Saturday, June 1, 2019

শহরের পাঁচালি ৮

উপায়নের ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিল ইজ্যা। যাদবপুর থেকে একসাথে ইকোনমিক্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন আর তারপর মাস্টার্স করে একইসাথে দুজনে লন্ডন চলে যায় চাকরি নিয়ে। তারপর ক্রমে ভালো বন্ধু থেকে আরেকটু বেশি, এবং অবশেষে বর্তমানে প্রেমিক প্রেমিকা। তাও প্রায় বছর চারেক হয়ে গিয়েছে। গরমের ছুটি নিয়ে উপায়ন ইজ্যা দুজনেই এখন কলকাতায়। লন্ডনে একসাথে থাকাকালীন ঠিক করে নিয়েছিল, কলকাতায় এক মাস যত সম্ভব কম দেখা করবে একে অপরের সাথে। এই এক মাস শুধুই পরিবার পরিজন ও বন্ধুদের জন্যই থাক। দুজনেই এটাকে বেশ সুবিধের মনে করেছে। আসলে গত কিছু মাসে একে অপরের মধ্যে যেন বড্ড খিটমিট লেগেই থাকতো। হয়তো একটু বেশিই একসাথে থাকার ফলে। দুজনের কাছেই তাই এইটা যেন সেই "much needed break"।


এ হেন অবস্থায় উপায়নের ফোন সত্যিই বেশ আকস্মিক। উপায়ন ইজ্যার সাথে দেখা করতে চায়। কী বৃত্তান্ত, কেন, এইসব জিজ্ঞেস করায় উত্তর পায়নি ইজ্যা। উপায়নের গলার স্বরও কেমন জানি সিরিয়াস। কী জানি, কী হলো আবার। সারাদিন ভারী উৎকণ্ঠায় কাটে ইজ্যার। বিকেলে সময়মতো ক্যাব নিয়ে ইজ্যা পৌঁছে যায় বিশ্ব বাংলা গেটে। তখনও বোধহয় উপায়ন এসে পৌঁছয়নি। বরাবরের লেট লতিফ। ইজ্যা অবাক হয়ে দেখতে থাকে সামনের বিরাট স্থাপত্য। কী বিশাল, অথচ কী সুন্দর। অবাক হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতোই দেখে ইজ্যা। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে কয়েকটা ছবিও তুলে ফেলে। ফিরে গিয়ে বন্ধুদের দেখাবে। কে বলে কলকাতা এখনো সেই ঝিমিয়ে থাকা পুরোনো শহর? দিল্লি বম্বের সাথে দিব্যি টেক্কা দিয়ে যেতে পারে আধুনিকতায়।


"অনেকক্ষণ এসে গিয়েছিস?" উপায়নের গোয়ার স্বরে সম্বিৎ ফেরে ইজ্যার।


"হুম। মিনিট কুড়ি হবে।" ইজ্যা হেসে বলে।


"সরি, আসলে ক্যাবটা পেতে দেরি হলো।" দুইহাতে দুই কান ধরে হাসিমুখে বলে উপায়ন।


যাক, আশা করি তাহলে সিরিয়াস কিছু না। ইজ্যা মনে মনে ভাবে।


"চল, ওপরে যাই। দারুণ ভিউ ওখান থেকে। খাবারও মন্দ না ক্যাফেতে।" উপায়ন বলে।


"চল।" ইজ্যা উপায়নের পিছু পিছু হাঁটা লাগায়। উপায়ন টিকিটের ব্যবস্থা করেই রেখেছিল। ওরা লিফটে করে ওপরে উঠলো। জানলার ধারে টেবিল বুক করা ছিল। বাইরে তাকিয়ে ইজ্যার মন খুশিতে ভরে গেল।


কী দুর্দান্ত দৃশ্য। এই এত উঁচু থেকে আধুনিকা শহর। বিরাট বিরাট হাইরাইজ। চওড়া রাস্তা। সাইসাই করে ছুটে চলেছে গাড়ি। ভলভো বাস। যে কোনো বিদেশি শহরের সাথে পার্থক্য নেই।


ওয়েটার ওদের জন্য লাইম মিন্ট সোডা এনে দিলো। চুমুক দিতে দিতে উপায়ন বললো, "ইজ্যা, মনে আছে বি এ পড়ার সময় আমরা কতদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে চার নম্বর থেকে ঢাকুরিয়া চলে যেতাম।"


ইজ্যা হেসে বলে, "মনে থাকবে না? সেই ফুট ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতাম কতক্ষণ... গাড়ির ঢল নামা দেখতাম।"


"তোর ফেভারিট ছিল। আমার মনে আছে। কী অদ্ভুত এক মুগ্ধতা লেগে থাকতো তোর চোখে মুখে। যেন শহরতলীর মেয়ে, প্রথম শহরে আসার মাদকতা উপভোগ করছিস। অথচ তুই এই খাস দক্ষিণ কলকাতায় মানুষ। আমি নাহয় উত্তরের এঁদো গলিতে বড় হয়েছি। অথচ তোর মধ্যে থাকতো কী অসম্ভব ভালো লাগা।"


"আসলে এমন আলোর ধারা, গাড়ির স্রোত। ডায়নামিক জীবন। ভীষণ ভালো লাগে।"


"ওই জন্যই তো আজ এখানে মিট করছি। আজ একটু স্পেশাল। তাই এই জায়গাটাই বাছলাম।"


ইজ্যা খানিক অবাক হয়ে একটা ভুরু তুলে প্রশ্ন করে, "স্পেশাল?"


উপায়ন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে খানিক। কোন কথা বলে না। দুই চোখে একরাশ মুগ্ধতা। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে একদম হাঁটু গেড়ে বসে ইজ্যার সামনে। ইজ্যা একটু লজ্জা টজ্জা পেয়ে বলে, "এই, কী করছিস?"


উপায়ন ওঠে না। শার্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্স বের করে সেটার ঢাকনা খুলে ইজ্যার সামনে ধরে বলে, "উইল ইউ ম্যারি মি?"


বিকেলের অস্তগামী সূর্যের রক্তিম ছটা যেন আরক্ত করে ইজ্যাকে। সলজ্জ, সপ্রতিভ ইজ্যা। আংটির হীরের মতোই জ্বলজ্বল করে ওর চোখ। খুশিতে। আহ্লাদে।


নীচের রাস্তা দিয়ে গারির ঢল বয়ে যায়। জীবন বয়ে চলে। চির শাশ্বত বেগে।

No comments:

Post a Comment