনে এসেছে পরিবর্তন। যে মেয়ে নিয়ম করে এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তো, সেই এখন রাতের পর রাত জাগছে। মেসেঞ্জারে অনন্ত আড্ডা চলে মকবুলের সাথে। সিনেমা গান রাজনীতি। সব। মকবুল খুব সুন্দর কথা বলে। মন জয় করে ফেলতে পারে মুহূর্তেই তার শব্দবাণে। তুয়ার ভারী ভালো লাগে কথা বলতে। গল্প করতে করতে এতটাই মজে যায়, বেশিরভাগ দিনই ভোরের আলো ফুটতে দেখে চোখ বোজে দুজনে।
তুয়া গিনিকে সব কথা বলে। গিনি একটু আধটু সাবধানে বাণী শোনায় বটে। এত মাখামাখি, কী ব্যাপার। পরমুহূর্তেই আবার ভাবে, না। হয়তো ছেলেটা সত্যিই তুয়াকে ভালোবাসে। তুয়াও "হ্যাপি"। অন্তত অনেকদিন পর তুয়ার মধ্যে একটা প্রাণ দেখে গিনি। খুশি হয়। তুয়াও বেশ উপভোগ করছে। সারাদিন কলেজে চুপচাপ থাকে। মকবুলের ক্লাসে কোনো বাড়তি অভিব্যক্তি নেই। দুজনের কেউই প্রায় কারুর সাথে কথা বলে না। এমন কি সোশ্যাল মিডিয়াতেও না। মকবুল ক্লাসের বাকিদের সাথে বেশ বন্ধুর মতো মিশে গিয়েছে। হৈ হৈ গল্প গুজব ঠাট্টা ইয়ার্কি সব হয়। যেন ওদেরই একজন। কিন্তু তুয়াকে যেন ইচ্ছে করেই এভয়েড করে। তুয়ার বন্ধুরা ব্যাপারটা হয়তো লক্ষ্য করেছে। এক দুবার কেউ কেউ বলেওছে। এত কীসের নাক উঁচু যে মকবুলকে পাত্তাও দেয় না তুয়া। তুয়া চুপ থাকে। কিছু বলে না।
কিন্তু প্রতি রাতে ওদের মেসেঞ্জারে চ্যাট চলে। গোটা দুনিয়ার থেকে একদম গোপনে। অগোচরে। গিনি এই নিয়ে একবার কথা তুলেছিল বটে। কিন্তু তুয়া গা করেনি। ফেসবুকের একটা পোস্ট উল্টে শেয়ার করেছিল গিনির সাথে। the best relations are those which leave no trace in social media.
দেখতে দেখতে আরো দিন কাটতে থাকে। পুজোর ছুটি পড়তে আর সপ্তাহ দুই বাকি। তুয়ার খুব ইচ্ছে করে মকবুলের সাথে বেরোতে। হাতে হাত রেখে ঘুরতে। খোলা মাঠে। নীল আকাশ। সব সাক্ষী রেখে "ভালোবাসি" বলতে। চিৎকার করে। কিন্তু মকবুল কখনো রাজি হয়না। বার তিনেক বলেছে ও। মকবুল প্রতিবারই আর কদিন যাক। কে দেখে ফেলবে, এইসব বলে থামিয়ে দিয়েছে তুয়াকে। তুয়া একটু দমে যায়। আর বলেনা। অভিমান করে। কিন্তু মকবুল কথার জাদুতে ওর সেই অভিমান কাটিয়ে দেয়। মান ভাঙায়।
হঠাৎ একদিন মকবুল মেসেজ করে, "এই শুক্রবার, ক্লাস কাটবে? চলো কোথাও যাই।"
তুয়ার আনন্দের সীমা ধরে না। অবশেষে ওর স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। হাতে আর তিনদিন। গিনিকে এক্ষুণি চাই। ওকে বলতেই হবে সবটা।
কাউন্টডাউন শুরু হয় তুয়ার।

তুয়ার হিজিবিজি ১৭



মকবুলের ফেসবুক প্রোফাইল বারবার টানে তুয়াকে। সারাক্ষণ প্রোফাইল ঘাঁটতে থাকে। ছবি দেখে। পুরোনো পোস্ট দেখে। মেসেঞ্জারে আবার অনলাইনও দেখাচ্ছে। চ্যাট উইন্ডো খুলে বসে থাকে তুয়া। একবার কি হাই হেলো করবে? হেলো স্যার। লিখে আবার ডিলিট করে দেয়। একই কান্ড করে ওয়াটসআপে। বারবার চ্যাট বক্স খুলে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। অনলাইন দেখলে একটু হার্ট বিট স্কিপ করে। কিন্তু লেখালিখি কিছুই করতে পারেনা। ক্লাসের ওয়াটসআপ গ্রুপে সবাই "ক্যামেরাম্যান"দের বারবার তাড়া দিতে থাকে ফ্রেশার্সের অনুষ্ঠানের ছবি দিতে। অবশেষে রাত দুটোর দিকে ফেসবুকে এলবাম আসে ছবির। অজস্র ছবি। প্রচুর ট্যাগ। তুয়া মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে কিছু ছবিতে। ও আর মকবুল। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। বা নাচছে। ওর স্টেজে গান গাইবার সময়ের একটা দারুণ ক্লোজ আপ ছবি তুলেছে সুনন্দ। দামী শাড়ির কারুকার্য তো বোঝা যাচ্ছেই, তেমনি সাজের পরিপাটিও ভালোই দেখা যাচ্ছে। খুব পছন্দের গয়না। সেটাও হাইলাইট পেয়েছে। সব মিলিয়ে যাকে বলে, একেবারে একশোতে একশো ছবি। ওটাকেই তুয়া ডিসপ্লে পিকচার বানালো। পরপর লোকজন লাইক কমেন্ট লাভ দিতে থাকে ছবিতে। কিন্তু তুয়া যার রিএকশনের অপেক্ষায়, তার পাত্তা নেই। প্রায় ভোর রাত অবধি অপেক্ষা করতে থাকে ও। অবশেষে ঘুমে চোখ জুড়িয়ে যায়।
সকালে উঠে তুয়া খেয়াল করে, অনেক বেলা হয়ে গেছে। ইশ। বাজারহাট করার আছে। ছি ছি। আগে কখনো এমন হয়নি। তড়িঘড়ি ও উঠে হাতমুখ ধুয়ে ছোটে বাজারে। ফোন খুলে ফেসবুক দেখা হয়নি। বাজারহাট সেরে, রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে কচুরি জিলিপি কিনে বাড়ি ফেরে তুয়া। তারপর আয়েশ করে এক কাপ কফি বানায়। ব্রেকফাস্ট খাবে। ফোনের থেকে ফেসবুক খোলে। প্রচুর প্রশংসা ওর ছবিতে। গানের ভিডিও শেয়ার করেছে পল্লবী। সেখানেও দারুণ ভালো ভালো কথা লিখেছে লোকজন। এক দুজন স্যার ম্যামেরাও। কিন্তু মকবুলের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। আশ্চর্য লাগে তুয়ার। তা হলে কি ও ভুল পড়ছিল মকবুলের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ? অযথা আশাবাদী হচ্ছিল? না না। নিশ্চয়ই মকবুল ফেসবুক দেখেনি। তাই কোনো নোটিফিকেশন নেই। স্কলার মানুষ। সকাল থেকেই থোড়াই এইসব করবে? নিজেকে সান্ত্বনা দেয় তুয়া। পরমুহূর্তেই নজরে আসে। এলবামের কিছু কিছু ছবিতে লাইক পড়েছে বই কি। মকবুলের। তাহলে? বিমর্ষ বোধ করে তুয়া। ফ্রিজ থেকে একটা চকোলেট বের করে খায়। শুনেছে, ডার্ক চকলেট খেলে মন ভালো হয়। গিনিকে মেসেজ করে। জানায় সব কথা। গিনি বুঝে পায় না কী বলবে।
ঠিক তক্ষুনি মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ ঢোকে। মকবুলের। "পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।"
তুয়া থমকে যায়। কী লিখবে এর উত্তরে, ভেবে পায়না। আবার মেসেজ আসে উল্টোদিক থেকে।
"অপূর্ব লাগছে এই ছবিতে তোমায়। অবশ্য তুমি সব সময়েই সুন্দর। আসলে মূল পোস্টে কমেন্ট করলে তোমারই বন্ধুবান্ধব, বিশেষ করে ক্লাসমেটরা কিছু মনে করতে পারে, তাই ওখানে কিছু বলিনি। আলাদা করে লিখলাম।"
তুয়ার হাত কাঁপে। একলা ঘরে বসে লজ্জায় রাঙা হয়। কিছু লিখতে পারে না উত্তরে। তাকিয়েই থাকে লাইন কটার দিকে। এই কবিতা তো কত কত বার ও পড়েছে। মুখস্থ। কই, এমন অনুভূতি তো আগে হয়নি। এ অনুভূব একদম অন্য রকম। আলাদা ভালো লাগা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে থাকে। সবে ভদ্রতা ও সৌজন্যমূলক ধন্যবাদ লিখতে যায়, আবার মকবুলের মেসেজ আসে। "আই এম সরি। বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে প্লিজ ক্ষমা করে দিও।"
তুয়া ঝটপট লেখে, " না না ঠিক আছে। থ্যাংক ইউ। কমপ্লিমেন্ট পেয়ে আমি অভিভূত।"
মকবুল শুধু একটা স্মাইলি পাঠায়। তারপর লেখে, "হ্যাপি সানডে। কাল ক্লাসে দেখা হচ্ছে। আমি একটু কালকের প্রিপারেশন নিই। সি ইউ।"
তুয়া "বাই" লেখে।
ক্লাসের ওয়াটসআপ গ্রুপে চোখ দেয়। চলছে ছবি নিয়ে চর্চা। মেয়েরা মকবুলকে নিয়ে বিগলিত। কার কোন ছবিতে লাভ দিয়েছে, কমেন্ট করেছে, সেই নিয়ে সব উড়ছে। তুয়া হাসে। মনে মনে।
তারপর আবার মেসেঞ্জার খোলে। এখনো গ্রীন লাইট অন। বারবার পড়তে থাকে ওই কটা লাইন।

Sunday, June 23, 2019



সফরনামা



১।

প্রতিদিনের মতই আজও অগ্নি শেয়ার ক্যাব বুক করলো অফিস যাবে বলে। তিরুভন্ম্যুর থেকে পেরুঙ্গুডি ওর অফিস মোটামুটি উড়ি পঁচিশ মিনিটের রাস্তা। ওই পাড়াটা অফিস পাড়া হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই শেয়ার ক্যাবের বাকি সহযাত্রীরাও ওই একই অঞ্চলেই নামেন। অগ্নি রোজ অ্যাপে দেখে নেয়। কাদের সাথে ওকে ক্যাব শেয়ার করতে হবে। কোনদিন হয় কন্নন, কোনদিন বালা, আবার কোনদিন রাজলক্ষ্মী বা মাধবন। ছাব্বিশ বছরের অগ্নির জীবনে সেই বিশেষ মানুষটির এখনও আগমন হয়নি। টিভিতে শেয়ার ক্যাবের বিজ্ঞাপনে সহযাত্রীর সাথে প্রেমের গল্প তাই এখনও ওকে ভরসা জোগায়। আর সেই জন্যই অধীর আগ্রহে ও প্রতিদিন অফিস জাতায়াতের সময়ে চাতক পাখীর মতো অপেক্ষা করে থাকে। সহযাত্রীটি যদি ভুল করেও সুরঙ্গমা বা সুনন্দা বা মাধবীলতা হয়।

বছরখানেকের ওপর হয়ে গেলো অগ্নি কলকাতা থেকে বদলি হয়ে চেন্নাই এসে পৌঁছেছে। আর পাঁচটা আই টি কোম্পানির চাকুরেদের মতোই দশটা-সাতটার জীবন। সারাদিন কীবোর্ডে খটাখট খটাখটের পর সন্ধ্যে হলে একলা ফ্ল্যাটে বই হাতে শুয়ে শুয়ে পড়া – উড়িয়া রান্নার ছেলেটি এলে ভালো, একটু ডাল-ভাত-মাছ জুটে যায়। নইলে আবার অ্যাপই ভরসা। এই থোড় বড়ি খাড়া জীবনে যে এবার একটু বৈচিত্র্য আসতে চলেছে, তা অগ্নি কিঞ্চিৎ টের পেলো যখন আজ দেখলো ক্যাবে ওর সহযাত্রীর নামটা। রুমুন দাশগুপ্ত। এবং পিক-আপ লোকেশন ঠিক ওর থেকে দুটো গলি আগে।

২।

ভাগ্যিস ওদের অফিসে এখনও প্রতিদিন ফর্মাল পোশাকে আসতে হয়। ভাগ্যিস। আরো একবার নিজের পরনের নীল স্ট্রাইপ শার্ট আর গ্রে ট্রাউজারসের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ভাবল অগ্নি। সেই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি একদিন কথায় কথায় বলেছিল, “জানিস তো, তোরা ছেলেরা এই যে সারাক্ষণ এই টিশার্ট হাফপ্যান্ট পরে ঘুরিস, ভাবিস বিশাল কুল লাগছে, আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। আমরা মেয়েরা পছন্দ করি বেশ একটা সুটেড-বুটেড লুক। আলাদা রকমের স্মার্টনেস আসে ওতে। কর্পোরেট লুক। দেখ, ক’মাস পর অফিস যাবি। তখন যদি পোশাক পরিবর্তন করে কোন হিল্লে হয়।“ চাকরিজীবনের দুই বছর কেটে গিয়েও করপোরেটের সুফল বলতে শুধুই মোটা মাইনে ছাড়া কিছুই পায়নি অগ্নি। আজ যদি বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে… এইসব ভাবতে ভাবতে অগ্নি অ্যাপে নজর দিলো। এই তো। রুমুন দাশগুপ্তকে ক্যাব পিক-আপ করেছে দেখাচ্ছে। আর এক মিনিট।। আলতো করে ডান হাত দিয়ে চুলটাকে একবার ঠিক করে নিলো অগ্নি। বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করছে। এসপার কি ওসপার, মন বলছে আজ কিছু একটা হবেই হবে। ওই তো, ওই তো। গ্রে সুইফট ডিজায়ারতা আসছে ওর দিকে। মনের ভিতরের ডিজায়ারগুলো উড়ছে ডানা মেলে।

গাড়িটা এসে থামল ওর সামনে। দেখলো ভিতরে কেউ বসে আছে। নারীমূর্তি। মুখ ফেরানো জানালার দিকে। পরনে হলুদ কুর্তা। কানে ইয়ারফোন। হঠাৎই চোদ্দ বছর বয়েজ স্কুলে পড়া লাজুক সত্ত্বাটা পেয়ে বসলো বি-টেক এম বি এর ওপর। থতমত খেয়ে সামনের দরজাটা খুলে উঠে পড়লো ও। বাধ্য ছেলের মতো সীট বেল্ট বাঁধল, ওটিপি বলল। ক্যাব রওনা দিলো।

৩।

ও এম আরে পড়ার সময় প্রতিদিনই ক্যাবটা সিগ্নালে আটকায়। আজও তার কোন ব্যতিক্রম হল না। অগ্নি বসে আছে ড্রাইভারের পাশে। লুকিং গ্লাসের দিকে মাঝে মাঝেই চোখ চলে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই রুমুন দাশগুপ্তকে বেশ ভালোমতই দেখা হয়ে গেছে। একদম পিক্সি কাট চুল। এলোমেলো হয়ে আছে। ফর্সা, গোলগাল মুখ। চোখে হাল্কা কাজলের প্রলেপ। কানে এই এত বড় ঝুমকো, হলুদ রঙের। এই ব্যতীত চেহারায় আর কোন প্রসাধনের চিহ্ন নেই। ইয়ারফোন কানে সমানে কথা বলে যাচ্ছে ফোনে। অগ্নি এক তরফাই শুনতে পাচ্ছে কথা। খুব জোরে কথা হচ্ছে না, তাই পুরোটা আন্দাজও করতে পারছেনা। তবুও যেটুকু যা বুঝছে, মেয়েটির এই প্রথম বাড়ির বাইরে আসা। তাই বাড়ির লোকজন যারপরনাই চিন্তিত। মেয়েটির অবশ্য সেই নিয়ে কোন হেলদোল নেই। তার রুমমেট তামিলিয়ান হলেও উত্তর ভারতে থেকেছে ছোট থেকে। তাই সেই ওর হয়ে প্রয়োজনে দোভাষীর কাজ করে দিচ্ছে। মিস রুমুন দাশগুপ্ত, অগ্নি ধরেই নিলো ফর বেনিফিট অফ ডাউট, মিস দাশগুপ্তই হবেন উনি, শুধুমাত্র একজনের বিষয়েই প্রবলভাবে চিন্তিত শোনালো। গোটা কথোপকথনে বারবার বুজু কেমন আছে, বুজু কী খেলো, বুজুর ওষুধ আনা হয়েছে কি না, বুজু রাত্রে ঘুমিয়েছে কি না – এই কথাগুলিই বারবার ফিরে আসছিল। বোঝাই যাচ্ছে, এই বুজু নামক ব্যক্তিটিন্মিস দাশগুপ্তর প্রাণের ধন এবং বর্তমানে হয়তো কিঞ্চিৎ অসুস্থ। উনি আগামী দিনে প্রথম যেই ছুটি পাবেন, ছুট্টে গিয়ে বুজুকে দেখে আসবেন, এমনটাই ফোনে বললেন।

ক্যাব লোকেশনে এসে থামল। অগ্নি ড্রাইভারকে থ্যাঙ্ক ইউ বলে নেমে গেলো। এবং ব্যাপারটা কাকতালীয় নাকি ওপরওয়ালার কোন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত, বুঝল না, মিস দাশগুপ্তও একই জায়গায় নামল। এবং সবচেয়ে বড় কথা, দুজনে দুজনের দিকে একবারও তাকালো না। অবশ্য অগ্নি আড়চোখে লক্ষ্য করলো, ওরা একই লিফটে উঠেছে। ও যাবে টেন্থ ফ্লোর। মিস দাশগুপ্ত অবশ্য আগেই সেভেন্থ ফ্লোরে নেমে গেলেন।

অফিসে নিজের ডেস্কে পৌঁছনোর অপেক্ষা। সিস্টেমে লগ-ইন করেই প্রথম চলে গেলো ফেসবুকে। সার্চ বারে টাইপ করলো রুমুন দাশগুপ্ত।

৪।

দুপুর দেড়টা নাগাদ অগ্নি ক্যাফেটেরিয়াতে এলো। এই ক্যাফেটা ওদেরই বিল্ডিংয়ের চারতলায়। সমস্ত অফিসের লোকজনেরই এখানে জাতায়াতের সুবিধে আছে। মোটামুটি ঠিকঠাক দামে চলে যাওয়ার মতো খাবার পাওয়া যায় বলে দুপুরের খাবারটা ও রোজ এখানেই সারে। আজ মিস দাশগুপ্তকে দেখার পর থেকেই মন বেশ ফুরফুরে, উড়ু-উড়ু। এমন দিনে তাই টেক অ্যাওয়ে কাউন্টার থেকে পছন্দসই মাটন বিরিয়ানি নিয়ে বসল জানলার ধারের টেবিলে। অন্যান্যদিন বিরিয়ানি পেলে আর অগ্নির অন্য কোন দিকে নজর থাকে না। হুঁশও না। তবে আজ ব্যাপারটা অন্যরকম। ইয়ারফোনে বাজছে লেটেস্ট পছন্দের “আপনা টাইম আয়েগা”। মনে আশা, সকালের ঘটনার পর থেকে যদি সত্যিই টাইম আসে।

কিন্তু হায় রে, এ তো জীবনের গল্প। সিনেমা না। আয়েস করে হাত মুখ ধুয়ে যেই বেরোচ্ছে ও ক্যাফেটেরিয়া থেকে, দরজার ওপারে চোখ চলে গেলো। এক ঝলক সূর্যরশ্মির মতো ঝলমলে হলুদ সকালের সেই মিস রুমুন দাশগুপ্ত। হ্যাঁ, সকাল সকাল ফেসবুক ঘেঁটে অগ্নি কনফার্ম করেই নিয়েছে, মিস দাশগুপ্ত “মিস”ই। এবং খুব ভুল না করলে, বর্তমানে সিঙ্গল। এবং রেডি টু মিঙ্গল। অগ্নি ভেবে পেলো না। পরিচিতিসূচক হাসবে? নাকি কথা বলবে? না কী করবে? যতক্ষণে ভেবেচিন্তে একটা অতি ক্যাব্লা হাসি হাসল, ততোক্ষণে মিস রুমুন দাশগুপ্ত ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছেন সোজা বিলিং কাউন্টারে। চিনেছেন, বা আদৌ লক্ষ্য করেছেন বলে তো মনেই হয় না। যাহ্‌। কপাল। পোড়া কপাল।

৫।

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ অগ্নি কাজ গুছিয়ে ল্যাপটপটা ব্যাগে ভরে নীচে নামার জন্য বেরলো। সামান্য খিদে পাচ্ছে। সামনের দোকানটা থেকে চা-বিস্কিট খেয়ে তবে ক্যাব বুক করবে ঠিক করলো। চায়ের দোকানে তখন রাজ্যের ভিড়। পিলপিল করছে অফিস ফেরতা চাকুরেরা। চায়ের দাম মিটিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে যাবে, চোখে এসে লাগল হলুদের দমকা হাওয়া। উফ। ঠিক যেন সিনেমা। এটা যদি বাস্তব না হয়ে যশরাজের সিনেমা হতো, তাহলে ঠিক এই মুহূর্তে হাওয়া দিত মৃদুমন্দ। বা হয়তো কালবৈশাখী ঝড় উঠতো। সাথে একটু আধটু ব্যালাড বাজত। তা তো হলোই না। বরং ঘামে প্যাচপ্যাচ করতে করতে চেন্নাইকে মনে মনে পঞ্চাশবার গালাগালি দিতে দিতে মিস দাশগুপ্তকে দেখা গেলো ফোন বের করে খুটখুট করতে।

সেই দেখে অগ্নির মনে পড়ে গেলো, আরে, ওকেও তো ক্যাব বুক করতে হবে। বাড়ি ফিরতে হবে। কপাল করে যদি আবারও দুজনের একই ক্যাব হয়, তা হলে এবার কথা বল্বেই। ঠিক করে রেখেছে। রুমুন দাশগুপ্ত ফসিলসের ফ্যান, ফেসবুক থেকে জানা গিয়েছে। রূপম ইসলাম যদি এবার ওদের মধ্যে সেতু হয়। জয় রক।

ওই যে বললাম, এটা তো সিনেমা নয়। বাস্তব জীবন। ঘোরতর কঠিন বাস্তব। ক্যাব বুক হলো। সহযাত্রী রামানুজন অ্যান্ড আদার এবং স্বামীনথন। জয় রকের পাথরের ভার পকেটে ভরে অগ্নি ফিরল নিজের ডেরায়। প্রতিদিনের মতোই। বৈচিত্র্যহীন জীবনে।

৬।

এরপর কেটেছে বেশ কিছুদিন। অগ্নির আর দেখা হয়নি রুমুনের সাথে। প্রতিদিন ক্যাব বুক করার সময়, ক্যাফেটেরিয়াতে জানলার ধারে প্রিয় টেবিলে বসে খেতে খেতে, হঠাৎ কোথাও এক ঝলক হলুদ দেখলেই অগ্নির মনে পড়ে যেত সেদিনের সেই সূর্যরশ্মিকে। প্রায় দিন দশেক পর, অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে আনমনে, ইয়ারফোনে অ্যাপে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত চ্যানেলে চলছে “তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন”, ক্যাব আসতে দশ মিনিট দেরি, মাথা তুলে এদিক ওদিক দেখছে, এমন সময় প্রায় পাশেই এসে দাঁড়ালো লাল ঢাকাই শাড়ি পরিহিত মিস রুমুন দাশগুপ্ত। গানের কথার সাথে মিলিয়েই অগ্নি যেন চমকে উঠল। ঠিক যেন বায়োস্কোপ। ও হাল্কা হাসি ছুঁড়ে দিলো রুমুনের দিকে। রুমুন কি চিনতে পারলো? ওর কাজলনয়না চোখদুটিতেও যেন ক্ষণিকের চমক খেলে গেলো। চওড়া এক গাল হাসি হেসে দিলো প্রত্যুত্তরে। তারপর কী যে হলো কে জানে? বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাসটা ভারি অদ্ভুত। বেয়াড়া রকমের। ভালো ভালো লোকগুলোর মাথার পোকাগুলিকে নাড়িয়ে দিতে ওস্তাদ। ফস করে অগ্নি বলে ফেলল, “হাই, আমি অগ্নি। সেদিন শেয়ার ক্যাবে…”। “হ্যাঁ, মনে আছে। অবশ্য আপনার নাম লক্ষ্য করিনি অ্যাপে। আমি রুমুন।” বাহ, বেশ মিষ্টি কন্ঠস্বর তো, অগ্নি খেয়াল করে। আরো খেয়াল করলো, মাঝে মাঝেই মেয়েটির সরু আঙুলগুলো চলে যাচ্ছিল চুলে, উড়ে যাওয়া অবাধ্য চুলগুলিকে ঠিক রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। “বুজু কেমন আছেন?” ও জিজ্ঞেস করে ফেলে। রুমুন মুহূর্তের জন্য অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “ভালো। ভালোই আছে। বুজু আমার পুশ্যির নাম। বিড়াল।”

“ও, আপনি বুঝি ক্যাট লাভার?” অগ্নি প্রশ্ন করে। মনে মনে ভাবল, বোঝা উচিত ছিল। ফেসবুকে কাভার পিকচারে একগাদা মিষ্টি বিড়ালছানা জ্বলজ্বল করছে।

“কুকুর-বিড়াল দুইই আমার পছন্দের। বাড়িতে যদিও এখন শুধুই বুজু আছে।” রুমুন বলে। “আপনি?”

“আমি ওই দূর থেকেই সব ভালো। আসলে ছোটবেলায় আঁচড় খেয়ে সাতটা ইঞ্জেকশন নেওয়ার পর একটু দূরে দূরেই থাকি ওদের থেকে। তবে “লিভ অ্যান্ড লেট লিভ” এই পলিসিতে ঘোরতর বিশ্বাসী।” অগ্নির কথা শেষ হতে না হতেই রুমুনের হাতের ফোনটা বেজে ওঠে। হারমোনিকায় “প্যার হুয়া চুপকে সে”। আহা, শ্রুতিমধুর বটে। ও ফোন তুলে কয়েকবার “ইয়েস আন্না, কাম টু লোকেশন”, “ইয়া, লোকেশন, লোকেশন”, “ড্রপ তিরুভন্ম্যুর” বলে ড্রাইভারের সাথে কথা চালালো। ফোন রেখে তারপর অগ্নির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার ক্যাব আসছে। আপ্নিও কি আর এম জেডেই?” অগ্নি উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। টেন্থ ফ্লোর। আপনি তো বোধহয় সেভেন্থ, না?” রুমুন এইবারে কট্মট করে চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে কপট রাগতস্বরে বলল, “আপনি শুধু ইভসড্রপই করেননি, আবার এরকম্ভাবে স্টকও করেছেন দেখছি। যাই হোক। ওই আমার ক্যাব এলো। আজ আসি?”

৭।

(ফাস্ট ফরওয়ার্ড। দু’সপ্তাহ। ইতিমধ্যে বার দশেক একসাথে দুজনের অফিস ক্যাফেটেরিয়াতে লাঞ্চ সারা হয়েছে। তার মধ্যে তিনবার সত্যিই কোইন্সিডেন্স। আর বাকিগুলো রীতিমতো প্রি-প্ল্যান্ড। ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিক্যুএস্ট পাঠানো ও তারপর বন্ধুত্ব গ্রহণ পর্বও মিটে গিয়েছে। ক্রমে ওয়াটসঅ্যাপের নম্বরও দেওয়া নেওয়া হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সেই প্রথমদিনের পর থেকে আর ওদের কখনো একই শেয়ার ক্যাব মেলেনি।)

আজ চেন্নাইয়ের আকাশ মেঘলা। সারাদিনে কয়েক পশলা বৃষ্টিও হয়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়া শনশন করে বইছে। অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে অগ্নি আর রুমুন। পাশাপাশি। অগ্নির পরনে নীল শার্ট, সাদা ট্রাউজার। রুমুন কমলা কুর্তি, গোলাপি লেগিংস। দুজনের হাতেই মোবাইল। শেয়ার ক্যাবের অ্যাপ খোলা। এমন সময় হঠাৎ বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হলো। রুমুন ঝটপট পিঠের ব্যাগ থেকে ওর লাল ছাতাটা বের করলো। অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখলো, কোন হেলদোল নেই। বুঝলো ছাতা নেই সাথে। রুমুন আস্তে আস্তে ওর পাশে ঘেঁষে দাঁড়ালো। অগ্নি ওর থেকে অনেকটাই লম্বা। কষ্ট করে ছাতাটা উঁচু করে ধরলো যাতে দুজনেরই মাথা বাঁচে। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাই কোইন্সিডেন্স তো সেদিএন্র পর থেকে আর আমরা একই শেয়ার ক্যাবে ম্যাচড হলাম না। আজ কি মামলা নিজদের হাতে নিয়ে একটা মাইক্রো বুক করা যায়? ড্রপ লোকেশন কী দেবো বলো।” মুচকি হেসে অগ্নি বলে, “খুব অসুবিধে না হলে বিচ দেবে? এমন সুন্দর ওয়েদারে একটু সমুদ্রের হাওয়া খাওয়া যায় তো? অবশ্যই তোমার আপত্তি না থাকলে।”

রুমুন খানিক ভেবে বলে, “না। আপত্তি নেই। কাল শনিবার। সকাল সকাল ওঠার তাড়াও নেই। বেশ। চলো তাহলে। তবে ডিনারটা কোথাও বাইরেই করব কিন্তু।”

“অ্যাজ ইউ উইশ।” অগ্নি উত্তর দেয়। ছাতাটাকে অগ্নির হাতে ধরিয়ে রুমুন বলে, “আচ্ছা মানুষ তুমি। দেখছ এই এত উঁচুতে ছাতাটা ধরতে আমার অসুবিধে হচ্ছে, কোন হেলদোল নেই। ধরো এটা। আমি ক্যাব বুক করি।”

ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশের চায়ের দোকানের রেডিওতে ভেসে উঠলো বম্বে সিনেমার বিখ্যাত “তু হি রে” গানের তামিল ভারসান। আহা, কী সমাপতন। কে বলে জীবনটা সিনেমা না?

তুয়ার হিজিবিজি ১৬

অনুষ্ঠানের দিন সকাল সকাল যদিও দুদিন আগের বৃষ্টির ফলে নাক সুড়সুড় আর গলা ব্যথা করছিল, তবুও স্টেজে উঠে তুয়া খুব ভালো গান গাইলো। এবং স্বপ্নের মতো স্ট্যান্ডিং ওভেশন না পেলেও, শ্রোতারা যে খুবই উপভোগ করেছে ওর গান, তা বলাই বাহুল্য। আজ গান গাইতে গাইতে বারবার তুয়ার চোখ চলে যাচ্ছিল একদম সামনের সারিতে বসা মকবুলের দিকে। গোটা সময়টাই এক জোড়া মুগ্ধ চোখ ওকে যেন আজ ভীষণ রকমের সাহস জুগিয়ে চলছিল প্রতি মুহূর্তে। অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন হলো। তারপর প্রথামতই শুরু হলো ডিজে নাইট। তুয়া আর ওর ব্যাচের বন্ধুরা, বাকি সিনিয়র-জুনিয়ররা সক্কলে ডান্স ফ্লোরে। কিছু কিছু স্যার ও ম্যাডামরা যোগ দিলেন খানিক। মকবুলকেও ডেকে নিলেন হৈমন্তী ম্যাম। মকবুল শুরুতে একটু ইতস্তত করলেও নাচতে শুরু করে যেন অন্য গ্রহের মানুষ। অন্য পারসোন্যালিটি।
তুয়ার ক্লাসের বাকি মেয়েরা তো সুযোগ খুঁজছিলই। এবার যেন মকবুলকে ডান্স ফ্লোরে পেয়ে হাতে চাঁদ এসে গেলো। সবাই একদম ওকে ছেঁকে ধরে নাচতে লাগল। ইলেক্ট্রনিক মিউজিকের মাতাল করা তাল, ছন্দ। মায়াবী আলো। ঝলমল। গ্ল্যামার। তুয়া একটু ইন্ট্রোভারট। তাই অতটা মকবুলের কাছ ঘেঁষছিল না। কিন্তু মকবুল যেন সুযোগ খুঁজে খুঁজে নানান বাহানায় নানান অছিলায় বারবার তুয়ার দিকেই আসছিল নাচের সময়ে। মন্দ যে লাগছিল না তুয়ার, তা ঠিক। কিন্তু একটু আড়ষ্টতা ছিলই। প্রচুর সেলফি উঠলো। বেশিরভাগেই অবশ্য দেখা যাবে, তুয়া আর মকবুল প্রায় পাশাপাশি। মকবুল সকলকে বলল, ওয়াটসআপে সেসব ছবি ওকে পাঠাতে। ফেসবুকেও ট্যাগ করে দিতে। মেয়েদের যেন একদিনে সব স্বপ্ন পূরণ। ফোন নম্বর পেয়ে গেলো। ফেসবুকের বন্ধুত্বও।
তুয়ার বাড়ি ফেরার কারফ্যু থাকে। ও তাই আটটার দিকেই বেরিয়ে পড়ল। ক্লাসমেট সুনন্দ ওর সাথেই বেরোল। একটু এগিয়ে দেবে বলে। সুনন্দ ক্লাসের "বেস্ট ফ্রেন্ড" তুয়ার।
বাড়ি ফিরে তাড়াহুড়ো করে পোশাক পরিবর্তন করে তুয়া ফেসবুক খুলল। নোটিফিকেশন এসছে। মকবুল সিদ্দিকি ওর ফ্রেন্ড রিক্যুএস্ট গ্রাহ্য করেছে। বুকের ভিতরে ঝড় উঠলো তুয়ার। ঠিক যেমন বাইরেও উঠেছে।

Saturday, June 22, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ১৫

তুয়া বসে আছে ব্যাক স্টেজে। সদ্য গান শেষ হয়েছে ওর। আশা ভোঁসলের জনপ্রিয় কয়েকটা গান। উপস্থিত দর্শক একেবারে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিয়েছে। এতটাই ভালো অনুষ্ঠান হয়েছে। বোতল থেকে জল নিয়ে একটু খেলো। এখন নাচ চলছে। এরপর একটা নাটক। নাটকে দু তিন লাইন গান গাইতে হবে ব্যাকগ্রাউন্ডে। তারপর ছুটি। মনোযোগ দিয়ে তুয়া নাচ দেখছে স্টেজে। এই একটা জিনিস যা ও ভীষণ উপভোগ করে। নিজে খুব বেশি যে নাচতে পারে, এমন না। তাই হয়তো আরো বেশি শ্রদ্ধা ওর নাচের লোকজনের ওপর। এই আলো, ঝলমল, গ্ল্যামার... এইসব ভাবতে ভাবতে পা ঠুকে ঠুকে তাল দিতে দিতে তুয়া নাচ দেখছে,।এমন সময়ে কাঁধে একটা হাল্কা টোকা অনুভব করলো। চমকে তাকিয়ে দেখল, সাদা চিকন কাজের পাঞ্জাবি আর নীল জিন্স পরিহিত মকবুল সিদ্দিকি।
তুয়া একটু ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। মকবুল ওর কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে বললো, "তোমার গান খুব ভালো হয়েছে। খুবই জমাটি। সবকটা গান আমার পার্সোনাল ফেভারিট। তাই আমি আলাদা করে এলাম তোমায় অভিনন্দন জানাতে। গান ছেড়ো না। খুব ভালো হয়েছে।" তুয়া এই প্রশংসা শুনে "ব্লাশ" করে। সলজ্জ হেসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। খুব নিচু স্বরে বলে "থ্যাংক ইউ।" মকবুল বলে, "একটা কিছু ইনফর্মাল অনুষ্ঠান আয়োজন করো তো তোমরা। আমরা আবার গানবাজনা করবো।" তুয়া মাথা নাড়ে। মকবুল চলে যায়। তুয়া সেই চলে যাওয়া দেখতে থাকে। স্টেজে নাচ পাল্টায়। তুয়ার আর ওদিকে মন নেই। কানে শুধু ভেসে আসে গানের কথা। "ইন আঁখো কি মস্তি মে"।
চোখ বুজে যায় আবেশে।
হঠাৎ গান বদলে যায়। বাজতে থাকে সরোদ। খুব মিষ্টি। ঠিক যেন কোন সুদূর থেকে ভেসে আসছে।
এক লহমায় ঘুম ভাঙে। ও। এলার্ম। চোখ মেলে দেখে ঘড়িতে ছটা তিরিশ।
এতদিনে প্রথম তুয়ার এলার্মের আগে ঘুম ভাঙল না। মেজাজটা বড় ফুরফুরে লাগছে। এমন স্বপ্ন কি সত্যি হবে না?

তুয়ার হিজিবিজি ১৪



আজ লক্ষ্মীদি ছুটি নিয়েছে। অগত্যা নিজের ডিনারের ব্যবস্থা তুয়াকে নিজেকেই করতে হবে। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে তো তুয়া এক্কেবারে ভিজে স্নান হয়ে গেছে। ঝটপট গিজার চালিয়ে গরম জলে স্নান করে শুকনো জামাকাপড় পরে প্রথমেই গরম গরম এক কাপ কফি বানালো নিজের জন্য। আহ। এই এতক্ষণে আরাম। ডিনারে কী বানানো যায়? ফ্রিজ খুলে দেখলো তুয়া, চিকেন আছে। আছে কিছু সবজি। কিছুদিন আগে শপিং মল থেকে থাই কারি মসলা কেনা ছিল। ব্যস। আর তো কোনো কথাই নেই। দৌড়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। সাথে ফোন। গিনীকে আজকে একবার ফোন করতেই হবে। সারাক্ষণ ওর পিছনে লাগে, কাউকে দেখেই মনের ভিতর নাকি তুয়ার আলোড়ন জাগে না। হুহ। আজ বলতে হবে ওকে। তুয়ারও আর পাঁচটা মেয়ের মতোই "মনমে লাড্ডু" ফুটেছে।
ওয়াটসআপে ভিডিও কল চলতে থাকে দুই প্রাণের বন্ধুর। দু'পক্ষই ভারী উত্তেজিত। মকবুল মকবুল মকবুল। কথায় কথায় তুয়া মকবুল এই বলেছে, মকবুল ওই বলেছে। আজ এই রঙের পোশাকে কী অসাধারণ লাগছিলো। কাল তুয়ার কুর্তি আর মকবুলের টিশার্টের রঙ ম্যাচ করে গিয়েছিল।
গ্যাসে থাই কারি ফুটতে থাকে। দারুণ তার গন্ধ। পাশে রাইসকুকারে ভাত হতে থাকে। আর ওদিকে ফোনে ফোনে রান্না হতে থাকে এক মিষ্টি গল্প। গিনি খুব খুশি তুয়ার জন্য। ক্লাস ইলেভেনে পড়াকালীন সন্দীপনের সাথে তুয়ার মাস ছয়েকের সম্পর্কটা ভেঙে গিয়েছিল বিশ্রীভাবে। তারপর অনেকদিন তুয়া সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকতো। আর পাঁচটা ওই বয়সী মেয়ের মতো এইসব বিষয়ে আর কোনো উচ্ছ্বাস নেই। মাথাব্যথা নেই। হেলদোল নেই। কেমন যেন একটা গুটিয়ে রেখেছিল ও নিজেকে। তারপর আবার যে মকবুল নামের এই প্রতিবেশী দেশের যুবক তুয়ার মনে একটা আন্দোলন তুলেছে, এটাই একটা বিরাট 'স্টেপ ফরওয়ার্ড'। আদৌ দুজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হবে কি না আগামীদিনে, হলেও তা কতদিন টিকবে, কী বৃত্তান্ত, কিছুই এখন ঠিক নেই। এমনকি ঠিক হওয়ার মতো পরিস্থিতিও না। সবই এখন খুবই কুড়ির অবস্থায়। ফুল ফুটতে, বসন্ত আসতে, ঢের দেরি। কিন্তু তাও, বন্ধুর এই আনন্দে, সুদূর অস্ট্রেলিয়াতে বসে গিনি আজ খুব খুশি। অনেকদিন পর।

Thursday, June 20, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ১৩

তুয়া আর ওর সহপাঠিনীদের মনে মনে যতই বসন্ত আসুক না কেন, কলকাতা শহরে এখন ভরা বর্ষা। আষাঢ়স্য প্রথম দিবস কিছুদিন আগেই পার হয়ে গিয়েছে। গত দুদিন কলেজ থেকে ফিরতে গিয়ে বেশ ভালো মতোই বৃষ্টি পেয়েছে তুয়া। অটোর স্ট্যান্ডে লম্বা লাইন। এদিকে অটোর দেখা নেই। অবশ্য এসবে তুয়ার খুব একটা এখন খারাপ টারাপ লাগছে না। ওর তো ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। লাইনে দাঁড়িয়ে বাকিরা যখন দুর্ছাই করে যাচ্ছে, তুয়া বেশ ইয়ারফোনে সাত সুরের ছন্দ জগতে মাতোয়ারা। এফ এম স্টেশনগুলো বেশ ভালো। কী সুন্দর বৃষ্টি পড়লেই পরপর সুরেলা বৃষ্টির গান চালায়। সেগুলির আবার বেশিরভাগই রোম্যান্টিকও। তুয়া গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। "সাওয়ান বরসে তরসে দিল..."। কল্পনায় নিজেকে সোনালী বেন্দ্রে আর অক্ষয় খান্নার জায়গায় বারবার সেই মকবুলের মুখ ভেসে আসছিল।
আজ আবার ব্যাপারটা খানিক আলাদা। ভুল করে ছাতা নিয়ে বেরোয়নি তুয়া। আর ব্যস। ভিজছে। যদিও এই ফুরফুরে মনে আজ ভিজতে মন্দ লাগছে না ওর, তবে তুয়ার খানিক এলার্জি আছেই। তাই মনের এক দূর কোণে হাঁচি কাশির হাল্কা ভয় আছেই। সে না ভিলেন হয়ে আসে জীবনে। ও, বলতে ভুলে গেছি। আগামী শনিবার, ওদের ব্যাচের পক্ষ থেকে ফার্স্ট ইয়ারকে ফ্রেশার্স ওয়েলকাম দেওয়া হবে। তুয়া সেখানে গান গাইছে। সেই অনুষ্ঠানে সাধারণত সমস্ত ফ্যাকাল্টিরাও থাকেন। মকবুলের উপস্থিতিও তাই আশা করাই যায়। এই জন্যই তুয়া যেন বাড়তি এক্সাইটেড।

তুয়ার হিজিবিজি ১২

নতুন সেশনে কলেজ খুলে গেছে তা প্রায় দিন দশেক হয়ে গেল। মাও সপ্তাহখানেক তুয়ার সাথে কাটিয়ে আবার আসানসোল ফিরে গেছে। আসলে মা না থাকলে তুয়ার বাবার খুবই অসুবিধে হয়। সেই ভোর ভোর অফিস বেরোতে হয়। তখন হাতের কাছে জিনিসপত্র ঠিকঠাক না পেলে ভারী মুশকিল। নতুন ক্লাস। পুরোনো বন্ধু। নতুন সিলেবাস। নতুন সাবজেক্ট। পুরোনো নতুন মিলিয়ে স্যার ম্যামেরা। আর পুরোনো ক্লাসরুম। দিব্যি চলছে। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা তুয়ার বরাবরই ভালো লাগে। আর এখানে দেশী বিদেশী নানান ভাষার সাহিত্যের চর্চা, একটা ক্লাসও তুয়া মিস করতে চায় না। তবে এইবারে অবশ্য এই ক্লাস ভালো লাগার বাড়তি কারণ হয়েছে। হ্যাঁ, বিশেষ কারণ। এবং কারণ নিতান্তই সাধারণ ও চিরাচরিত। হৃদয়ঘটিত।
মকবুল সিদ্দিকি নামের এক ভদ্রলোক। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি করছেন রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলায় লোকসঙ্গীতের প্রভাব বিষয়ে। ছমাসের ফেলোশিপ নিয়ে এই সেমিস্টারটা ওদের হৈমন্তী ম্যাডামের কাছে থেকে গবেষণা করবেন। হৈমন্তী ম্যামও এমন স্কলারকে পেয়ে দু চারটে বিষয় দিয়ে দিয়েছেন মকবুলকে। ছ ফুট লম্বা,ফর্সা, গালে হাল্কা সব্জেটে দাড়ি, চোখে রিমলেস চশমা। পরনে ব্লু জিন্স আর সাদা পোলো নেক টিশার্ট। যেন সিনেমার পর্দা থেকে নেমে আসা কোনো হিরো। মকবুলের চেহারা যেমন সুন্দর, ঠিক ততটাই দুর্দান্ত ওর বাচনভঙ্গি। গলার স্বর? যেন প্রফেশনাল আরজে। মিশুকে। হাসিখুশি। দুটো ক্লাসেই তুয়াসহ গোটা ব্যাচের মেয়েরা কুপোকাত। ক্লাসের শুরুতে আগেভাগে মেয়েরা পৌঁছে যায়, ফ্রান্ট বেঞ্চে বসবে বলে। পিরিয়ড শেষের বেল বাজলেও মনগড়া সমস্ত ডাউট নিয়ে ঘিরে ধরে ওকে সব্বাই। পরের ক্লাস নিতে এসে শরদিন্দু বাবু খানিক দাঁড়িয়ে থাকেন। উনিও রসিক মানুষ। মুখ টিপে হাসেন। মিনিট সাত দশের ছাড় দেওয়ার পর গলা খাকরি দিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে মকবুলকে মুক্তি দেন। মেয়ের দল হতাশ হয়ে আবার যে যার জায়গায় ফেরে।
তুয়া নিজে লোকসংগীত নিয়ে অল্প বিস্তর চর্চা করে। আর তাই ক্লাসের পড়া বুঝতে সহজ হয়। মকবুলের টুকটাক প্রশ্নের উত্তরও ঝটপট দিয়ে দেয়। মকবুল এই কদিনেই সেটা বেশ লক্ষ্য করেছে। ক্লাসে পড়াতে পড়াতে তাই বারবার যেন চোখ পড়ে যায় তুয়ার দিকেই। তুয়া খানিক অপ্রস্তুত হয়ে সলজ্জ হাসি হেসে মাথা নামিয়ে নেয় নোটসের খাতায়। মকবুল খানিক কি মর্মাহত হয়? কে জানে? তবে হ্যাঁ, অবশ্যই অপেক্ষা করতে থাকে আবার পরের ক্লাসের জন্য। যদি আবার সেই সাদা কুর্তি আর হলুদ সালোয়ার পরে আসে মেয়েটি। নোটস লিখতে লিখতে আনমনা হয়ে যখন বাঁ হাত দিয়ে কপালের ওপর এসে পড়া অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে, মকবুলের মনে হয় যেন অনন্তকাল ধরে ও তাকিয়ে থাকতে পারে ওই এক জোড়া গভীর চোখের পানে। এক্কেবারে রূপকথার গল্পের মতো।

Tuesday, June 18, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ১১

ইন্টার্নশিপ শেষ করে তুয়া এক সপ্তাহ আসানসোলে নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে এলো। অনেকদিন পর আত্মীয়স্বজন, স্কুলের বন্ধুবান্ধব মিলে দেখা সাক্ষাৎ, গল্প, আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা, থিয়েটার দেখা। সব মিলিয়ে বেশ জমজমাট ব্যাপার। কিন্তু ওই যে, সব ভালোর মেয়াদ বড্ড সীমিত। দেখতে দেখতে ছুটি শেষ। এবার আবার কলকাতা ফেরার পালা। কলেজ শুরু হয়ে যাবে। আবার রোজের একঘেয়েমি।
তবে এবারে একটা ভালো ব্যাপার আছে। মা আসছে ওর সাথে। দিন দশেক ওর কাছে থেকে যাবে। দশটা বাড়তি দিন মায়ের আদর যত্ন পাবে। এই ভেবেই এবারে যেন কলকাতাগামী বাসে চাপতে একটুও মন খারাপ করেনি তুয়ার। তবে হ্যাঁ, কলকাতা শহরের প্রতি আলাদা একটা ভালোবাসাও দিব্যি কাজ করে। এই শহরই ওকে দিয়েছে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ। প্রথম উপার্জন। ও, ইন্টার্নশিপ করে তুয়া খানিকটা টাকা রোজগার করেছে বটে। এবং সেই টাকা সোজা গিয়ে জমা হয়েছে ওর অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ ফান্ডে। কলকাতায় পড়াশোনা আর থাকার খরচ বাবদ বাবার থেকে মাস গেলে টাকা পায়। সেখান থেকে অল্প স্বল্প জমানোর চেষ্টা করলেও, খুব একটা পরিমাণ হয়না। ভ্রমণ ফান্ড বাড়ানোর জন্য তাই ইন্টার্নশিপ, জন্মদিন পুজোর টাকা, এগুলোই ভরসা।
কলেজের বন্ধুদের ওয়াটসআপ গ্রুপে চলছে জল্পনা কল্পনা। নতুন সেশন। কেমন হবে কোর্স। জুনিয়ররা কেমন আসবে। হেঁহে, ভাবতেও অবাক লাগে। এই তো সবে যেন এইচ এস পাস করে একদিন অনলাইনে ফর্ম ভরলো। তারপর এক রোববার বাবার হাত ধরে কলকাতা এলো। এডমিশন টেস্ট দিলো। ভালোভাবে উৎরেও গেল। তারপর ভর্তি। কলেজের হোস্টেল। সেখানে ব্যবস্থা অপছন্দ। তারপর এই জেঠু জেঠিমার বাড়ি থাকা শুরু। তারপর ক্লাস, ইন্টার্নশিপ। দেখতে দেখতে কেমন দিন কেটে যায়, না? একটা বছর ভালোমন্দ মিশিয়ে তো বেশ কেটে গেল। রেজাল্টও ভালো হয়েছে। বন্ধুবান্ধব হয়েছে। কাজের অগ্রগতিও। টাচ উড, মন্দ চলছে না তুয়ার এই নতুন শহরে একলাযাপন। অবশ্য কলকাতা আর যাই হোক, 'নতুন' নেই ওর কাছে। অলিতে গলিতে অবাধ বিচরণ পুরোপুরি না হলেও, বন্ধুদের কল্যাণে মন্দ হয়নি। তাও, এখনো অনেকটা বাকি। সামনে অনেকটা লম্বা পথ বাকি। তুয়ার পূর্ণ আস্থা আছে নিজের ওপর। এই আগামীও খুবই আপন হবে ওর।
কাঁহাতক আর ওই মন খারাপ, মন ভালো নেই, কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা এইসব করা যায়? এই করতে করতে হঠাৎই একদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হয়, নাহ। আজ তো বেশ ফুরফুরে লাগছে। চড়া রোদ বাইরে, তবুও তারই মধ্যে একটু সেজেগুজে দু তিন স্টেপ নেচে নিতে ইচ্ছে করে। বা হয়তো কোন ইম্পরট্যান্ট মিটে যাওয়ার কথা, জোরে বৃষ্টি এসে সব ভণ্ডুল করে দিলো। তাতে কী? ঘরের ভিতর গল্পের বই হাতে, জানলার ধারে বসে রেনি ডে পালন তো করাই যায়? অঙ্কটা মিলছেনা সেই কখন থেকে। ধুর ছাই করে একদিনের জন্য কিন্তু ছুটি নিয়েই নেওয়া যায়। না? অমুকে কথা বলেনি? তাতে কী? কথা বলার লোকের অভাব নাকি? কবে থেকে ঠাকুমাকে ফোন করবো করবো করেও তো হচ্ছিল না করা, নানান ব্যস্ততার অছিলায়। আজকে একবার ফোনটা তুলে নম্বর ডায়াল করলেই হলো। বুড়ো মানুষটা যখন প্রিয় নাতি বা নাতনির গলাটা শুনতে পাবে, অপ্রত্যাশিতভাবে, কী আনন্দই না পাবে?

আসলে ভালো থাকাটা, ভালোলাগাটা পুরোটাই খুব আপেক্ষিক। খারাপ লাগতে লাগতে, কষ্ট পেতে পেতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন হঠাৎ করেই একদিন বুমেরাংএর মতোই ছিটকে আসি। তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসের মধ্যেই খুঁজে নিই ভালো থাকার রসদ।

কারণ, আমরা ভালো থাকতে ভালোবাসি। ভালোবাসি ভালো রাখতে।  
মন খারাপ একটা বিরাট ম্যাগনেট। কাজ নেই, কম্ম নেই, হঠাৎ করে যেখানে যত ডিপ্রেশন থাক, এক লহমায় সব আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বৃষ্টিময় করে দেবে।
মন খারাপ "স্পটিফাই"এর চেয়েও বেশি এফিশিয়েন্ট। হাজার মাইল দূরে কে কোথায় অরিজিৎ সিং শুনছে। এ ঠিক টের পেয়ে যায়।
মন খারাপ হলো সেই ডেটল লিক্যুইড বা ডোমেক্স ফ্লোর ওয়াশ। যতই ধুয়ে মুছে রাখো, সেই ০.০১% দুঃখ জীবাণুগুলো থেকেই যাবে।
মন খারাপ সেই সুইস ব্যাংকের একাউন্ট। সমস্ত সুখ আহ্লাদ জমা করে নেয়। ফিরিয়ে আর দেয় না কক্ষনো।
মন খারাপ একদম সাধারণ জ্বরের মতো। ছাপোষা। যখন তখন আসে। স্নেহের জলপট্টি পড়লেই নিরাময়। খানিকটা সংক্রামকও বটে।
মন খারাপ আসলে বড্ড ঘরোয়া।

Sunday, June 16, 2019

মন খারাপ ভারী অভদ্র। হুটহাট যখন তখন এসে হামলে পড়ে।  এক্কেবারে যেন ওই "বিন বুলায়ে মেহমান।" বেশ তো একটা সুন্দর উইকেন্ড চলছিল। ছিল পর্যাপ্ত প্ল্যানস, এদিকে দেখো। কেমন বেহায়া নির্লজ্জর মতো এসে সব ভেস্তে দিয়ে যাবে।

মন খারাপ ভারী অসভ্য। এই এত্ত ডেডলাইনস। এত এত কাজ। এদিকে দেখো, ঠিক এসে সমস্ত বিবেক বিবেচনা বুদ্ধি সব হাইজ্যাক করে নেবে। একটা পারমিশন পর্যন্ত নেবে না?

মন খারাপ ভারী খামখেয়ালি। কারণে অকারণে সেই কোন প্রি হিস্টোরিক যুগের কোন এক ফালি "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত"র জেরে মস্তিষ্কের যে মালিকানা নিয়ে বসে আছে, ব্যাটা হৃৎপিন্ডটাকে হৃদয় না করে ছাড়বেই না।

মন খারাপ ভারী নাছোড়বান্দা। ওরে, বাঁ দিকের ওই চিনচিনটা নিয়ে মন তো সেই কবে থেকে কন্ডিশন্ড হয়ে আছে। তবুও, মাঝে মধ্যেই এসে নিজের উপস্থিতিটা জানিয়ে দিয়ে যাবেই যাবে।

মন খারাপ বড্ড অভিমানী। সে আসবে। তাকে আপ্যায়ন করতে হবে। নইলে... নইলে তাকে (দুঃখ)বিলাসের দিনে হাজার ডাকলেও, ফিরেও তাকাবে না।

মন খারাপ চিরকালীন। শাশ্বত।

Friday, June 14, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ১০

আজ তুয়ার এই অফিসে ইন্টার্নশিপের শেষ দিন। তবে কাজের ছুটি কিন্তু না। আজও শ্রীময়ী ওকে ভালো মতোই এসাইনমেন্ট দিয়েছেন। এই মাসের ম্যাগাজিনের ফাইনাল লে আউট আর প্রুফ দেখার। শ্রীময়ী খুব খুঁতখুঁতে এইসব বিষয়ে। আর এ যাবৎ মোটামুটি ভালো ট্র্যাক রেকর্ড বজায় রেখে এসেছে। তাই জন্যই তো এই শেষবেলায় এসেও এমন গুরুগম্ভীর দায়িত্ব ওর ঘাড়ে পড়েছে। আজকেও কাজটা সুষ্ঠুভাবেই মেটাতে চায় তুয়া। তাই মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসে আছে। সাড়ে দশটার দিকে মনিরুলদা এসে রোজের মতোই কফির কাপ ধরিয়ে দিয়ে গেল ওকে। তুয়া কৃতজ্ঞ হাসি হাসলো। মনিদা এত ভালো কফি বানান, এটাও খুব মিস করবে তুয়া। সাড়ে বারোটার দিকে এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা মেসেজ পেলো ও। বিকেল পাঁচটায় ওর জন্য একটা ছোট ফেয়ারওয়েলের ব্যবস্থা হয়েছে। ও যেন অবশ্যই আসে। মুহূর্তে তুয়ার মনটা অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতিতে ভরে গেল। বিদায়ের কষ্ট। এদিকে এতটা ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দ।
সময়মতো দীপান্বিতা ওকে নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া এলো। দীপুর অবশ্য ছ'মাসের ইন্টার্নশিপ। ও এক্ষুণি যাচ্ছেনা। তাই জুনিয়রমোস্ট হিসেবে ওর আজ অনেক দায়িত্ব। গোটা ফেয়ারওয়েলটা ও আর এইচ আরের কিছু ইন্টার্নরা মিলে আয়োজন করেছে। গোটা ক্যাফেটেরিয়া বেলুন দিয়ে সাজানো। ওর পছন্দের নীল আর লাল কম্বিনেশনে। স্পিকারে গান চলছে। পার্টি মিউজিক। যথাসময়ে সব লোকজনও এসে উপস্থিত। শোভন স্যার ফ্রিজ থেকে একটা ইয়া বড় কেক বের করে আনলেন। দীপুকে ডেকে বললেন, "নে। আমার কাজ করে দিয়েছি। এবার ঝটপট শুরু কর।" যেন এই সিগ্নালেরই অপেক্ষায় ছিল ওরা। এইচ আরের ইন্টার্ন দেবাদিত্য হাত ধরে তুয়াকে কেকের সামনে নিয়ে এলো। জুনিয়ররা মিলে হইহই করতে করতে কেক কাটালো তুয়াকে দিয়ে। প্রথম পিসটা তুয়া ওর প্রিয় শ্রীময়ী ম্যামকেই খাওয়ালো। ম্যাম অল্প একটু কামড় দিয়ে বাকিটা ওর মুখের পুরে দিলেন। এরপর একে একে তুয়া বাকি ইন্টার্ন ও অন্যান্য স্টাফদের কেক কেটে দিলো। দীপু এই ব্যাপারে সাহায্য করলো খুব। গান বাজনার ভলিউম বেড়ে গিয়েছে। হালকা নাচ শুরু হয়েছে একদিকে। তুয়া লাজুক। ও চুপ করে বসে আছে একটা কোণায়। ওর জন্যই এই পার্টি, এদিকে ও আড়ালে। মনিরুলদা ট্রে হাতে সবার জন্য একে একে কোল্ড ড্রিংক আর স্ন্যাকস নিয়ে এলো। তুয়া চুপচাপ বসে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ এসে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে যাচ্ছে।
আটটার দিকে পার্টি ভাঙল। এবার সবার ফেরার পালা। তুয়া অনেক উপহার পেয়েছে। অফিস থেকে ওকে বেশ কতগুলো বই, একটা পেনড্রাইভ, একটা ব্লু টুথ হেডফোন তো দিয়েইছে, এ ছাড়া বন্ধুরা, মানে ব্যাচের অন্যান্য ইন্টার্নরা মিলে ফুলের তোড়া আর হ্যান্ডব্যাগ দিয়েছে। এত কিছু নিয়ে বাড়ি ফিরবে কী করে, ভাবছে। এমন সময় শ্রীময়ী ম্যাম ওর কাছে এসে বললেন, "দীপান্বিতা বা কেউ কি তোমায় পৌঁছে দেবে?" তুয়া না তে মাথা নাড়লো। শ্রীময়ী তখন বললেন, "ঠিক আছে। আমি তোমায় আজ ড্রপ করে দেবো। বাড়ি পৌঁছনোর তাড়া আছে?" তুয়া ওর দশটার কারফিউয়ের কথা বলতে ম্যাম বললেন, "ও ঠিক আছে। ম্যানেজেবল। চলো আমরা আজ একসাথে ডিনার করি। তুমি ইন্টার্নশিপে খুব ভালো কাজ করেছো। ইউ ডিজার্ভ আ ট্রিট। বলো কী খাবে, চাইনিজ না থাই নাকি মোগলাই?" তুয়া একটু কিন্তু কিন্তু করছে দেখে শ্রীময়ী ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন, "শোনো, ডোন্ট হেজিটেট। এখন কিন্তু আমি আর তোমার বস নই। আমায় দিদির মতোই ভাবতে পারো।"
সেদিন ওরা একটা থাই রেস্টুরেন্টে ডিনার সারলো। তুয়ার বাড়ির কাছেই। খেতে খেতে অনেক গল্প হলো। ডিনার শেষে তুয়া যেন অনেকটাই সহজ। যেন শ্রীময়ীকে এক নতুন রূপে পেলো। একজন প্রিয় সিনিয়র, একজন মেন্টর। ঠিক বাড়ির সামনে ওকে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। তুয়া ফিরে শ্রীময়ীকে গুডনাইট জানাতে গেলে, শ্রীময়ী বললেন, "স্টে ইন টাচ। আমি যেখানেই জয়েন করি না কেন, তোমার জন্য ইন্টার্নশিপের দরজা সবসময় খোলা। আর কখনো কোনো প্রয়োজন হলে, নির্দ্বিধায় আমায় ফোন করবে। ঠিক আছে?"
এই আশ্বাসটুকুই অনেকটা। তুয়া মনে মনে ভাবে, আড়াই মাস বাড়ি না যাওয়ায় অনেক কিছু মিস হলেও, এগুলোই তো ওর প্রাপ্তি, থেকে যাবে সর্বক্ষণ।

Thursday, June 13, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ৯

এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে শ্রীময়ী ম্যাম আর সৌরভদার মধ্যে সেই ফাটাফাটি ঝগড়াটার। সেদিনের পর থেকেই কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ অফিসে। তুয়ার বেশ অস্বস্তিই হয়। আগে দিব্যি সবাই ওর সাথে কথা বলতো, এর তার খুচরো ফাই ফর্মাস খেটে দিত, হাসি মুখেই। এখন সকলেই কেমন একটা এড়িয়ে এড়িয়ে চলে ওকে। দীপান্বিতার অবশ্য কোনো হেলদোল নেই এই ব্যাপারে। ওর সাথে সবাই আগের মতোই আছে। তুয়া মনমরা হয়েই থাকে সারাক্ষণ। ভাবে, সবাই বুঝি আড়ালে ওকেই দোষ দিয়েছে ঝগড়াটা নিয়ে। কানাঘুষো যা শুনেছে, এমনটাই তো মনে হয়েছে ওর। অথচ কী অদ্ভুত দেখো, ও কিছুই করলো না। সৌরভদা, শ্রীময়ী ম্যাম সবার কথামতো কাজ ঠিক করে দিলো, এদিকে কেমন একটা মার্কামারা হয়ে আছে।
ইন্টার্নশিপের আর এক সপ্তাহ মতো বাকি। তুয়া জানে, এই এক সপ্তাহ ওর দিব্যি কেটে যাবে। টুকটাক যা কাজ রয়েছে, পেন্ডিং, তাও মিটিয়ে ফেলবে। শ্রীময়ীর কড়া স্বভাবের জন্য আজ অবধি কোনো কাজই ফেলে রাখার জো পায়নি তুয়া। একদিকে ভালো। আর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশিই কাজ ও করেছে এই দুই মাসে। শিখেছে অনেকটাই। শ্রী ম্যামের বকুনি ও শাসনের মধ্যেও কেমন একটা প্রচ্ছন্ন স্নেহ অনুভব করতো তুয়া। ঠিক হাই স্কুলের বৃন্দাদির মতো। তুয়া বরাবর অঙ্কতে খুব কাঁচা। সিলি মিসটেকের বন্যা বইয়ে দিত। এই বৃন্দদির বকুনি আর চেষ্টার জেরে সেই তুয়াই মাধ্যমিকে অঙ্কে ৮৫ পেয়েছিল। শ্রী ম্যামকে তুয়া ভারী শ্রদ্ধা করে। শুরুর দিকে রাগী এই ম্যামকে আড়ালে হিটলার নাম দিলেও এখন ম্যাম অন্ত প্রাণ না হলেও, ইন্টার্নশিপ শেষ হয়ে গেলে ভালোই মিস করবে। তুয়ার এই অফিসটা এমনিতে বেশ ভালোই লেগেছে। মোটামুটি এই শেষের কটাদিন বাদ দিলে, আনন্দেই কেটেছে। আর তাই ও ঠিক করেই রেখেছিল। সেকেন্ড ইয়ারেও এখানেই ইন্টার্নশিপ করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কথাটা কারুর কাছে বলতে পারেনি ও। আজ ভেবেছে একবার ম্যামকেই বলে রাখবে। আজ অন্তত সারাদিনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। তুয়ার কাজের প্রেশার কমের দিকেই ছিল। দুটো ইন্টারভিউ রেকর্ডিং শুনে টাইপ করতে হলো। দুজনেই টলিউডের তারকা। একজন আবার ওর প্রিয় অভিনেত্রী। তাই বিশেষ উৎসাহ নিয়েই কাজটা শেষ করেছে তুয়া। ভাবলো ম্যামকে মেল করে দিয়ে একবার দেখা করেই আসবে। বলবে যে কাজটা হয়ে গেছে। আর সেই সময় যদি দেখে ম্যামের মুড ভালো, তাহলে বলবে পরের বছরের কথা।
ম্যামের অফিসে এলো তুয়া। একটু গম্ভীর যেন আজ। কিছু একটা দেখছিলেন কম্পিউটারে। তুয়াকে দেখে বসতে বললেন। "বলো। তোমার মেলটাই দেখছিলাম। ভালোই কাজ শিখেছো এর মধ্যে। গুড। ইউ আর আ প্রমিসিং ইন্টার্ন।" তুয়া তো গদগদ। আড়াই মাসে এই প্রথম এরকম প্রশংসা। মনে মনে এক রাউন্ড নেচে নিলেও বাইরে একটু শান্ত থাকার চেষ্টা করে ও থ্যাংক ইউ জানালো। বলবে কি বলবে না করছে, এমন সময়ে শ্রী বললেন, "আর কিছু বলবে?" ও এবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ফেললো। বললো, "ম্যাম, আমার এখানে এই আড়াই মাস কাজ করে খুব ভালো লেগেছে। অনেকটা শিখেছি। আমি তাই ভাবছিলাম, আগামী বছরও এখানেই আসবো।" শ্রীময়ী মাথা নেড়ে বললেন, "তা ভালো তো। শোভনের সাথে যোগাযোগ রেখো। ওই তো মনে হয় হেড হবে এখানকার।" তুয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন ম্যাম, আপনি?"
শ্রীময়ী নির্বিকার মুখ করে উত্তর দিলো, "ও। তোমায় জানানো হয়নি। আমি ডিজাইন করেছি। আর দুই সপ্তাহ আমার এখানে মেয়াদ। সেদিনের পর থেকে আমার এখানে ঠিক পোষাচ্ছেনা। এই পরিবেশে আমি অন্তত ক্রিয়েটিভ কাজ করতে পারি না। হাওড়া স্টেশনে বসেও আমায় বলো, আমি ফিচার লিখে দেব। বাট নট হিয়ার। দের ইজ নো পিস। আই ক্যানট ওয়ার্ক লাইক দিস।"
তুয়া স্তম্ভিত। এ কী শুনলো? আড়াই মাসের ইন্টার্নশিপে এইটুকু বুঝেছিল যে শ্রীময়ীর অফিস অন্ত প্রাণ। আর এই ম্যাগাজিন হাউজের জন্য শ্রীময়ী কতটা ইম্পরট্যান্ট। এবার তাহলে এই হাউজের কী হবে? আর ম্যাম? তিনিই বা কোথায় যাবেন? তুয়াই বা কী করবে? শ্রীময়ীর কাছে কাজ না করতে পারলে কি ও এতটাই শিখবে? এনজয় করবে? তাহলে কি পরের বছর অন্যত্র কাজ খুঁজবে? খুব মুশকিল। খুব খুব কঠিন প্রশ্ন। মুহূর্তেই তুয়ার হাসি খুশি মনটা ভারী হয়ে যায়। কী বিচিত্র এই জীবন।

Wednesday, June 12, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ৭



ঠিক নিয়মমাফিক দুটো নাগাদ মায়ের ফোন এলো। তুয়া কাজে হাবুডুবু খাচ্ছে। একবার ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেলো। ও রিসিভ করলো না। আর একবার বাজলো। এবারও ধরলো না। পাশ থেকে দীপান্বিতা বললো, "কীরে, ধর? কাকিমা তো?" তুয়া মাথা নাড়লো। "এখন নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। মা খালি খাওয়া নিয়ে বলবে।" দীপু কিছু বললো না। একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিজের ডেস্কে ফিরলো। তুয়া কাজে মন দিলো। মায়ের ফোন আর আসেনি। এটা ওর খুব কমন ব্যাপার। মা পরে বিকেলে আবার ফোন করবে। তখন তুয়া খায়নি শুনে বকুনি দেবে। কিন্তু ওর কিছু করার নেই। শ্রী ম্যাম এত কাজ চাপিয়ে দিয়েছে। সকালে যেই গেল, অমনি ম্যাম এক বান্ডিল ফাইল ওকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, " শোনো, এতে সমস্ত পাঠকদের পাঠানো চিঠি আছে। দেখো এখান থেকে ঝাড়াই বাছাই করে গোটা পনেরো বের করো। বর্তমানের সাথে যা রেলভেন্ট। সেগুলো আগামী সংখ্যায় ছাপা হবে। " তুয়া একটু অবাক। সাধারণত এইসব কাজ শ্রী ম্যাম নিজেই করেন। বলেন, পাঠকের চিঠির কোয়ালিটি নাকি অনেকটাই ম্যাগাজিনের কোয়ালিটির মাপকাঠি। কাজেই ঠিকমতো বেছে চিঠি ছাপা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বহু মান্ডে মিটিংয়ে এই কথা ও শুনেছে। ইন্টার্নশিপের দু মাসের মধ্যেই এমন গুরু দায়িত্ব। খুশি তো হয়েছে। তবে সাথে একটু বুক দুরদুরও করছে। বিকেলের মধ্যে রেডি করে দিতে হবে। ওর বাছা পনেরো থেকে ম্যাম পাঁচে নামাবেন। তুয়াকে rank দিতে হবে চিঠিগুলো। ম্যাম বলেছেন, যদি দুজনের চয়েস মোটামুটি মিলে যায়, তাহলে কফি ট্রিট। যদিও কফি খাওয়ার জন্য তুয়া লালায়িত না, তাও, শ্রীময়ীকে ও খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তাই ম্যামের গুড বুকসে থাকতে সদা ইচ্ছুক।

সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ম্যামকে লিস্ট দিয়ে একটু করিডোরে দাঁড়িয়ে তুয়া মায়ের সাথে কথা বললো। খেয়াল করেনি, পাশ দিয়ে একবার শ্রী ম্যাম গেলেন। কে জানে, ওর কথা শুনলেন কি না। সাতটায় একবার ডাক পড়লো ম্যামের ঘরে। বেশ প্রশংসা করলেন তুয়ার কাজের। আড়াই মাসের ইন্টার্নশিপের পক্ষে খুবই নাকি স্যাটিসফ্যাক্টরী পারফরমেন্স। আর ফাইনাল ভারডিক্ট? ম্যামের পাঁচের সাথে তুয়ার তিনটে মিলে গেছে। তুয়া বেরোতে যাচ্ছে ঘর থেকে, ম্যাম বললেন, " সারাদিন তো কিছুই খাওনি? চলো, ক্যাফেটেরিয়া। কিছু খেয়ে নেবে। আমারও কফি তেষ্টা পাচ্ছে।" তুয়া অবাক হয়ে তাকালো। শ্রী বললেন, "ভাবছো কী করে জানলাম? আরে, তখন ফোনে কথা বলছিলে, শুনেছি। আর শোনো, মায়ের ওপর ওই বকাবকি করো না। মা তো ঠিকই বলেন। কাজ থাকবেই। তা বলে শরীরের যত্ন নেবে না? উঁহু। কর্পোরেট লাইফে টিকতে গেলে মন ও শরীর দুইই শক্ত পোক্ত করতে হবে তো। ব্যালেন্স রেখে চলবে। অলওয়েজ। বুঝেছো?"
তুয়া একটু হেসে মাথা নাড়ে। শ্রী ম্যামের থেকে ও আজ পেলো একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ লাইফ লেসন। ওকে সব সময় মেনে চলতেই হবে। এই রেসে সারভাইভ করতে হবে তো!

তুয়ার হিজিবিজি ৮

দিনটা মোটেই ভালো যাচ্ছেনা তুয়ার। অফিসে আসা ইস্তক ঝুট ঝামেলা। বম্বের কোন ক্লায়েন্ট অফিস থেকে বুঝি কেউ আসছেন মিটিংয়ে। তিনি বেশ হোমরা চোমরা কেউকেটা বোধহয়। ব্যস। সুকুমার স্যার সকাল থেকে হন্তদন্ত হয়ে এদিক সেদিক করে বেড়াচ্ছেন। এর ডেস্ক নোংরা, ওর ডেস্কে পাইল্ড আপ ওয়ার্ক, তমুকের ফাইল ক্যাবিনেট ধুলো এসব চলছিলোই। হাউজকিপিংকে ডেকে সমস্ত পরিষ্কার করানো হচ্ছে। সবের দায়িত্ব পড়েছে সৌরভদার ওপর। সৌরভদা আবার বিশ্ব কুঁড়ে। এবং বীভৎস রকমের শেয়ানা পাব্লিক। ঠিক নিজের কাজ এবং ভুল ত্রুটি অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ওস্তাদ। কী কুক্ষণে যে তুয়া তখন ওখানে ছিল। অমনি নজরে পড়েছে সৌরভদার। আর কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। তিনি নিজে দিব্যি ক্যাফেটেরিয়ার কফির পর কফি শেষ করে যাচ্ছেন। আর এদিকে ওর আর দীপান্বিতার ওপর চলছে এই জুলুম। মাঝে মাঝে এসে আবার দেখে যাচ্ছে, ঠিকঠাক চলছে তো সব? সবে সবদিক সামলে ওরা একটু নিজেদের "সীটে" এসে বসেছে, অমনি পিওন লক্ষ্মণদা এসে বলে গেল, "দিদিমণিরা, শ্রীময়ী ম্যাডাম ডাকছেন তোমাদের। যাও দেখো আবার কী হলো। বেশ রেগে আছে কিন্তু। সাবধানে যেও। এই এতক্ষণ মনোজদা খুব বকা খাচ্ছিল।" তুয়া ভীতু বরাবরের। এইটুকু শুনেই নার্ভাস। দীপান্বিতা বরং অনেক মাথা ঠাণ্ডা। অ ওকে "কুল" থাকতে উপদেশ দিলো। দুজনে ছুটলো শ্রীময়ীর ঘরে।

ঢুকতেই বকার বন্যা শুরু। ব্যাপারটা কিছুই না। শ্রীময়ী ওদের দুজনকে সকাল এগারোটায় একটা কাজ দিয়ে মেইল করেছেন। সেটার ওইর প্রগ্রেস রিপোর্ট দেওয়ার কথা ছিল একটায়। এখন একটা পনেরো। কেন ওরা কাজ সম্পর্কে জানায়নি। তুয়া একটু আমতা আমতা করে বলল সৌরভদার নির্দেশে ওরা কাজ করছিল। ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে শ্রীময়ী ম্যাম রেগে লাল। সৌরভদাকে নিজের কেবিনে ডেকে এক প্রস্থ চিৎকার চেঁচামিচি। কেন শ্রীময়ী আর শোভনের ইন্টার্নদের দিয়ে কাজ করাবে। সৌরভদাও অনড়। ডিপার্টমেন্টের ইন্টার্ন। যে কেউ কাজ দিতে পারে। এই নিয়ে শেষ মেশ এমন ফাটাফাটি চিৎকার হচ্ছিল, শোভন স্যার এসে তখন মধ্যস্থতা না করলে যে কী হত, তুয়া ভাবতে পারেনা। ঘন্টাখানেকের এই ঝগড়াঝাঁটির পর যা ঠিক হল, যেহেতু তুয়া শ্রীময়ীর কাছে রিপোর্ট করে, সেহেতু ওকে দিয়ে কোন কাজ করাতে গেলে আগে শ্রীর অনুমতি নিতে হবে। শোভনের এমন কোন দাবী নেই। তাই দীপান্বিতাকে যে কেউ কাজ দিতে পারবে। দীপান্বিতা একটু কাঁচুমাচু মুখ করে এবড়োতে যাচ্ছিলো, শ্রী ওকেও তুয়ার সাথে থেকে যেতে বললেন। "শোনো, কাজটা যেটা দেওয়া আছে, সেটা করে আমায় সাড়ে তিনটের মধ্যে পাঠাও। অনেক টাইম ওয়েস্ট হয়েছে। আর পারা যাচ্ছে না। নাউ গো, গেট গোয়িং।" ঘড়ি দেখল তুয়া। সয়া দুটো বেজে গেছে। মানে আজও লাঞ্চ গেলো। শুকনো মুখে একবার শ্রীময়ীর দিকে তাকিয়ে বললও, "ঠিক আছে ম্যাম। ঝটপট লাঞ্চ করে আমরা করে দিচ্ছি কাজটা।" শ্রীময়ী একবার তাকালেন ওদের দিকে। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বললেন, "এটা অফিস। এখানে ইন্টার্নশিপ করতে এসেছও। পিকনিক নয়। যে কাজটা দেওয়া রয়েছে, ফিনিশ ইট ফার্স্ট অ্যান্ড দেন ডু ওয়াটেভার ইয়ু ওয়ান্ট। বি প্রফেশনাল।"
তুয়া স্তম্ভিত। এই শ্রীময়ী ম্যামই দুদিন আগে ওকে ক্যাফেটেরিয়াতে নিয়ে গিয়ে ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স নিয়ে কত কথা বললেন। সময়মতো খাওয়াদাওয়া নিয়ে বললেন। আর আজই এই উল্টো বচন? মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো ও। পাশে দীপান্বিতা। ডেস্কে ফিরে দীপু ওকে বললও, "চল ক্যাফেটেরিয়া। খেয়ে আসি। তারপর কাজটা নিয়ে বসবো।" তুয়া অবাক হয়ে বলল," শুনলই না ম্যামের কথা? এরপর ক্যাফেটেরিয়াতে দেখলে সর্বনাশ।" দীপু অভয় দিয়ে বলল, "ল্যাপটপ আর রাইটিং প্যাড নিয়ে চল। স্যান্ডুইচ খেতে খেতে কাজ করব। ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স। বুঝলি? সব সময় অত লিটারালি সব কথা নিতে হয় না। আর হ্যাঁ, বসকে সব কথা বলবি না। বিশেষ করে উইকনেসগুলো নিজের। বস ইস ইয়োর বস, নট অ্যা ফ্রেন্ড। মাথায় রাখবি।
সত্যিই, এই কর্পোরেট জীবন যে কতই বিচিত্র, তুয়া অবাক হয়ে ভাবে। সব কথা ফেস ভ্যালুতে নেওয়াও মুশকিল।  

Monday, June 10, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ৬

আজ তুয়ার অফিস ঢুকতে একটু দেরিই হয়েছে রোজের তুলনায়। সোমবারের সকাল তো, রাস্তাঘাটে বাড়তি যানজট ছিল। অন্যান্য দিন সোয়া নটার মধ্যে ঢুকে গেলেও আজ পৌনে দশটা বেজেছে। এবং কপাল খারাপ হলে যা হয়, পড়বি তো পড়, লিফ্টে মুখোমুখি শ্রীময়ী ম্যামের। ম্যাম আজকে অন্যান্যদিনের তুলনায় আগেই এসেছেন। তুয়াকে দেখে এক রাশ বিরোক্তিসহ বললেন, "এত লেট?" তুয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, উনি হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "মিট মি ইন মাই অফিস ইন টেন মিনিটস।" আর ঠিক তখনই লিফ্ট ওদের বারোতলায় এসে থামল। তুয়ার হ্যাঁ না শোনার আগেই শ্রীময়ী গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। তুয়া দু সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে মাকে পৌঁছ সংবাদ জানিয়ে অফিসে ঢুকলো। তুয়া সহ অন্যান্য ইন্টার্নদের কোনো নির্দিষ্ট বসার জায়গা নেই। ওয়ার্কিং ডেস্ক নেই। ও আর দীপান্বিতা নামের আরেকটি ইন্টার্ন, সিঁড়ির নীচে একটা ছোট্ট কর্নারে প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিল জোগাড় করে ওখানেই বসে। প্যান্টরির মনিরুলদাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তুয়া দেখলো, দীপান্বিতা এখনো এসে পৌঁছয়নি। অবশ্য ওর বস, শোভন স্যার নিজেই আসেন লাঞ্চের পরে। আর এমনিতে বেশ হাসিখুশি দিলদরিয়া মানুষ। বকাঝকা করেন না। কাজ দিয়ে ডেডলাইন দেন। তার মধ্যে করে ফেললেই হলো। মাঝে মধ্যে চোদ্দবার এসে প্রোগ্রেস জানতে চান না। দীপান্বিতা অনেক স্বস্তিতে কাজ করতে পারে তাই। তুয়ার এই সুবিধে নেই। শ্রীময়ী ম্যাম ডেডলাইনগুলো দেন খুবই কম সময়ের। প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। তারই মধ্যে প্রায় ঘন্টায় ঘন্টায় প্রোগ্রেস দেখাতে হয়। বিরক্ত লাগে। তবে কাজের দিক থেকে ওর নিজের এসাইনমেন্টগুলো দীপান্বিতার চেয়ে ঢের বেশি ইন্টারেস্টিং লাগে। এই যেমন গত সপ্তাহে ওকে বাংলার হারিয়ে যাওয়া কিছু লোকসংস্কৃতির ওপর রিসার্চ করতে হয়েছিল। বেশ ভালো লেগেছিল তুয়ার। অনেক অনেক অজানা তথ্য জেনেছিল। ম্যাম ওকে সঙ্গে নিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে সাহায্য করেছেন। ম্যাগাজিনের কোনো এক সংখ্যায় এই বিষয়ে আর্টিকল লেখা হবে। ৫০০০ শব্দের লেখার জন্য দুজনের এক সপ্তাহব্যাপী রিসার্চ। সত্যিই, কতটা এফর্ট যায় একটা লেখার পিছনে, ভাবতেও অবাক লাগে। অথচ তুয়া যখন এইসব ম্যাগাজিন নিজে পড়তো, কখনো এত তলিয়ে ভাবেনি। সব সময় মনে হতো, এ বুঝি লেখক বা লেখিকার সহজাত জ্ঞান। এই ম্যাগাজিন হাউজে কাজ করতে এসে তুয়া অনেক কিছু শিখছে। জানছে। শ্রীময়ী ম্যাম কড়া ধাঁচের হলেও, ওঁর কাছে কাজ করলে অনেক জানা যায়, শেখা যায়। তুয়া জানে, এতে আখেরে ওরই কেরিয়ারে উন্নতিতে কাজে লাগবে। তাই মুখ বুজে বকুনি হজম করে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তুয়া দেখলো, আট মিনিট হয়েছে। তাড়াতাড়ি এক ঢোক জল খেয়ে হাতে রাইটিং প্যাড আর কলম নিয়ে ছুটলো ও শ্রীময়ীর কেবিনের দিকে। ম্যাম খুব সময়ের ব্যাপারে কড়া। একটু দুরুদুরু বুকে তুয়া নক করলো দরজায়। কে জানে, কী নতুন কাজ আসে। এ সপ্তাহটা কেমন যায়, দেখাই যাক।
নতুন সপ্তাহ। নতুন কাজ। নতুন করে জীবনযুদ্ধ।

Sunday, June 9, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ৫

রবিবার। বাকি লোকজনের জন্য এই দিনটা খুব আনন্দের হলেও তুয়ার কাছে এটা সবচেয়ে খাটাখাটুনির দিন। সারা সপ্তাহের বাজার করা চারটিখানি কথা না। তার ওপর জামা কাপড় কাচাকাচি এসব তো আছেই। তবে একটা কাজ যেটা খুব পছন্দ করে তুয়া সেটা হলো ওর টুকরো বারান্দাটাতে গাছপালার পরিচর্যা। প্রতিদিন সকালে গাছে নিয়মিত জল দিলেও, যত্ন আত্তি হয় এই একটা দিন। ছোট্ট এক ফালি বারান্দা। তাতেই টবে টবে ভরিয়ে দিয়েছে তুয়া। রঙ বেরঙে বাহারি সমস্ত টব। কোনো কোনটা আবার ঝুলছে গ্রিল থেকে। মানি প্লান্ট, চাইনিজ টগর, তুলসী, এলো ভেরা, মর্নিং গ্লোরি, নয়নতারা, দোপাটি - এসব আছেই। তার সাথে আবার লঙ্কা গাছ। নিয়মিত লঙ্কা হয়। তুয়া জেঠিমাদের দেয়। নিজে খায়। এবার ভেবেছে বর্ষায় একটা লেবু গাছের চেষ্টা করবে। সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে বা সক্কাল সক্কাল, যে কোনো সময় এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে বড্ড ভালো লাগে।
সারা সপ্তাহে মোটামুটি কী কী রান্না বান্না করাবে, তার একটা মোটামুটি ধারণা করে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরোয় তুয়া। সমবয়সীরা সুপার মার্কেট শপিং মল থেকে বাজার করলেও তুয়া এখনো সাধারণ পাড়ার বাজার থেকে কেনাকাটা করতেই ভালোবাসে। হাঁটু গেড়ে বসে সবজি চিনে চিনে বাছাই করে কেনা, কানকো টিপে মাছ কেনা এসবে আলাদা মজা। ছোটবেলা থেকেই রবিবার রবিবার বাবার হাত ধরে পাড়ার বাজার থেকে কেনাকাটা করতে যেত তুয়া। সেই অভ্যেসটা এখনো রয়ে গেছে। আর মোটামুটি এই বাজারের যারা ক্রেতা, তাদের তুলনায় তুয়াই সর্ব কনিষ্ঠ। তাই বাজার কাকুরা সবাই ওকে খুব খাতির যত্ন করে। মোটামুটি ভালো শাক, সবজি সব ওর জন্য আলাদা প্যাক করা থাকে। ফল কিনতে অবশ্য তুয়া ভালোবাসে না। এই সুন্দর ফলের মরসুম। বাজার ছেয়ে গেছে আম জাম জামরুল লিচুতে। কিন্তু তুয়ার সেসবে ঠিক ঝোঁক নেই। তাও মাঝে মাঝে কিনে ফেলে।
বাজার করে ফিরতে গিয়ে বাড়ির সামনেই দেখা হয়ে গেল ভুলুর সাথে। ধবধবে সাদা গায়ের রঙ। মধ্যে মধ্যে খয়েরি ছোপ। তুয়াকে দেখলেই খালি ল্যাজ নাড়তে থাকে। তুয়ার সাথে এত ভাবের কারণ আছে অবশ্য। দেখলেই বিস্কুট, রুটি কিছু না কিছু খাওয়াবেই খাওয়াবে। বিস্কুট দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে তুয়া বলে, " হ্যাঁ হ্যাঁ বাবু। আজ রবিবার স্পেশাল চিকেন কারি ভাত দেবো। দেড়টা নাগাদ চলে আসবি। ঠিক আছে সোনা?" ভুলুকে দেখলেই পাড়ার কালু লালুদের কথা মনে হয়। ওদের যে ভালোবাসতো, সেই ভালোবাসার পাত্র এখন ভুলু।
আস্তে আস্তে তুয়া গেট খুলে বাড়ি ঢোকে। কলকাতার রবিবারগুলো আসানসোলের মতো পুরো এক না হলেও, এই সব ছোট ছোট ব্যাপারে সেই সাবেকিয়ানা বজায় রেখেছে। এইটুকুই প্রাপ্তি।

Saturday, June 8, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ৪

ইন্টার্নশিপ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম একটা শনিবার তুয়ার ছুটি ছিলো। শ্রীময়ী ম্যাম সহ বাকি অনেকেই জামাইষষ্ঠীর ছুটি নিয়েছিল। তুয়া সারাদিন ওর এই এইটুকু ঘর, আলমারি এই সমস্ত গোছগাছ করলো। যদিও ঘর দোর পরিষ্কার করার জন্য জেঠিমাদের ঠিকে লোক মীনাদিকেই বলা আছে, তাও মাঝে মধ্যে একটু নিজের হাতে ঘর দোর না গোছালে তুয়ার চলে না। মোটে অষ্টাদশী হলে কী হবে? তুয়ার কিন্তু এই ইতিমধ্যেই বেশ একটা নিজের কাজ নিজে করা, স্বাধীনচেতা মনোভাব এসে গিয়েছে। আসানসোলের পাড়া পড়শিরা সেসব শুনে মাকে বলে, "বাহ বৌদি, মেয়ে যে ঘোরতর সংসারী হয়ে গেলো। বেশ ভালো। গ্র্যাজুএশনটা পাস করলেই বিয়ে দিয়ে দিতে পারবে, কোন চিন্তা নেই।" মা বা বাবা ভাগ্যিস এসবে তেমন মাথা ঘামায় না। ওদের ইচ্ছে, অবশ্যই তুয়ারও। মাস্টার্স পড়বে। তবে চাকরি। তারপর না হয় পরের কথা পরে ভাবা যাবে। তুয়া মাস কম্যুনিকেশন নিয়ে পড়ছে। ওর ইচ্ছে পরবর্তীকালে কোন মিডিয়া হাউজে যুক্ত হওয়ার, সাংবাদিক হিসেবে। আর সেই জন্যই এই সামারে ও বিখ্যাত এক বাংলা ম্যাগাজিনে ইন্টার্নশিপ করছে।
তুয়া যেই বাড়িটাতে থাকে, এর ঠিক সামনেই একটা বড় খেলার মাঠ। মাঠের চারিদিকে দোতলা বাড়ি। এখনও মাল্টি স্টোরিডের খপ্পরে পড়েনি এই পাড়াটা। বেশ একটা পাড়া-পাড়া ভাব এখনও আছে। তুয়ার খুব ভালো লাগে এই পরিবেশ। এক তলায় জেঠু জেঠিমা থাকেন। এই জেঠু জেঠিমা তুয়ার নিজের আত্মীয় না হলেও দূর সম্পর্কের পরিচিত। ওঁদের ছেলে ইংল্যান্ডে চাকরি করে। ওখানেই সেটল্ড। দোতলায় যে ঘরে তুয়া থাকে, তার পাশে দুটো ঘর সব সময় তালা দেওয়া থাকে, শুনেছে ওই দুটোই সেই ছেলের ঘর। মীনাদি সপ্তাহে দু তিনদিন তালা খুলে পরিষ্কার করে। জেঠু জেঠি দুজনেই বয়স্ক। একলা থাকবেন, এত বড় বাড়ি। তাই পেয়িং গেস্ট রেখেছেন। কাগজে কলমে তুয়ার লোকাল গার্জেন হলেও, সেরকমভাবে ওঁরা গার্জেনগিরি ফলাননা। মাঝে মধ্যে জেঠির হেঁশেলে ভালো মন্দ রান্না হলে ওপরে পৌঁছে যায়। এমনিতে তুয়া নিজের বাজার নিজেই করে। রান্নাটা করে দেয় লক্ষ্মী পিসি। তুয়া রোজ বেরনোর আগে একটা চিরকুটে লিখে দিয়ে যায় কী কী রান্না হবে। ওর ঘর লাগোয়া ছোট্ট কিচেনে। ফ্রিজে বাজারহাট থাকে। পিসি সারাদিনে যে কোন সময় হোক এসে রান্না করে রেখে যায়। এই ব্যবস্থা জেঠিমারই করা। তুয়াকে প্রথমেই বলেছিলেন, "শোনো, তোমাদের বয়সের খাওয়া দাওয়া রুচি সব আমাদের থেকে আলাদা। তাই ভালো হয়, নিজের খাওয়ার ব্যবস্থা আলাদা করেই করো। এই হলে সম্পর্ক খারাপ হবেনা। এমনিতেই ভাড়াটে বাড়িওয়ালার সম্পর্ক বিখ্যাত।"
এই সিস্টেমে তুয়ার দিব্যি চলে যাচ্ছে। এক বছর তো হয়ে গেলো। কেউ কারুর ব্যাপারে নাক গলায় না। বাড়ির কিছু সামান্য নিয়ম কানুন আছে। ওই যেমন, রাত দশটার মধ্যে ফেরা, বাইরে রাত কাটালে আগাম জানিয়ে রাখা। এইসব। কথাবার্তা খুব যে নিয়মিত হয়, তা না। মাঝে মধ্যে হাই হ্যালো। সৌজন্যমূলক হাসি বিনিময়। ব্যস। এই ভালো। বাসন একসাথে থাকলে ঠোকাঠুকির যে প্রবল সম্ভাবনা, ভাগ্যিস দুপক্ষই জানে। আর তাই, পাড়া প্রতিবেশীদের অবাক করে দিয়ে এক বছরের ওপর তুয়া টিকে আছে পেয়িং গেস্ট হিসেবে।

Friday, June 7, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ৩

আজ গিনির জন্মদিন। গিনি, মানে তুয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই ছোটবেলা থেকে ওরা বন্ধু। সেই সূত্রে ওদের মায়েরা বন্ধু, বাবারা বন্ধু। গিনি থাকে সিডনিতে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছে। তুয়া এসেছে কলকাতা। দুই বন্ধুর মধ্যে অবশ্য ভৌগোলিক দূরত্বটা বাড়াবাড়ি হলেও, ভাগ্যিস মনের দিক থেকে এখনও ওরা পড়শী। রাত বারোটা বাজতেই, প্রতি বছরের মতোই গিনিকে ফোন করলো তুয়া। এবং দুটো রিং হতেই মনে হলো, "এই রে, এখন তো ওদের সবে ভোর সাড়ে পাঁচটা। ঘুমাচ্ছে নির্ঘাত। রেখেই দিই। সকালে উঠে ফোন করবো।"  ফোনটা সবে কাটতে যাবে, ঘুম জড়ানো গলায় গিনি বলল, "বল তুয়াপাখী।" এক লহমায় তুয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।  "তুয়াপাখী"। নামটা এত মিষ্টি লাগে শুনতে। তুয়া একটু বেশিই রোগা। বাকি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনরা যখন এই নিয়ে ওকে বারবার কিছু না কিছু উপদেশ দিতে থাকে, একমাত্র গিনিই ওকে সান্ত্বনা দেয় আর বলে, "আরে, চাপ কী? সবাই হাতি গন্ডার হলে ইকো সিস্টেম ব্যালেন্স কে মেন্টেন করবে? তুই নাহয় পাখীই হলি। আমার তুয়াপাখী।" গিনিটা খুব সমঝদার। কখন কার সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, আদব কায়দা সবেতে এক্সপার্ট। তুয়া আবার ঠিক তার উল্টো। ঠিকমতো গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, এমন না। তবে যথা সময়ে কথাগুলো আসে না মাথায়। ফলে প্রচুর আফসোস। প্র্যাক্টিকাল সমস্যার সমাধানের জন্যও তুয়া বরাবর গিনির দ্বারস্থ হয়। সব মিলিয়ে, গিনি এক্কেরে তুয়ার ফে ফি গা, অর্থাৎ, ফ্রেন্ড ফিলোজফার গাইড।
"এই সরি, আমার একদম মাথায় ছিল না টাইম জোনের ব্যাপারটা। তোর কাঁচা ঘুম ভাঙ্গালাম।" তুয়া একটু লজ্জিত কন্ঠেই বলে।
"ওরে ইডিয়ট, অন্তত আগে উইশটা তো করবি!" গিনি মৃদু ধমক দেয়।
"হ্যাপ্পপ্পপি বার্থডে গিনি। আনন্দে কাটুক বছরটা। খুব খুব এঞ্জয় কর। আজকের পার্টিটা ডিউ রইলো।"
"অবশ্যই। এখানে দু একটা বন্ধুবান্ধব যা জুটেছে, ওদের সাথে আজ সেলিব্রেশনের প্ল্যান আছে ঠিকই।"
"কে কে? মার্ক? আহেম" তুয়া গিনিকে মাঝ বাক্যে আটকে দিয়ে বলে।
"এক মা খাবি মার্কের চ্যালা কোথাকার। কথা শেষ করতে দে।" গিনি আবারও বকে দেয়।
এ ওদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।
দুজনেরই ভালো লাগে। একে অপরকে শাসন করতে। সহায় হতে। ওরা দুজনে যেন  মায়ের পেটের বোন, এমন মিলমিশ ওদের।
আরো খানিক টুকটাক গল্প করে তারপর ওরা ফোন ছাড়ে। তুয়াকেও এবার শুতে হবে। কাল অফিসে একটু হেক্টিক আছে। শ্রীময়ী ম্যামের সাথে কাল একটা ইন্টারভ্যু শুটে যেতে হবে। গিনিও হয়তো আর ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে কলেজ যাবে। ওদের এখন শীত যাবো যাবো করছে। দারুণ ওয়েদার। তুয়ার খুব ইচ্ছে হয়, একবার গিনির কাছ থেকে ঘুরে আসবে। মে মাসে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপবে। ভারি মজা। গিনি থাকতে থাক্তেই যেতে হবে। টাকা জমানো শুরু করে দিয়েছে ও তাই।

সকালে ঘুম ভাঙল সেই ৬ঃ২৩এই। হাত মুখ ধুয়ে লেবুর জল বানিয়ে একবার ওর পুঁচকি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তুয়া। নীচে দুই মা দাঁড়িয়ে, সাথে তাদের দুই ছানা। মায়েরা ওদের শান্ত হয়ে দাঁড়াতে বলছে, বাস এসে যাবে এক্ষুণি। ওরা কে শোনে কার কথা। দুটিতে দৌড়াদৌড়ি করে যাচ্ছে। কী মিষ্টিই যে লাগছে ওদের দেখতে, তুয়া ভাবে। ঠিক যেন বছর বারো আগের তুয়া আর গিনি। সেই ভোরের বাস স্ট্যান্ড, কালারম্যান, কুমির ডাঙ্গা খেলা। ওদের অবশ্য দল ছিলো আরো বড়। মোহনা, চাঁদনী, দোলন। তখন এত গলায় গলায় ভাব, এদিকে এখন দেখো, কারুর সাথেই আর যোগাযোগ নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুয়া। নাহ, আবার আস্তে আস্তে সব্বাইকে খুঁজে নিতে হবে।

Thursday, June 6, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ২

যতই রাত করে ঘুম আসুক না কেন, ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে ছটায় তুয়া উঠে পড়বেই। ফোনে অ্যালার্ম দেওয়া আছে ঠিকই, কিন্তু বায়োলজিকাল ক্লকের ওসব লাগেনা। নইলে প্রতিদিন সকাল সকাল উঠে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কখনো রোজ ঠিক ৬ঃ২৩ই বাজে? একটুও অন্যথা হবে না? তবে এ অভ্যেসের জন্য দায়ী ওর দীর্ঘ চোদ্দ বছরের মর্নিং স্কুল। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা, সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে দৌড়াদৌড়ি করে ঘুম চোখে নীল সাদা লজঝরে স্কুলবাসে চেপে হন্তদন্ত হয়ে মর্নিং আসেম্বলিতে "মঙ্গল দীপ জ্বেলে" গাওয়া। এইভাবেই হয়ে যেত ওর রোজের গানের রেওয়াজ। আজকাল আর গান গায়না তুয়া। গান যে খুব ভালোবেসে গাইতো, এমন কথা বলা যায়না। বরং মাকে রীতিমতো বকাঝকা করেই সন্ধ্যেবেলা হারমোনিয়াম নিয়ে বসাতে হত। পাশের বাড়ি থেকে মৃন্ময়ী কাকীমার সন্ধ্যে দেওয়ার শাঁখের শব্দই হতো সেই সিগ্নাল। এইবার বাপু খেলা থামিয়ে ঘরে এসো, মা অপেক্ষা করছে। নইলে কপালে দুঃখ আছে। আজকাল তুয়ার জীবন থেকে কী করে কে জানে গান হারিয়ে গিয়েছে। দিন রাত কানে ইয়ারফোন গুঁজে কাজের ফাঁকে ফাঁকে গান চলতে থাকে বটে, তবে সেসব গানের সুরে বা কথায় তেমন মনোযোগ দেওয়া হয়না। এমন নয় যে তুয়া প্রাচীনপন্থী, হালফিলের গান মানেই বিশ্রী, এমন মনোভাব। একদমই না। আজকাল কত সুন্দর সুন্দর গানও হয়। শুনেওছে তুয়া। কিন্তু কিছুতেই যেন আর আগের মতো আনন্দ পায়না। গাইতেও ইচ্ছে করেনা। কতদিন স্টেজে অনুষ্ঠান করেওনি, দেখতেও যায়নি। অভ্যেস।
ইলেক্ট্রিক কেটলিতে খানিকটা গরম জল করে, তাতে লেবুর রস আর মধু মিশিয়ে খাওয়ার হ্যাবিটটা মা তৈরি করে দিয়েছে। এত সর্দি কাশিতে ভোগে, তাই একটু ন্যাচারাল সোর্স অফ ভিটামিন সি। খেতে খুব একটা ভালো লাগেনা। কিন্তু ওই যে, অভ্যেস। উপকার পায় বলেও তো মনে হয়না। একটু বৃষ্টিতে ভিজলেই হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো শুরু হয়ে যায়। তবুও রোজ নিয়ম করে আলসেমি কাটিয়ে জলটা গরম ও করবেই। কোন কোন দিন ইচ্ছে হয় একটু বিদ্রোহ করে, খাবে না। জল গরম করবে না। করলেও ফেলে দেবে। তবে পর মুহূর্তেই মনে পড়ে, একটু পরেই মা ভিডিও কল করবে। হাতে কাঁচের গ্লাসে লেবুর জল না দেখলেই প্রশ্ন করবে। মিথ্যে কথা তুয়া বলতে পারেনা। তাই মা জেনেই যাবে। তারপর মা বকা দেবে। শুরু হবে এক প্রস্থ "আমি দূরে আছি বলে যা ইচ্ছে করে নে। শরীরের যত্ন নিতে হবে না আর। অসুখ করলে কে দেখবে?" ইত্যাদি ইত্যাদি। সক্কাল সক্কাল এসব আর ভালোই লাগেনা। তার চেয়ে চুপচাপ খেয়ে নাও। তিতো বড়ির মতো। শান্তির বড়ি।

Wednesday, June 5, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ১

সারাদিন কোন কাজ ছিল না। জাস্ট কোন কাজ না। অথচ অফিসটার নিয়ম এমন দেখো, ইন্টার্নদের সেই সকাল ৯টায় ঢুকতে হবে। বেরোতে বেরোতে সাতটা। আরে বাবা, কাজ করতে মোটেই খারাপ লাগেনা তুয়ার। কিন্তু এই বিনা কারণে বসে থাকা। বড্ড বিরক্তিকর। বাকি ক্লাসমেটগুলো সব কী সুন্দর কলকাতায় বাড়ি। তাই পরীক্ষার পরে ইন্টার্নশিপও করছে, এদিকে বাড়ির আরামে আছে। তুয়ার বাড়ি আসানসোল। পরীক্ষা শেষ হলেও এই আড়াই মাস মেসেই পড়ে থাকতে হচ্ছে। আজ আবার ছুটির দিন অফিশিয়ালি, কিন্তু শ্রীলেখা ম্যাম নিজে আসবেন কাজে, তাই ওকেও আসতে হলো। ম্যাম অন্যান্যদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান, ছোট বাচ্চা আছে বাড়িতে, তাই। ছুটির দিনগুলোতেই যত কাজ মনে পড়ে। আর যেহেতু তুয়া ওঁর সুপারভিশনে কাজ করে, তাই ওকেও থাকতেই হয়। আজ কী অসম্ভব ভালো ওয়েদার, সারাদিন জানলার বাইরে হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে আর আফসোস করেছে তুয়া। এমন দিনে কোথায় পার্কে ঘুরে বেড়াবে, রাজপথ ধরে হাঁটবে, হুঠহাঠ ফুচকার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়বে, গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে থাকবে। তা না। নিকুচি করেছে এই ইন্টার্নশিপ। ছেড়ে দেবে। ভালো লাগেনা একা একা এখানে পড়ে থাকতে। ইচ্ছে করছে এক ছুট্টে গিয়ে মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে শুতে। আর বলতে, "আজ খিচুরি ডিম ভাজা?" মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলবে, "বেশ তো। বাবাকে বলে দিই। একটু পাঁপড় নিয়ে ঢুকুক।"

আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে তুয়া লোহার গেটটা ঠেলে ঢোকে ওর এই পায়রার খুপরিতে। সিঁড়ির আলোগুলো জ্বালতে জ্বালতে উঠে যায় দোতলায়, ওর কুঠুরিতে। আটটা বেজে গেছে। একতলা থেকে জেঠিমাদের রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁকছোক শব্দ আসছে। গন্ধে মনে হচ্ছে বেগুনি, তেলেভাজা। নির্ঘাত খিচুরিও হয়েছে, বা হবে। ফোনটা হাতে নিয়ে তুয়া অ্যাপ খুলল। আশেপাশে যদি কোন রেস্টুরেন্ট খিচুরি বিক্রি করে, তাহলে অর্ডার দেবেই। উঁহু। খানিক দেখে টেখে কিছুই তেমন পাওয়া গেলো না। তাহলে কি নুডলস অর্ডার দেবে? ঝাল ঝাল... মন্দ লাগবে না ওয়েদারে। এমন সময় কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো জোরে। কাছেই। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিটা নামলো বলে। থাক, এই ওয়েদারে আর কাউকে রিস্ক নিয়ে এসে ওর খাবার ডেলিভারি করতে হবেনা আর। স্টকে ম্যাগি আছে। সেই বানিয়ে খাবে নাহয়। ইচ্ছেগুলোকে সব সময় কি আর সায় দেওয়া যায়? নিজের মনেই হাসে তুয়া। মা ঠিকই বলে। একলাযাপন ওকে বড় করে দিয়েছে অনেকটা।

Tuesday, June 4, 2019

শহরের পাঁচালি ১০

বারান্দার এই দোলনাটাতে বসে থাকতে থাকতে বেশ অনেকটা সময় কেটে যায় জাহ্নবীর। মধ্য বয়স। ছেলে মেয়েরা যখন যে যার মতো কেরিয়ার গড়তে সব্বাই দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এখন অখন্ড অবসর ওর। রায় বাহাদুর পরিবারের পুত্রবধূ, টাকার কোন অভাব নেই। আর তাই অভাব নেই কাজের লোকের, সেবা করার লোকের। তবে এমন পরিবারের সাথে মানানসই দাপট কোনদিনও ছিল না জাহ্নবীর। এই বয়সে এসে তো আরোই কথা ওঠে না। সারাদিন নিজের মতো করে সময় কাটে। গাছের খুব শখ জাহ্নবীর, বরাবর। নিজে হাতে বারান্দা আর ছাদে মরসুমি ফুলের বাগান করেছে। তাদের যত্নআত্তি করতে করতে আর তারপর ঠাকুরঘরে খানিকটা সময় গোপালের সেবা করতে করতে সারা সকাল চলে যায়। সব সময়ের কাজের লোক পলাশী হাতে হাতে সাহায্য করে দেয়। তারপর দুপুর থেকে এই বারান্দায়, গাছের মাঝে, ছোট্ট দোলনায়। কফি টেবিলে পাশে রাখা থাকে নানান ম্যাগাজিন, বই। যখন যেটা ইচ্ছে। আর থাকে পানের ডিবে।
আকাশ দেখতে খুউব ভালোবাসে জাহ্নবী। একেক মরসুমে, দিনের একেক সময়ে, আকাশের রঙের যে এই পরিবর্তন... মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে ও। যেমন এই আজকের আকাশ। বিকেল আর কটা হবে... ওই চারটে? কী মায়াবী হলুদ আলো। এমন সোনালী আকাশ সচারচর চোখে পড়ে না। মেঘ করে আছে বটে, তবুও এই যে অদ্ভুত সুন্দর রঙ। একেই বুঝি বলে কনে দেখা আলো?
জাহ্নবীর মনে পড়ে যায়। প্রায় বছর পঁচিশ আগের কথা। এমনই এক মায়াবী বিকেলে এক জোড়া মুগ্ধ চোখ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল ওর দিকে। অনেক্ষণ। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল একটা মধুর অনন্তের। আর সদ্য স্কুল পেরনো সেই রাই কিশোরী জাহ্নবীর সলজ্জ আরক্ত দুই গালের সাথে তাল মিলিয়ে পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়ছিল দীপ্যমান সূর্য।

Monday, June 3, 2019

শহরের পাঁচালি ৯

ভবানীপুরের সরু গলির অনেকটা ভিতরে টালির চালের ঘরে একটা পুরনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত নিজের সাজ দেখে নিলো নীলাম্বরী। বা বলা চলে, মেপে নিলো নিজেকে। ঠিক যেমনভাবে প্রতিদিন মাপে ওকে হাজার হাজার "মানুষ"। অবশ্য এতে নীলাম্বরীর আক্ষেপ নেই এতটুকুও। হাজার হোক, এইভাবেই তো সংসারটা চালাতে পারছে ও।
আর পাঁচটা এমন মেয়ের সাথে নীলাম্বরীর জীবনের গল্পেও তেমন পার্থক্য নেই। সেই গরীব বাবা, অসুস্থ মা, ফ্যাক্টরি লক-আউট হওয়া ভাই। ভগবান যখনই ওকে কিছু দিয়েছেন, বেশ ঢেলে দিয়েছেন। তাই অভাব অনটনের কোন কমতি নেই।
তবে কথায় আছে না? চিনির ব্যবস্থাও চিন্তামণিই করে দেন। তা আমাদের নীলাম্বরীর এই অভাবের থেকে ক্ষণিকের মুক্তির পথও ঈশ্বর ঠিক খুঁজে দিয়েছেন। ছোট থেকেই অসম্ভব রূপের ছটা ওর। আকর্ষক চেহারা, ঝকঝকে মুখশ্রী। সাথে ভাগ্যিস টেন পাশ করে পাড়ার লোকের পাল্লায় পড়ে বেসিক স্পোকেন ইংরেজিটা শিখে ফেলেছিলো। এখন তাই নীলাম্বরী "কমপ্লিট প্যাকেজ"। বলতে নেই, আর্থিক অভাব অনেকটাই এখন আয়ত্তে এসে গিয়েছে।
চাইনিজ কোম্পানির বড় স্মার্টফোনটা বেজে ওঠে নীলাম্বরীর। অপর প্রান্তে অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার। তাকে লোকেশন বুঝিয়ে কালো চকচকে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নীলাম্বরী। থুড়ি, বিখ্যাত এস্করট নীলা।
আজ রাতের ঠিকানা গ্র্যান্ড হোটেল। আজ আবারও কর্পোরেট ক্লায়েন্ট।
ঝলমলে নগরীর ঐতিহ্য প্রাসাদে কুহকিনীর আরো এক মোহিনী রাত্রিযাপন।

Saturday, June 1, 2019

শহরের পাঁচালি ৮

উপায়নের ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিল ইজ্যা। যাদবপুর থেকে একসাথে ইকোনমিক্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন আর তারপর মাস্টার্স করে একইসাথে দুজনে লন্ডন চলে যায় চাকরি নিয়ে। তারপর ক্রমে ভালো বন্ধু থেকে আরেকটু বেশি, এবং অবশেষে বর্তমানে প্রেমিক প্রেমিকা। তাও প্রায় বছর চারেক হয়ে গিয়েছে। গরমের ছুটি নিয়ে উপায়ন ইজ্যা দুজনেই এখন কলকাতায়। লন্ডনে একসাথে থাকাকালীন ঠিক করে নিয়েছিল, কলকাতায় এক মাস যত সম্ভব কম দেখা করবে একে অপরের সাথে। এই এক মাস শুধুই পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের জন্যই থাক। দুজনেই এটাকে বেশ সুবিধের মনে করেছে। আসলে গত কিছু মাসে একে অপরের মধ্যে যেন বড্ড খিটমিট লেগেই থাকতো। হয়তো একটু বেশিই একসাথে থাকার ফলে। দুজনের কাছেই তাই এইটা যেন সেই "much needed break"।


এ হেন অবস্থায় উপায়নের ফোন সত্যিই বেশ আকস্মিক। উপায়ন ইজ্যার সাথে দেখা করতে চায়। কী বৃত্তান্ত, কেন, এইসব জিজ্ঞেস করায় উত্তর পায়নি ইজ্যা। উপায়নের গলার স্বরও কেমন জানি সিরিয়াস। কী জানি, কী হলো আবার। সারাদিন ভারী উৎকণ্ঠায় কাটে ইজ্যার। বিকেলে সময়মতো ক্যাব নিয়ে ইজ্যা পৌঁছে যায় বিশ্ব বাংলা গেটে। তখনও বোধহয় উপায়ন এসে পৌঁছয়নি। বরাবরের লেট লতিফ। ইজ্যা অবাক হয়ে দেখতে থাকে সামনের বিরাট স্থাপত্য। কী বিশাল, অথচ কী সুন্দর। অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতোই দেখে ইজ্যা। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে কয়েকটা ছবিও তুলে ফেলে। ফিরে গিয়ে বন্ধুদের দেখাবে। কে বলে কলকাতা এখনো সেই ঝিমিয়ে থাকা পুরোনো শহর? দিল্লি বম্বের সাথে দিব্যি টেক্কা দিয়ে যেতে পারে আধুনিকতায়।


"অনেকক্ষণ এসে গিয়েছিস?" উপায়নের গোয়ার স্বরে সম্বিৎ ফেরে ইজ্যার।


"হুম। মিনিট কুড়ি হবে।" ইজ্যা হেসে বলে।


"সরি, আসলে ক্যাবটা পেতে দেরি হলো।" দুইহাতে দুই কান ধরে হাসিমুখে বলে উপায়ন।


যাক, আশা করি তাহলে সিরিয়াস কিছু না। ইজ্যা মনে মনে ভাবে।


"চল, ওপরে যাই। দারুণ ভিউ ওখান থেকে। খাবারও মন্দ না ক্যাফেতে।" উপায়ন বলে।


"চল।" ইজ্যা উপায়নের পিছু পিছু হাঁটা লাগায়। উপায়ন টিকিটের ব্যবস্থা করেই রেখেছিল। ওরা লিফটে করে ওপরে উঠলো। জানলার ধারে টেবিল বুক করা ছিল। বাইরে তাকিয়ে ইজ্যার মন খুশিতে ভরে গেল।


কী দুর্দান্ত দৃশ্য। এই এত উঁচু থেকে আধুনিকা শহর। বিরাট বিরাট হাইরাইজ। চওড়া রাস্তা। সাইসাই করে ছুটে চলেছে গাড়ি। ভলভো বাস। যে কোনো বিদেশি শহরের সাথে পার্থক্য নেই।


ওয়েটার ওদের জন্য লাইম মিন্ট সোডা এনে দিলো। চুমুক দিতে দিতে উপায়ন বললো, "ইজ্যা, মনে আছে বি এ পড়ার সময় আমরা কতদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চার নম্বর থেকে ঢাকুরিয়া চলে যেতাম।"


ইজ্যা হেসে বলে, "মনে থাকবে না? সেই ফুট ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতাম কতক্ষণ... গাড়ির ঢল নামা দেখতাম।"


"তোর ফেভারিট ছিল। আমার মনে আছে। কী অদ্ভুত এক মুগ্ধতা লেগে থাকতো তোর চোখে মুখে। যেন শহরতলীর মেয়ে, প্রথম শহরে আসার মাদকতা উপভোগ করছিস। অথচ তুই এই খাস দক্ষিণ কলকাতায় মানুষ। আমি নাহয় উত্তরের এঁদো গলিতে বড় হয়েছি। অথচ তোর মধ্যে থাকতো কী অসম্ভব ভালো লাগা।"


"আসলে এমন আলোর ধারা, গাড়ির স্রোত। ডায়নামিক জীবন। ভীষণ ভালো লাগে।"


"ওই জন্যই তো আজ এখানে মিট করছি। আজ একটু স্পেশাল। তাই এই জায়গাটাই বাছলাম।"


ইজ্যা খানিক অবাক হয়ে একটা ভুরু তুলে প্রশ্ন করে, "স্পেশাল?"


উপায়ন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে খানিক। কোন কথা বলে না। দুই চোখে একরাশ মুগ্ধতা। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে একদম হাঁটু গেড়ে বসে ইজ্যার সামনে। ইজ্যা একটু লজ্জা টজ্জা পেয়ে বলে, "এই, কী করছিস?"


উপায়ন ওঠে না। শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্স বের করে সেটার ঢাকনা খুলে ইজ্যার সামনে ধরে বলে, "উইল ইউ ম্যারি মি?"


বিকেলের অস্তগামী সূর্যের রক্তিম ছটা যেন আরক্ত করে ইজ্যাকে। সলজ্জ, সপ্রতিভ ইজ্যা। আংটির হীরের মতোই জ্বলজ্বল করে ওর চোখ। খুশিতে। আহ্লাদে।


নীচের রাস্তা দিয়ে গারির ঢল বয়ে যায়। জীবন বয়ে চলে। চির শাশ্বত বেগে।