এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে শ্রীময়ী ম্যাম আর সৌরভদার মধ্যে সেই ফাটাফাটি ঝগড়াটার। সেদিনের পর থেকেই কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ অফিসে। তুয়ার বেশ অস্বস্তিই হয়। আগে দিব্যি সবাই ওর সাথে কথা বলতো, এর তার খুচরো ফাই ফর্মাস খেটে দিত, হাসি মুখেই। এখন সকলেই কেমন একটা এড়িয়ে এড়িয়ে চলে ওকে। দীপান্বিতার অবশ্য কোনো হেলদোল নেই এই ব্যাপারে। ওর সাথে সবাই আগের মতোই আছে। তুয়া মনমরা হয়েই থাকে সারাক্ষণ। ভাবে, সবাই বুঝি আড়ালে ওকেই দোষ দিয়েছে ঝগড়াটা নিয়ে। কানাঘুষো যা শুনেছে, এমনটাই তো মনে হয়েছে ওর। অথচ কী অদ্ভুত দেখো, ও কিছুই করলো না। সৌরভদা, শ্রীময়ী ম্যাম সবার কথামতো কাজ ঠিক করে দিলো, এদিকে কেমন একটা মার্কামারা হয়ে আছে।
ইন্টার্নশিপের আর এক সপ্তাহ মতো বাকি। তুয়া জানে, এই এক সপ্তাহ ওর দিব্যি কেটে যাবে। টুকটাক যা কাজ রয়েছে, পেন্ডিং, তাও মিটিয়ে ফেলবে। শ্রীময়ীর কড়া স্বভাবের জন্য আজ অবধি কোনো কাজই ফেলে রাখার জো পায়নি তুয়া। একদিকে ভালো। আর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশিই কাজ ও করেছে এই দুই মাসে। শিখেছে অনেকটাই। শ্রী ম্যামের বকুনি ও শাসনের মধ্যেও কেমন একটা প্রচ্ছন্ন স্নেহ অনুভব করতো তুয়া। ঠিক হাই স্কুলের বৃন্দাদির মতো। তুয়া বরাবর অঙ্কতে খুব কাঁচা। সিলি মিসটেকের বন্যা বইয়ে দিত। এই বৃন্দদির বকুনি আর চেষ্টার জেরে সেই তুয়াই মাধ্যমিকে অঙ্কে ৮৫ পেয়েছিল। শ্রী ম্যামকে তুয়া ভারী শ্রদ্ধা করে। শুরুর দিকে রাগী এই ম্যামকে আড়ালে হিটলার নাম দিলেও এখন ম্যাম অন্ত প্রাণ না হলেও, ইন্টার্নশিপ শেষ হয়ে গেলে ভালোই মিস করবে। তুয়ার এই অফিসটা এমনিতে বেশ ভালোই লেগেছে। মোটামুটি এই শেষের কটাদিন বাদ দিলে, আনন্দেই কেটেছে। আর তাই ও ঠিক করেই রেখেছিল। সেকেন্ড ইয়ারেও এখানেই ইন্টার্নশিপ করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই কথাটা কারুর কাছে বলতে পারেনি ও। আজ ভেবেছে একবার ম্যামকেই বলে রাখবে। আজ অন্তত সারাদিনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। তুয়ার কাজের প্রেশার কমের দিকেই ছিল। দুটো ইন্টারভিউ রেকর্ডিং শুনে টাইপ করতে হলো। দুজনেই টলিউডের তারকা। একজন আবার ওর প্রিয় অভিনেত্রী। তাই বিশেষ উৎসাহ নিয়েই কাজটা শেষ করেছে তুয়া। ভাবলো ম্যামকে মেল করে দিয়ে একবার দেখা করেই আসবে। বলবে যে কাজটা হয়ে গেছে। আর সেই সময় যদি দেখে ম্যামের মুড ভালো, তাহলে বলবে পরের বছরের কথা।
ম্যামের অফিসে এলো তুয়া। একটু গম্ভীর যেন আজ। কিছু একটা দেখছিলেন কম্পিউটারে। তুয়াকে দেখে বসতে বললেন। "বলো। তোমার মেলটাই দেখছিলাম। ভালোই কাজ শিখেছো এর মধ্যে। গুড। ইউ আর আ প্রমিসিং ইন্টার্ন।" তুয়া তো গদগদ। আড়াই মাসে এই প্রথম এরকম প্রশংসা। মনে মনে এক রাউন্ড নেচে নিলেও বাইরে একটু শান্ত থাকার চেষ্টা করে ও থ্যাংক ইউ জানালো। বলবে কি বলবে না করছে, এমন সময়ে শ্রী বললেন, "আর কিছু বলবে?" ও এবার সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই ফেললো। বললো, "ম্যাম, আমার এখানে এই আড়াই মাস কাজ করে খুব ভালো লেগেছে। অনেকটা শিখেছি। আমি তাই ভাবছিলাম, আগামী বছরও এখানেই আসবো।" শ্রীময়ী মাথা নেড়ে বললেন, "তা ভালো তো। শোভনের সাথে যোগাযোগ রেখো। ওই তো মনে হয় হেড হবে এখানকার।" তুয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কেন ম্যাম, আপনি?"
শ্রীময়ী নির্বিকার মুখ করে উত্তর দিলো, "ও। তোমায় জানানো হয়নি। আমি ডিজাইন করেছি। আর দুই সপ্তাহ আমার এখানে মেয়াদ। সেদিনের পর থেকে আমার এখানে ঠিক পোষাচ্ছেনা। এই পরিবেশে আমি অন্তত ক্রিয়েটিভ কাজ করতে পারি না। হাওড়া স্টেশনে বসেও আমায় বলো, আমি ফিচার লিখে দেব। বাট নট হিয়ার। দের ইজ নো পিস। আই ক্যানট ওয়ার্ক লাইক দিস।"
তুয়া স্তম্ভিত। এ কী শুনলো? আড়াই মাসের ইন্টার্নশিপে এইটুকু বুঝেছিল যে শ্রীময়ীর অফিস অন্ত প্রাণ। আর এই ম্যাগাজিন হাউজের জন্য শ্রীময়ী কতটা ইম্পরট্যান্ট। এবার তাহলে এই হাউজের কী হবে? আর ম্যাম? তিনিই বা কোথায় যাবেন? তুয়াই বা কী করবে? শ্রীময়ীর কাছে কাজ না করতে পারলে কি ও এতটাই শিখবে? এনজয় করবে? তাহলে কি পরের বছর অন্যত্র কাজ খুঁজবে? খুব মুশকিল। খুব খুব কঠিন প্রশ্ন। মুহূর্তেই তুয়ার হাসি খুশি মনটা ভারী হয়ে যায়। কী বিচিত্র এই জীবন।
No comments:
Post a Comment