Friday, June 28, 2019

তুয়ার হিজিবিজি ২০

হাইওয়ে বরাবর চলছে গাড়িটা। মা বাবা দুজনেই এসেছেন ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে। পুজোর ছুটিতে। বাবা ড্রাইভারের পাশে বসে। মাঝের সীটে জানলার ধারে বসে আছে তুয়া। পাশে মা। আর মায়ের পাশে শ্রীময়ী ম্যাম। জানলার কাঁচ নামানো। কাল রাত্রে বৃষ্টি হয়েছে। চতুর্থীর আকাশ বড়ইমেঘলা। ঠান্ডা ভিজে হাওয়া এসে ঝাপটা দিচ্ছে তুয়ার মুখে। তুয়া ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। সেদিনের সেই বিভীষিকার পর থেকে কেমন একটা চুপ করে থাকে সারাক্ষণ।
ওই ভয়ঙ্কর দিনে ও যে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল মকবুলের ফ্ল্যাট থেকে, তারপর সারাদিন উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক হেঁটে বেড়িয়েছে। উদ্দেশ্যহীন। দিকভ্রান্ত। এমনই অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পৌঁছে গিয়েছিল ও এক্সাইড মোড়ে, কী করে, কিচ্ছু জানে না তুয়া। অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ উল্টোদিক থেকে আসা একটা গাড়ির সামনে এসে পড়ে ও। ও এখনো জানে না। ও কি তাহলে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল? সৌভাগ্যবশত গাড়িটা সঠিক সময় ব্রেক করে। ড্রাইভারের সিট থেকে বেরিয়ে আসেন শ্রীময়ী ম্যাডাম। তুয়াকে দেখে, তাও এই অবস্থায়, উনি যারপরনাই অবাক হন। বোঝেন, কিছু গভীর সমস্যা। ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়িতে তুলে সোজা চলে আসেন নিজের বাড়ি। তুয়া কুঁকড়ে যায় সোফা দেখে। সারা শরীর কাঁপতে থাকে ওর। শ্রীময়ী কিছু বলেন না। চুপ করে বসে থাকেন ওর পাশে। খানিক পরে তুয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। শ্রীময়ী তুয়ার কাঁধে স্নেহের আলতো চাপ দিতেই তুয়া শ্রীময়ীর বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে। শ্রীয়ের স্নেহভরা সান্ত্বনার পরশ কাজ করে ম্যাজিকের মতো। ও শ্রীময়ীকে সমস্ত ঘটনাটি বলে।
শ্রীময়ী বিচক্ষণ মানুষ। তার ওপর এখন খুব জনপ্রিয় একটি মিডিয়া হাউজে চাকরি করেন। সঙ্গে সঙ্গে তুয়াকে নিয়ে লোকাল থানায় গেলেন এবং মকবুলের নামে কমপ্লেন লেখালেন। থানা প্রথমে বিদেশি নাগরিক ইত্যাদি শুনে বেগড়বাই করলেও প্রেস দেখেই একদম সুরসুর করে যাবতীয় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। শ্রীময়ী এরপর হৈমন্তী ম্যামের নম্বর জোগাড় করে কলেজেও জানালেন মকবুলের এই কুকীর্তির কথা। জেঠু জেঠিমাকে জানিয়ে তুয়াকে কটাদিন নিজের কাছেই রাখলেন শ্রীময়ী। তুয়ার এখন দরকার মানসিক বল ভরসা। তুয়ার কথামতই তক্ষুনি ওর বাড়ির লোককে খবর দেওয়া হয়নি। দিন তিনেক পর তুয়া কলেজ যাওয়া শুরু করলো। প্রথম দিন ভীষণ আড়ষ্ট ছিল ও। সব্বাই বুঝি ওর দিকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, আর আড়ালে হাসি ঠাট্টা করছে। দেখো, খুব তো উড়ছিলে। এবার বোঝো কত ধানে কত চাল! তুয়ার কান্না পেয়ে যেত। লাইব্রেরিতে বসে একটা কর্নারে হাপুস নয়নে কাঁদতো। কপাল ভালো। কদিনের মধ্যেই শুরু হলো টার্ম একজ্যাম। সবাই নিজের নিজের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। তুয়ার পরীক্ষা খুব খারাপ হলো। কিন্তু একটাই সান্ত্বনা, পরীক্ষা শেষেই পুজোর ছুটি। দু সপ্তাহের।
শ্রীময়ী তুয়ার খুব যত্ন করেছেন এই কদিন। কিন্তু এবার যে তুয়াকে ফিরতেই হবে বাড়ি। তুয়া চায়নি ওর মা বাবাকে কিছু জানাতে। পাছে তারা আর ওকে কলকাতায় একা থাকতে না দেন। যদি কলেজ ছাড়িয়ে দেন। শ্রীময়ী ওকে অনেক বোঝালেন। বললেন, "মা বাবা বিচক্ষণ। এমন সিদ্ধান্ত নেবেন না। কিছু একটা সলিউশন ঠিক আসবে। আর নিজেকে দোষ দেওয়া বন্ধ কর। ঘৃণ্য কাজ যে করেছে, তার লজ্জা পাওয়া উচিত। তুমি কেন লুকিয়ে লুকিয়ে থাকবে? মনে করো কোনো খারাপ ইনফেকশন হয়েছিল। এখন ওষুধ পড়েছে। সেরে গেছে। তা বলে কি তুমি তাও লুকিয়ে থাকবে? জীবন মোটেই শেষ নয় তুয়া। সামনে লম্বা জীবন। নানান সময়ে নানান বাধার সম্মুখীন হবে। লড়াই করতে হবে তো? হাল ছাড়লে কী করে হবে? শোনো, তুমি যথেষ্ট সাহসী মেয়ে। এবং স্ট্রং। নিজের ওপর ভরসা রাখো। এগিয়ে চলো। ঠিক পারবে। কাদা ছিটিয়েছে বলে রাস্তায় হাঁটা বন্ধ করে দেবে? না পা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আবার রোজের জীবনে ফিরবে? এটাও তাই। মকবুল ছিল একটা পাঁক। ওই ময়লা থেকে এখন তুমি মুক্ত। স্নান সেরে পরিচ্ছন্ন। কেন ওই নিয়ে আর ভাববে? তুমি কোনো দোষ করোনি। ভালোবাসা, ভরসা করা কোনো পাপ না। দোষের না। দোষ তো করেছে মকবুল। ঠকিয়েছে তোমায়। অসাধু আচরণ করেছে। আর তার শাস্তি পাবেই ও। পুলিশ ব্যবস্থা করবে। তুমি নিজেকে গুছিয়ে ফেলো তো। সামনেই পুজো। আনন্দ করো। মন ভালো রাখো। কলেজে ফিরে দেখবে, বন্ধুরা আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আর ততদিন তো আমি রইলামই, বন্ধু ভাবো না আমায়?"
শ্রীময়ী নিজে তুয়ার মা বাবাকে সমস্ত ব্যাপারটা জানান। এবং কাউনসিলিং করার কথাও বলেন। মা বাবা প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে লেগে পড়েন এই লড়াইয়ে। মেয়েকে আবার সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার লড়াই।
গাড়িটা চলতে চলতে থামে এক জায়গায়। চায়ের ব্রেক। শ্রীময়ী তুয়াকে নিয়ে গাড়িতেই বসেন। মা বাবা চা খেতে যান। জানলার বাইরে দিয়ে আকাশে তখন মেঘের আড়াল কেটে সূর্যদেব বেরিয়েছেন। আকাশও ঝকঝকে নীল হবো হবো। এক দল ঢাকি দল বেঁধে ঢাকের বোল তুলতে তুলতে এগিয়ে চলে। সামনের কোনো মণ্ডপে বায়না আছে। দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছে। এইবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তুয়া শ্রীময়ীর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে।

No comments:

Post a Comment