অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত শুক্রবার হাজির। বৃহস্পতিবার রাত অবধি ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়লেও সকাল থেকে শরতের আকাশ নীল। ঝকঝকে। সাদা মেঘের ভেলা। পুরো কাব্যিক ও আইডিয়াল পরিবেশ। গিনির সাথে আলাপ আলোচনা করে সাজ পোশাক ঠিক হয়ে গিয়েছে। পেঁয়াজ রঙের কুর্তি আর গাঢ় নীল জিন্স। কিছুদিন আগেই কেনা। ম্যাচিং কানের দুল। দুদিন আগে পার্লার থেকে ঘুরে এসেছে তুয়া। ফেশিয়াল, হেয়ার স্পা। ফুরফুরে চুলকে খোলাই রেখেছে। আই লাইনারের ফাইনাল টাচ দিয়ে একবার নিজেকে দেখে নিলো তুয়া। সেলফি তুলে গিনিকেও পাঠালো। ওর এপ্রুভাল লাগবে যে। ঘড়ির কাঁটায় দশটা। এবার বেরোতে হবে। একটু বুক ধুকপুক করছে তুয়ার। অন্য সব ব্যাপারে মাকে বলেই কাজ করে ও। কিন্তু এই মকবুলের সাথে সম্পর্কের কথাটা যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছে। আর এইসব সময়েই ওর আরো মনে হয়। ভাগ্যিস আলাদা থাকে। তাই বাড়ির লোকের কাছে কোনো জবাবদিহি করতে হয়না ওকে।
রাস্তাঘাট সম্বন্ধে খুব বেশি সড়গড় না মকবুল। তাই ঠিক ছিল দুজনেই সাউথ সিটি মলের সামনে দেখা করবে। মকবুলের ভাড়া বাড়ির কাছেই। সেখানে সিনেমা দেখে লাঞ্চ সেরে ভিক্টরিয়া। এইরকমই প্ল্যান। কী সিনেমা, কিছুই মকবুল বলেনি। তুয়া জিজ্ঞেস করতে, খালি বলে গেছে। দেখতেই থাকো। আমি গোটা দিনটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছি। দেখো, দিনের শেষে তোমার ভালো লাগবে। তুয়া আর এরপর কিছু বলতে পারেনি। বেশ আসন্ন সারপ্রাইজের কথা ভেবে উত্তেজিত।
পৌনে এগারোটা নাগাদ সাউথ সিটি পৌঁছলো তুয়া। মকবুল ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে। আজ ওর পরনে সাদা লাল চেক শার্ট আর কালো জিন্স। চোখে নীল সানগ্লাস। ক্লিন শেভড। ঠিক যেন গ্লসি কোনো ম্যাগাজিন কাভারের মডেল। তুয়া হা করে তাকিয়ে থাকে। মকবুল এগিয়ে এসে আলতো হেসে "লুকিং গ্রেট" বলে। তুয়া লক্ষ্য করে, মকবুলের চোখেও সেই একই রকমের মুগ্ধতা। "যাওয়া যাক। সিনেমা হলের ফ্লোরে", এই বলে মকবুল তুয়াকে নিয়ে ভিতরে ঢোকে মলের। সিনেমার বুকিং কাউন্টারে লম্বা লাইন। তুয়াকে পাশে দাঁড় করিয়ে লাইনে আসে মকবুল। এদিক সেদিক টুকটাক কথাবার্তা চলে। হাসি মজা। লাইন এগোয়। এমন সময় মকবুলের ফোন বাজে। "আব্বুর ফোন। ধরতে হবে।"
এক তরফা কথা শুনে তুয়া বোঝে, মকবুলকে জরুরি কিছু ডকুমেন্ট মেল করতে হবে এক্ষুণি। আর সেই ডকুমেন্ট যে বাড়িতে, সেটা মকবুল জানায় তুয়াকে। ও তুয়াকে মলে খানিক অপেক্ষা করতে বলে। ও গিয়েই নিয়ে আসবে কাগজ। সিনেমার টিকিটও কাটতে যায় দুজনের। কিন্তু না। তুয়া একা একা একটুও সিনেমা দেখবে না। ও বলে, ও মকবুলের সাথেই যাবে। কাছেই যখন, অসুবিধাও নেই যাওয়ার। ও যাবে। মকবুল খানিক ইতস্তত করে। তারপর "শিওর? তাহলে চলো" বলে এগোয়। তুয়াও পিছু পিছু হাঁটা লাগায়। একটু যেন দমে আছে। এ কী, শুরুতেই বাধা। মনমরা হয় ও। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। না। মন খারাপ করলে চলবে না। সামনে গোটা দিন বাকি।
রিকশা চেপে ওরা পৌঁছয় মকবুলের ভাড়া বাড়িতে। একটা তিনতলা বাড়ির দোতলায় ফ্ল্যাট। এক কামরার। মকবুল আর আরো একটি ছেলে থাকে। ওরা ঢুকতে দেখলো ছেলেটি কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। জুতো পরছে। মকবুল পরিচয় করিয়ে দিল তুয়ার সাথে। ছেলেটি মেডিকেল রেপ্রেজেন্টেটিভ। নাম শ্যামল। তুয়াকে দেখে হেলো বলে মকবুলকে "ভাই, এলাম। এঞ্জয়" বলে বেরিয়ে গেল। মকবুল তুয়াকে বললো, "তুমি একটু বসো। আমি আসছি।" রান্নাঘর থেকে এক গ্লাস জল এনে দিল। মকবুল ভিতরের ঘরে ঢুকে গেলো। তুয়ার তেষ্টা পায়নি। তবুও এক ঢোক জল খেলো।
ভিতরের ঘর থেকে আলমারি দেরাজ খোলা বন্ধর আওয়াজ আসছে। "আর খানিকক্ষণ, আসছি।" মকবুল বলে। তুয়া ফোন হাতে খুটখাট করে। ওয়াটসআপে গিনিকে জানায় আপডেট। গিনি একটু স্যাড স্মাইলি পাঠায়। ফেসবুকের জগতেও তেমন কিছুই আপডেট নেই। প্রায় মিনিট কুড়ি পর মকবুল আসে ঘরে। সোফায় এসে ঠিক ওর পাশটিতে এসে বসে। একদম গায়ে গায়ে। তুয়া মনে মনে রোমাঞ্চ বোধ করে। বুকের ধুকপুক বেড়ে যায়। দুজনের হাতে হাত ছুঁয়ে যায়। তুয়া একটু ভীতু। ও এক চটকায় হাত সরিয়ে দেয়। ওর মধ্যবিত্ত মানসিকতা ওকে এখনো তেমন সাহস দেয়নি।
মকবুল আবার ওর হাতের মধ্যে তুয়ার হাত চেপে ধরে। তুয়া হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে। পারেনা। মকবুলের হাতের জোর খুব বেশি। এবং তারপরই একদম হঠাৎ করেই তুয়ার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। তুয়ার ভালো লাগেনা। অস্বস্তি হয়। ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। মকবুল শক্ত হাতে তুয়াকে সোফায় ফেলে দেয়। বন্য। উন্মত্ত মকবুল। অসহায় তুয়া লড়াই চালাতে থাকে। মকবুলের কমনীয় রূপ যেন আসুরিক শক্তিতে পরিণত। চোখ বন্ধ করে তুয়া নিজেকে ছাড়ানোর লড়াই চালিয়ে যায়। হাত পা ছুঁড়তে থাকে। ক্রমশ ওর প্রতিরোধ শক্তি কমে আসে। মকবুল পশুর মতো ওকে ছিঁড়ে খেতে যায়। ধস্তাধস্তিতে তুয়া সোফার ধারে পৌঁছে গিয়েছে। এমন সময় ঠিক মিরাকেলের মতো তুয়ার হাত ঠেকে যায় সাইড টেবিলে রাখা জলের গ্লাসে। প্রাণপণে শেষ চেষ্টা করে তুয়া সেটি হাতে নিয়ে মকবুলের মাথায় মারে। মকবুল হকচকিয়ে যায় এই অতর্কিত আঘাতে। তুয়াকে ছেড়ে মাথার পিছনে হাত চেপে বসে পড়ে। তুয়া কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের ব্যাগ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায় ফ্ল্যাট থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে রোবটের মতো চলতে থাকে। কোনদিকে তাকায় না। বেশভূষা চুল সব আলুথালু। রাস্তাঘাট জনমানবহীন।
তুয়া হাঁটে। দু চোখ বেয়ে জল গড়ায়। সেই জলে ধেবরে যায় আই লাইনার। গালে চোখের জলের দাগ। আর গড়িয়ে পড়া কালো লাইনার।
বিধ্বস্ত। ত্রস্ত। স্তম্ভিত।
No comments:
Post a Comment