নতুন সেশনে কলেজ খুলে গেছে তা প্রায় দিন দশেক হয়ে গেল। মাও সপ্তাহখানেক
তুয়ার সাথে কাটিয়ে আবার আসানসোল ফিরে গেছে। আসলে মা না থাকলে তুয়ার বাবার
খুবই অসুবিধে হয়। সেই ভোর ভোর অফিস বেরোতে হয়। তখন হাতের কাছে জিনিসপত্র
ঠিকঠাক না পেলে ভারী মুশকিল। নতুন ক্লাস। পুরোনো বন্ধু। নতুন সিলেবাস। নতুন
সাবজেক্ট। পুরোনো নতুন মিলিয়ে স্যার ম্যামেরা। আর পুরোনো ক্লাসরুম। দিব্যি
চলছে। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা তুয়ার বরাবরই ভালো লাগে। আর এখানে দেশী বিদেশী
নানান ভাষার সাহিত্যের চর্চা, একটা ক্লাসও
তুয়া মিস করতে চায় না। তবে এইবারে অবশ্য এই ক্লাস ভালো লাগার বাড়তি কারণ
হয়েছে। হ্যাঁ, বিশেষ কারণ। এবং কারণ নিতান্তই সাধারণ ও চিরাচরিত। হৃদয়ঘটিত।
মকবুল সিদ্দিকি নামের এক ভদ্রলোক। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি
করছেন রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলায় লোকসঙ্গীতের প্রভাব বিষয়ে। ছমাসের
ফেলোশিপ নিয়ে এই সেমিস্টারটা ওদের হৈমন্তী ম্যাডামের কাছে থেকে গবেষণা
করবেন। হৈমন্তী ম্যামও এমন স্কলারকে পেয়ে দু চারটে বিষয় দিয়ে দিয়েছেন
মকবুলকে। ছ ফুট লম্বা,ফর্সা, গালে হাল্কা সব্জেটে দাড়ি, চোখে রিমলেস চশমা।
পরনে ব্লু জিন্স আর সাদা পোলো নেক টিশার্ট। যেন সিনেমার পর্দা থেকে নেমে
আসা কোনো হিরো। মকবুলের চেহারা যেমন সুন্দর, ঠিক ততটাই দুর্দান্ত ওর
বাচনভঙ্গি। গলার স্বর? যেন প্রফেশনাল আরজে। মিশুকে। হাসিখুশি। দুটো ক্লাসেই
তুয়াসহ গোটা ব্যাচের মেয়েরা কুপোকাত। ক্লাসের শুরুতে আগেভাগে মেয়েরা পৌঁছে
যায়, ফ্রান্ট বেঞ্চে বসবে বলে। পিরিয়ড শেষের বেল বাজলেও মনগড়া সমস্ত ডাউট
নিয়ে ঘিরে ধরে ওকে সব্বাই। পরের ক্লাস নিতে এসে শরদিন্দু বাবু খানিক
দাঁড়িয়ে থাকেন। উনিও রসিক মানুষ। মুখ টিপে হাসেন। মিনিট সাত দশের ছাড়
দেওয়ার পর গলা খাকরি দিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে মকবুলকে মুক্তি দেন। মেয়ের দল
হতাশ হয়ে আবার যে যার জায়গায় ফেরে।
তুয়া নিজে লোকসংগীত নিয়ে অল্প
বিস্তর চর্চা করে। আর তাই ক্লাসের পড়া বুঝতে সহজ হয়। মকবুলের টুকটাক
প্রশ্নের উত্তরও ঝটপট দিয়ে দেয়। মকবুল এই কদিনেই সেটা বেশ লক্ষ্য করেছে।
ক্লাসে পড়াতে পড়াতে তাই বারবার যেন চোখ পড়ে যায় তুয়ার দিকেই। তুয়া খানিক
অপ্রস্তুত হয়ে সলজ্জ হাসি হেসে মাথা নামিয়ে নেয় নোটসের খাতায়। মকবুল খানিক
কি মর্মাহত হয়? কে জানে? তবে হ্যাঁ, অবশ্যই অপেক্ষা করতে থাকে আবার পরের
ক্লাসের জন্য। যদি আবার সেই সাদা কুর্তি আর হলুদ সালোয়ার পরে আসে মেয়েটি।
নোটস লিখতে লিখতে আনমনা হয়ে যখন বাঁ হাত দিয়ে কপালের ওপর এসে পড়া অবাধ্য
চুলগুলো সরিয়ে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করে, মকবুলের মনে হয় যেন অনন্তকাল ধরে ও
তাকিয়ে থাকতে পারে ওই এক জোড়া গভীর চোখের পানে। এক্কেবারে রূপকথার গল্পের
মতো।
No comments:
Post a Comment